পইলা সাঞ্ঝির কথা/১২
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ১২
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
নোটাচন
দুপুরবেলা বাড়িটা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগে যে মোটে মন বসে না। গরুগুলোকে জল খাইয়ে ছাগোলদুটোকেও ছায়া চাপিয়ে একটু মাড়ে নুন মিশিয়ে খেতে দিল। দিয়ে নিজেরও কেমন গরমে হাঁসফাঁস লাগছে। বাইরের দরজাটা চাপিয়ে রসবালা ফাঁকা আছে কিনা দেখতে বের হল। বসমতীর এই এক স্বভাব। একা থাকলেই রসবালার কথা মনে পড়ে। ওদের উঠোনের মুখেই একটা বাতাবী লেবু গাছ। সেখানে মোটামুটি আড্ডা বসে গেছে। সাথে সাথে বড় একটা বাতাবীর খোসা ছাড়ানো হচ্ছে।
“মোকো কোনেক দিবেন বারে”, বলে বসমতীও বসে পড়ল।
বুধেশ্বরের মা বড় একটা কাটারি নিয়ে খোসা ছাড়াতে বসেছে। ভেতরটা অল্প দেখা যাচ্ছে, লাল টুকটুকে।
“ইমার এইটা জমুরা আগুরি হয়, খিবে ভাল বারে”।
বুধেশ্বরের মা বলতে বলতে কাটারিটা রেখে হাত দিয়ে উপরের খোসাগুলো সাবধানে টানে। বাকিরা আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে, কখন হাতে পাবে। কলাপাতায় নুন, কাঁচালঙ্কা, একটু সর্ষের তেল রাখা। পাশে আরো কলা পাতা ছোট ছোট করে কেটে ধুয়ে রাখা। অবশ্য এরপরেও না কুলালে কচুর পাতা অথবা ভাটফুলের পাতাও ছিঁড়ে আনাটা কোনো সমস্যাই নয়। রসবালা বলে,
“চাংরা খানোত ভাল করি বইসখেনে দি”।
তারপর একটু থেমে বলে,
“হামার জমুরাগিলা যেমন আগুরি পাকে তেমন মজাও খিব। কয়টা খান খাও। অই তো কোটাখান পাড়াও আরো দুইটা। না খাবেন তে চোরে আদাসাটি করিবে”।
বসমতী কথা শুনে জোরে হেসে উঠল। রসবালা বসমতীকে বলল,
“ততকরায় দি, আজি নোটাচন খেলা। চোরগিলা এলায় হামারে বাড়িৎ আসিবে। আগের বার আতিত মোক ড্যাকে ওটেয়া দাও চান্দাইল”।
বসমতী জিজ্ঞেস করল,
“কায়?
রসবালার গতবারের রাগ যায় নাই বোঝা গেল, রেগেই উত্তর দিল,
“কায় আরো, মন্তেসের বাপ! মোক কইল পুবটারি থাকি নাইকেল চোর কইচ্চে। সাকালে দেখং হামারে নাইকেল পাড়ে হামারে বাড়ির আগদোরোৎ বসি খাইসে। এমোতোন জমুরাগিলাক কি আরো ছাড়িবে”?
বসমতী কান্ড শুনে হেসে ফেলল।
রসবালা হাসে না, মুখটা ব্যাজার করে বলে,
“না হয় দি, মুই এইবার পাহারা দিম। ইমার চোর করাখান বাইর করি দিম”। ভাদ্রমাসের তেরো তারিখ নষ্টচন্দ্র তিথি। এই দিন ছেলে-পিলেরা কিছুটা মজা করেই অনেক রাতে ফল-পাকুর চুরি করতে বের হয়। কারো বাগান থেকে কলার কাঁদির কিছুটা কেটে নিল। কারো গাছের নারকেল, বাতাবী চুরি করে কিছুটা খায়, কিছুটা ভাগ করে নিয়ে যায়। আবার পরদিন সকালে বাড়ি বাড়ি বিলিয়েও আসে। তবে নিয়ম হচ্ছে যা-ই চুরি করা হোক না কেন, গৃহস্থের জন্য রেখে আসতে হবে। সবটা নেওয়া যাবে না। আবার অনেকে মজা করে যার চুরি করেছে তাকেই রাতে ডেকে কিছু দিয়ে যায়। সকালবেলা মালিক বুঝতে পারে আসলে ওটা ওরই গাছের। মালিক এবং চোর উভয় পক্ষই বিষয়টা মজা হিসেবেই নেয়। যার খুব আপত্তি আছে সে রাত জেগে গাছ পাহারা দেবে। সাধারনত পাড়ার ছেলে-পিলেরা দলবেঁধে চুরি করতে বের হয়। এমনও হয়েছে কারো গাছের কলা বা নারকেল টার্গেট আছে। কিন্তু সে-ও দলে আছে। সেক্ষেত্রে ওকে অন্যভাবে ব্যস্ত রেখে দু'তিনজন দলছুট হয়ে গিয়ে চুরিটা করে আসে। পরদিন চলে কার বাড়িতে কীভাবে চুরি করেছে তার গল্প। যার উঠোনে গল্প করছে তারও হয়ত কিছু চুরি করেছে। কিন্তু সকালবেলায় ওটাই মজা করে সবাই শুনছে। বসমতীর একবার লেবুগাছ শেষ। পরদিন বেচারা বেচারা মুখ করে বুধেশ্বর এসে কিছু লেবু দিয়ে গেল। রসবালার পাহারা দেবার কথা শুনে বসমতী হাসল। ওরা যদি চায় কখন চুরি করবে টের পাওয়াই মুশকিল। আর এক একজন বাঁদরের মতো গাছে চড়তে পারে। নিমেষে এক গাছ থেকে আর এক গাছে।
রসবালার কথা শুনে মিনতির মা বলে,
“তোর নাইকোল আর মোর গুয়াগিলা”?
তারপর রসবালাকেই বলে,
“দ্যাখেক তো মাই, গুয়া হইল মোর নিশার জিনিস। তে গোয়ালি ঘরের পাছিলাত কয়টা গছ গারিসুং। হরেন মোক একদিন কছে, ‘হ, তোমার গুয়ালা না পাড়ান! একটা বাদা কেমন পাকিসে, পকিয়ে খায়া নিবে। মুই আরো হাসিলুং, কলুং, মড়া, পকি কুনোদিন গুয়া খায়! পকি কি মানসি? তে হাসিয়া মোকে কছে, খায় খায়, কুনো কুনো দিন খায়”।
এরপর একটু থেমে দম নিল। মিনতির মায়ের কথা শুনে সবাই মুখ টিপে হাসতে শুরু করে দিয়েছে। জানা কথা, হরেন সুপারি গাছে চড়ায় ওস্তাদ। সে পাখি আর কেউ নয়, হরেনই হবে। একটু থেমে আবার শুরু করে মিনতির মা,
“মোর তো ফমে নাই নোটাচন খেলা কুনদিন! তার ফিরা দিন সাকালে উটি আগিনাখান জড়ে থুয়ায় ছাগলগিলা বান্দি আসিলুং। তার পাছে আস্তে ধীরে আগদোরখান সামটোছোং। হরেন মড়া হাতোত কয়টা বড় বড় গুয়া আনি কছে, কাকি খাবু? দ্যাখেক কেমন ভাল গুয়ালা। সোয়াসী গুয়া, কোনোক্কো মাতাত ধরে না। তে মুই হাতোত নিলুং। দিয়া আরো মুচুত মুচুত হাসে। মনটাত দোগ্ধা বাজিল। দ্যাখোং তো এইলা কার গুয়া, হামারে মোতোন করেছে! বান্নি থুয়া যায়া দেখং, হ্যাঁ, হামারে বাদাটা নাই। আগখান উঠিল খিব। ঘুরি আসি মনটা কয় বান্নি দিয়া ঝুড়ি দ্যাং মড়াটাক। তে কাক গাইলাং, উয়ায় তো অদি আর নাই, সেলায় পালাইসে”।
গল্প শুনে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। বুধেশ্বরের মা ভালো করে বাতাবী মাখা পাতায় ভাগ করতে করতে শাষন করার গলায় বলে,
“ন্যাও, তোমরা হাসিবেন কে না খাবেন”?
রসবালা বসমতীর হাতে একটা পাতা তুলে দিতে দিতে বলে,
“খামুকে না তে, খামুকো, হাসিমুকো। এঠে কাছারিত বোচ্চিকে ওই তানে”!
--------------------------------------------------------------
চাংরা - বাঁশের তৈরি চৌকির মতো বসার আসবাব।
আদাসাটি - অর্ধেক খেয়ে নেওয়া।
নোটাচন - নষ্ট চন্দ্র। প্রতি বছর ভাদ্রের তেরো তারিখকে ধরা হয়।
গুয়া - সুপারি
বান্নি - নরম ঝাড়ু
--------------------------------------------------------------
ছবি : ঋণ রীতা রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴