তোর্সার ঘর বাড়ি//দ্বাবিংশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
-----------------------------------------
'ডাঙায় আছে মন কেমনের গহীন সুরের গান/ একখান নারীর বুকে চলে হা হা নাওয়ের টান'
আজ
এসেছিল অবনী। সঙ্গে ওর দিদির মেয়ে। মাঝ সেশনে কি করে ভর্তি নেওয়া যায়! ওকে
নিয়ে প্রিন্সিপ্যালের ঘরে যায় প্রজ্ঞা। এই কলেজে ড: জ্যোতি সিং এর
মান্যতা আছে। অবনীর দিদি হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে চলে গেছেন। এক সপ্তাহের
মধ্যেই শ্বশুর বাড়ির নানা অশান্তিতে মেয়েটার পড়া বন্ধ হতে বসেছে।অবনী ওর
বন্ধু আছে ভেবেই নিয়ে এসেছে মিনির কাছে। ফোন করেই এসেছে।
-ও
এখন এখানে আমাদের কাছেই থাকবে বুঝলি? ওর বাবা তো কোনদিন ই সেভাবে দেখেনি
ওকে। একাই পড়াশুনো করত। আর মাথার উপর মা ছিল আর ঠাকুমাও যে কেমন বুঝতেই
পারছিস। তাই আমরা ভাইরা ওকে নিয়ে এসেছি। বড় হয়ে গেছে, একটু দেখাশোনাও তো
দরকার।
- ভাল করেছিস। আমি ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে
রাখছি। মিনি আশ্বাস দিয়েছিল বন্ধুকে। আর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ও সহানুভূতির
সঙ্গেই দেখলেন সব।
-ঠিক আছে এক সপ্তাহ পর আসুন। আর
প্রজ্ঞা ম্যাডামের কাছেই জেনে নেবেন কবে থেকে আসবে। ও তো ইতিমধ্যে কোথাও
ভর্তি হয়নি বললেন।...ওকে, ঠিক আছে। লাষ্ট স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট, বার্থ
সার্টিফিকেট সব আনুন।...হয়ে যাবে আশাকরি।
অবনীর খুশি মুখ মিনিকে শান্তি দিতে পারে। মেয়েটার করুন দুই চোখেও কৃতজ্ঞতা।
-
তোমার নাম তো 'মেঘনা', খুব ভাল, জান আমি নদী খুব ভালবাসি। 'আমিও'...বলে
ওঠে মেয়ে। একদিন তুমি নিজেই আর ও বড় হয়ে মেঘনাকে দেখে আসবে, মেঘনার বুকে
নৌকো চড়বে। ঠিক আমার মত।... খুব খুশিতে ঝলমল করে মেয়ে। তারপর নতুন তৈরি
নৌকোর মতই মামার হাত ধরে বিকেলের আলোয় ফিরে যায়। প্রজ্ঞা তাকিয়ে থাকে আবার
ওর অতীত ছেড়ে আসা বিরাট এক বর্তমানের মাঝখানে। যেখানে রাজনগরের অন্ধিসন্ধি
বদল আর নতুনের ডাক শুনে কতনা অন্বেষণ বুকের ভিতর আর শরীরের মাঝখানে ফুটি
ফুটি করে। শহরের মাঝ বরাবর এক একদিন মার্কেটিং আর ওষুধ বিশুধ কেনা আর
সাতদিন বাদ তরি তরকারি মাছ কিনতে বেরিয়ে যায়। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধে আর
অন্যমনস্ক মিনি কোন গলি ঘুঁজিতে ঢুকে পড়ে। মনে হয় এই যে আমার চেনা কামিনী
গাছের জায়গা চিনতে পারছি না যে! মদন মোহন বাড়ির ঠিক পেছন দিক। একজন প্রিয়
দিদিমণির বাড়ি ছিল, কোন ছোটবেলার কথা। নাম মনে করতে পারেনা। কিন্তু কামিনী
ফুলের সুগন্ধ এখনো আসে। তবে জিজ্ঞেস করে জেনেছে মাপজোক সারা। ওখানে বড়
দোকান, বাড়ি অর্থাৎ নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বাড়াবাড়িতে এ খোলা জায়গা,
পুরনো বাড়ির কালো হয়ে আসা দেয়াল আর থাকবে না।
কেমন
ভারাক্রান্ত হয়ে যায় মন। পুরোনো মুখ কেবল ই অন্বেষণে থাকে। বাজার করতে
গিয়ে... রুটি কিনতে গিয়ে 'মদন মোহন দেবের' ঘাড় কাত করে বাঁশি বাজানো পুরোনো
সাদা কালো এক ছবি বাঁধানো ঝুলিয়ে রাখা।মালিককেও জরিপ করে নেয় সে। মালিক
আধবয়সী। সে তো হিসেবে ব্যস্ত। কতদিনের পুরোনো দোকান। অস্পষ্ট ছায়ার মত
দেখে মিনি, জেঠুর সঙ্গে এ দোকানে সন্ধের বেড়ানোর পর খেতে ঢোকা।...সেই ছবি।
তখনকার সময়ের কোন মানুষ কি এখন নেই। না, নিশ্চয়ই আছেন। তারা কি আর মিনির মত
ঘোরাঘুরি করে! এ শহর অন্য শহর...এ গাছ ওগাছের সন্ধান অথবা পুরোনো মাটির
ছবি বুকে বয়ে বেড়ায়। শুধু এই রুটির দোকানে মাঝবয়সী ভাঙাচোরা চেহারা খুব
চেনা মনে হয়। আর পিছনের মদন মোহন এতো তার সময়ের নিজস্ব। তখনও তো আগের
মূর্তি চুরি হয়ে গিয়ে অন্য নতুন মূর্তি বসেনি। মদনমোহন চলে যাওয়ার খবর
পেয়েছিল তখন ক'দিন ধরে খবর কাগজে...কেন যেন মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই পাওয়া
যাবেই। পাওয়া গেলনা। নতুন হল। ঠিক প্রজ্ঞা সান্যাল যেমন নতুন নারী এ মাটি
এ গজিয়ে ওঠা নতুন সব ইমারত, নতুন হোটেল সে চেনেনা। সাধের'প্রণতি' বুক হাউস
নেই। তার বদলে পাকাপোক্ত জামাকাপড়ের দোকান, সোনার দোকান পাশাপাশি। সঞ্চয়ন
বইঘর এখনো আছে।নষ্টালজিক হয়ে যায় মন। গিয়ে দাঁড়ায়। কে যেন চিনে নেয় ওকে।
খুব ভাল লাগে। আহা, মিনির বাবাকেও চেনেন এঁরা। বাবার বই রেখেছে। মনে খুশির
হাওয়ায় সন্ধে রাত পেরিয়ে মোবাইলে রোহিনীকে জানায়...
'...জানিস,
এখন ও কয়েকজন চিনতে পারে।...কত কিই যে নেই! নেই সেই বন্ধুর বাড়ি লাগোয়া
ঘড়ি মোড়ের ঘড়িটি। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নামিয়ে নিয়েছে। আমার ছোটবেলায় এখানে
ঘড়ি ছিলনা কিন্তু রু। সবাই ঘড়ি মোড় বলে। আমরা বলতাম'হরিশ পাল চৌপথী'
...এবার
তুই এলে নদীর পাড়ের টিনের বাড়িগুলো ওদের এলাকা জুড়ে দোকান, অরণ্য,
নিজেদের হাতে লাগানো বাগান সব দেখবি আর অবাক হয়ে দেখবি যে শহরের মাঝ বরাবর
আমি প্রতিদিন হাঁটি, জীবন বাঁচানোর তাগিদে খাবার সন্ধান করি, ওষুধ কিনি তার
বিপরীত এক জীবন। সংগ্রামের, খেটে খাওয়ার। ওরা মাছ ধরে। বিক্রি করে, সবজি
তোলে, বিক্রি করে হয় নতুন বাজার নয়তো দেশবন্ধু পাড়ায় আর সেই সাঁকোটা, যার
ছবি পাঠিয়েছি, সেই পুল পেরিয়ে টাপুর হাট,শুটকা বাড়ি, পশারি হাট থেকেও সবজি,
ডিম, আরো নানা জিনিস নিয়ে এসে বাজারে বসে। এ আবিষ্কার বড় আনন্দের। কত
ছেলেবেলার বন্ধুর মুখ খুঁজি। খুঁজে পেয়েও যাই ওদের মাঝবয়সী ভাঙাচোরা মুখে।
ভাবছি, এবার ফার্ষ্ট ইয়ারকে নিয়ে ঐ সাঁকো পেরিয়ে পায়ে হেঁটে পসারিহাট যাব।
বেশ ফিল্ড ওয়ার্ক হবে।
এ টিনের কোঠা বাড়িতে গিয়ে সেদিন কাঁচা সুপুরি, পান খেয়েছি।
...'করেছ
কি? মাথা ঘুরবে। ওখানে ডাক্তারি পরিষেবা একদম ভালনা, তুমিই তো বল। তাহলে,
আবার ঐ ভুল চিকিৎসা আর দাদুর মত সাত তাড়াতাড়ি অক্কা!!...ওসব চলবেনা। আজ ই
বাবাকে ফোন করব।
- কি লাভ? তুই তো আসবিই, দেখে যাস
আমার একা থাকার আনন্দ টুকু। আর আমার ফিরে পাওয়া নদীর গল্প।- হুম্। আজ
ল্যাবের সবাই মিলে দারুন খাওয়া দাওয়া হল।
- দেখ বাবু, বেশি বাইরের খাওয়া খাবেনা। একটু একটু রান্না শেখ। এরপর তো করে খাওয়াতে হবে কাউকে, আর নিজেও খাবে...
-ব্যস্ আবার শুরু! ..কাটলাম। ঘুম পাচ্ছে।
* * *
রোহিনীর বিয়ের কথা একটু একটু মেয়েটাকে মাথায় দিতে চেষ্টা করে। মিনি জানেনা রু এর বন্ধু শুভায়ুর সঙ্গে ওর কি রকম বন্ধুত্ব।
একবার ঘুরেও গেছে এখানে। জিজ্ঞেস করি করি করেও হয়ে ওঠেনি মিনির। এবার জিজ্ঞেস করবে ঠিক।...
স্তব্ধ
রাতের ব্যালকনিটা একা ওর মত ই। সারা দুপুরের ধুলো জমে মানিপ্ল্যান্টের
পাতায় লতানে কান্ডে। ও যেখানে, সেখানে সবুজ চারা গাছ থাকবেনা তা তো হয়না।
ঠিক যোগাড় করে রেলিং ভরিয়ে ফেলেছে ক'মাসেই। দূরে ঐ ফুটি ফুটি আলোর মধ্যে
ছোটবেলা জুড়ে আলেয়া খুঁজেছে, এখন এ পরিচ্ছন্ন পাকা রাস্তা ওর বারান্দায় এসে
দাঁড়িয়ে যায়। গভীর শীত কুয়াশা জমে গেলে দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় ঐ
বুঝি ওপাড় থেকে ঝাঁপিয়ে চলে এল ভয়ঙ্কর সে চারপেয়ে। অপূর্ব অথচ কি ভয়ানক। ঐ
রকম ই এক শীত রাতে এল. আই.সি অফিসের উল্টো দিকের বন জঙ্গল ঘেরা ঠান্ডা
কাঠের বাড়ির কুয়োতলা থেকে মুখে করে কুড়িয়ে নিয়েছিল মিনির বন্ধু মিঠুর
ছোটমামাকে। কুয়োতলায় প্রতিদিনের মত মুখ ধুতে গিয়েছিল মামা। সেই ভয়ঙ্কর
গাছের কোন মগডালে ওত পেতে ছিল কে জানে! আর পাওয়া যায়নি তাকে। সেটা আশির
দশকের শুরু।... সে ছবি মনের ভিতর এঁকে নেওয়া মিনির। সে'ত বদলে যায়না।...এ
বারান্দায় দাঁড়ালেই ও দেখে ঐ দূরে বাঁধানো পাকা জাতীয় সড়ক ধরে হেঁটে আসছে
সে ভয়ঙ্কর। বৃষ্টি এলে অথবা লোডশেডিং এর মায়াময় ঘোর তোর্সাকে ঘিরে থাকে
রাতের নিস্তব্ধতা। খুব বেশি ভীতিপ্রদ বাঁধ রাস্তা এখন আর নয়। সাইকেল দাঁড়
করিয়ে যুগলের প্রেমালাপ আছে এখানে ওখানে।অরণ্য ঘেরা ঐ পাকা রাস্তার ধারে।
টিনের দোচালা, চারচালা বাড়িগুলোয় আলো জ্বলে। কোন কোন বাড়ি থেকে রিয়ালিটি শো
এর শিল্পীদের উচ্চকিত গান বা সিরিয়ালের সংলাপ ফাঁক ফোকর দিয়ে শোনা যায়।
গরম পড়লে বাঁধানো রাস্তার উপর বিছিয়ে রাখা ছেঁড়া ছেঁড়া মাদুরে প্রচুর গল্প
গুজবের শব্দ ওঠে। মিনি কখন ওদের দলে ভিড়ে যায়, ছবি দেখে মনে মনে। ওদের সময় এ
বাঁধ বরাবর গভীর রাত জুড়ে 'বল হরি হরি বোল...' ধ্বনি দিয়ে যেত, আরো ভয়াল
অন্ধকার আর ভয় ঘিরে ধরত মিনিকে। পাশে মা আছে কিনা দেখে নিত আর চুপি চুপি
কান বন্ধ করে কোঁক প্যাঁচার ডাক আর হরিধ্বনি দুই ই বন্ধ করে দিতে চাইত।
হতোনা। ঢুকেই যেত বুকে ভেদ করে মাথার দিকে। কাঁচা বাঁধে তখন একা খেজুর গাছ
ছায়া হয়ে দোল খেত বেজায়। আধপাকা আর হলদে পেকে ওঠা খেজুর ছড়িয়ে দিত নীচে। সে
খেজুরের স্বাদ ই আলাদা। তেমন আর পেল ক ই মিনি! কালো রাস্তা ঝলমলে বটেই
এখন। রাতের অন্ধকার ভেদ করে প্রাইভেট গাড়ির চার চাকা গড়িয়ে যায় হরিণচওড়া
হয়ে কখনো খাগরাবাড়ির চৌহদ্দির দিকে অথবা রানীর বাগান ছাড়ানো পাটাকুড়ার
রাস্তায় নামবে বলে।
এ একার সংসার মিনিকে একটু করে ইতিহাস চিনতে বলে। মরে যাওয়া সময়ের কথা তুলে ধরে, জেগে ওঠা চর ইতিহাসে লেগে থাকে কোন চাঁদের মায়া।
* * *
আজ সন্ধে পেরোতে না পেরোতেই লোডশেডিং এর গুমোটে ঐ বারান্দাতেই দাঁড়িয়েছিল মিনি। অনেক প্ল্যান ছিল।
বাজার
আর আমতলা পেরোনো সাগরদীঘির রাস্তা ধরে হাঁটবে বলেই প্রস্তুতি
নিয়েছিল।...সদ্য আলো এল। কানেকশন আসতে না আসতেই দরজা আটকে জোর কদমে হাঁটা
দিল মিনি। তিনতলা ফ্ল্যাট থেকে নেমে সোজা আমতলা পেরিয়ে রাতের অন্ধকার আর
আলো ছায়ায় রাউন্ড দিয়ে এক, দুই, তিন গুনতে শুরু করে।... আকাশ কেমন থমথমে
বিদ্যুৎ মুহূর্তে ঝলকানি। এক চক্কর পুরো হতে না হতেই টিপ টিপ থেকে
মুহূর্তে ঝড় বৃষ্টির ঝরঝরানি। এবার দাঁড়াতেই হবে। হাতে ছাতা নেই মিনির। শিব
বাড়ির কাছে, রাজবংশী একাডেমীর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় । মিনিট পাঁচেক যেতে
না যেতেই খানিকটা ঝড় কমেছে। পায়ে পায়ে এগোয় আমতলার দিকে...ইস্ কচি আম পড়ে
ফেটে চৌচির। কয়েকটা পায়ের কাছে লুটোচ্ছে। মিনির ভেতর ছোটবেলা এখন।...
যতগুলো আম হাতে ধরে কুড়িয়ে নেয় সে...।