নানা রঙের গানগুলি-১২/শৌভিক কুন্ডা
নানারঙের_গানগুলি-১২
শৌভিক কুন্ডা
-------------------------------
কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলতেন ওনার শৈশবে নাকি খাঁজকাটা পয়সা গলায় আটকে চিরস্থায়ী হয়ে যায়, ফলে সব গানই বের হত 'কিরিকিরি' হয়ে। সে লোকে যা চায় বলুক, আমার অন্যতম প্রিয় পুরুষকন্ঠ তাঁরই। কোন শিশুবেলায়, যখন গান-কবিতা-ছড়া কোনোটাতেই ঠিকঠাক পা ফেলার সময় হয় নি, তখনই শুনে ফেলেছিলাম তাঁকে। বাধ্য হয়েছিলাম বলা ভালো, রিচ্যুয়ালি। বছরে একবার, ভোর রাতে। আর প্রথম দু এক বারের পর থেকেই মন কেমন মুখিয়ে থাকতো, কখন শুনতে পাবো সেই স্বর্গীয় উচ্চারণ "তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা"! হ্যাঁ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। প্রথম "তব" ছাড়িয়ে "অচিন্ত্য"তে তবলার শব্দ। ঠাকুমার কোলের কাছে গুটিশুটি মেরে আধোঘুমে আমি। কিন্তু সে অর্ধচেতনেও অপেক্ষা, বারবার ঘুরে ফিরে আসা "তব অচিন্ত্য"র অমোঘ মোচড়! এইভাবেই এই কিন্নরের সাথে আমার প্রথম পরিচয়।
এরপর খুব বেশিদিন লাগেনি তাঁকে চাক্ষুস দেখতে। সাতের দশকের মাঝামাঝি। হাফপ্যান্ট তখনও আমি। আমার স্কুল, জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলের একশো বছর পূরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠান। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, রেডিওর ভেতর থেকে এঁরই গলা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় প্রতি বছর মহালয়ায়! দুটো গানের কথা বলবো। আমার তো গান নিয়ে আলোচনার যোগ্যতা নেই। শুরুতেই বলেছি, এক একটা গানের সাথে কোনো স্মৃতি, বিশেষ অভিঘাত জড়িয়ে যায়, অবরে সবরে সে সব নিয়েই জাবর কাটি। তো, যে দুটো গানের কথা বলছিলাম, তার প্রথমটি "আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন"। তেড়ে গাইছেন মানবেন্দ্র, সঙ্গতে যতদূর মনে পড়ে, রাধাকান্ত নন্দীই, দুজনের খেলা জমে উঠেছে। মানবেন্দ্র হঠাৎ থমকে গেলেন। তাঁর চোখের অনুসারী হয়ে তামাম শ্রোতারাও দৃষ্টি ফেললেন আমন্ত্রিত অতিথিদের দিকে, প্রথম সারি থেকে উঠে আইলের দিকে হাঁটছেন কেবল এ শহর নয়, তাবৎ উত্তরবঙ্গেই শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষাবিদ। বরাবরের মতোই কাঁধছোঁওয়া চুল, বুকছোঁওয়া দাড়ি, তাদের শুভ্রতা ছুঁয়ে আছে নিপাট ধুতি-পাঞ্জাবিকে, কাঁধে ঘিয়ে রঙের শাল। মানবেন্দ্র কী বুঝেছিলেন, কে জানে, গান থামিয়ে বলে উঠলেন, " ও দাদু, যাবেন না, যাবেন না, আপনার জন্যও আছে"। বলেই, যেখানে থেমেছিলেন, সেই "বিনোদবেণীর জরিন ফিতায়" থেকে সোজা চলে গেলেন,
"শূন্য এ বুকে পাখি মোর
আয় ফিরে আয়, ফিরে আয়"তে!
তারপর আমার বড়ো হয়ে ওঠা। বেপথুমানতার সাথে গানের বিরোধ নয়, বরং অসম বন্ধুত্বই বেড়ে চললো। ততদিনে নজরুলের গানে মানবেন্দ্রর সাম্রাজ্যের সাক্ষী হয়ে গেছি, বাংলা আধুনিক গানেও। বারে বারে কে যেন ডাকে আমারে, পলাশফুলের গেলাস ভরিয়া পিয়াবো অমিয়া, বনে নয় মনে মোর পাখি আজ গান গায়, আর, আর আমার ভেতর আজও অবধি রাজপাট বিছিয়ে রাখা, আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি! এ গানের কথা বিতাং করে আর নয়, আগের কোনো পর্বে বলেই রেখেছি। এরকম সময়েই মানবেন্দ্রকে আমার শেষ বার 'লাইভ' শোনা। বিনি পয়সায়। কারণ, যতক্ষণে টিকিট কাটার পয়সা যোগার করতে পেরেছিলাম, সে মহার্ঘ্য বস্তুটি শেষ হয়ে গেছে। অদম্য জেদ নিয়ে তাও চলে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রভবনে। গ্রীনরুমের বারান্দার সামনের সিঁড়িতে বসে পড়েছিলাম। যেটুকু ভেসে আসে, তা-ই তো অমৃত আমার। আয়োজকদের মধ্যে একজন (পরিচিতি ছিলো পারিবারিক সুবাদে), ঐ ভাবে বসে থাকতে দেখে ডেকে নেন। গ্রীনরুমের অন্ধকার কোণে ভাঙা বেঞ্চে সুযোগ করে দেন। অনুষ্ঠান মানবেন্দ্র শেষ করেছিলেন -
" কেন ফোটে, কেন কুসুম
ঝরে যায়,
মুখের হাসি চোখের জলে
নিভে যায়" এই গানটি দিয়ে। গান শেষ, তুমুল হাততালি ভেসে আসছে, কতক্ষণ যে ঐ অন্ধকার বেঞ্চটাতে বসে বসেছিলাম, কেন যে, জানি না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴