সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
16-December,2022 - Friday ✍️ By- নীলাঞ্জন মিস্ত্রী 505

তিস্তাবাথান-১২

তিস্তা বাথান
পর্বঃ বারো
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^

উত্তরে রোগব্যাধি, অভাব-অনটন, দারিদ্র-কষ্টের মাস ভাদ্রমাস। স্বর্গীয় নগরের (বৈকুন্ঠপুর) প্রান্তরে প্রান্তরে এ মাসকে পঁচাভাদর-ও বলা হয়ে থাকে। রুকরুকা নদীতিরে বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির ভদ্রকামিনি বা ভাদ্রকাটানি পূজার আয়োজন- এর স্বাক্ষর বহন করে চলে। মধ্যতিস্তার চরভূমিতে এক খুঁটে কয়েকবছর থাকা বাথানের মৈষাল বন্ধুদের কাছেও এই ভাদ্রমাস কোনোদিনই সুখপ্রদ হয়ে ওঠেনি। 

চৈত্রের শুরুতেই প্রকৃতির নিঃশব্দ বার্তা পৌঁছে যায় বাথান মালিকদের কাছে।বাথানে বাথানে শুরু হয় মৈষাল বন্ধুদের ব্যস্ততা। এ ব্যস্ততা বাথান তুলে নেবার, এ ব্যস্ততা বাথান গুটিয়ে নিজদেশে পাড়ি দেবার। বিগত ছয়-সাত মাসের আমোদ-প্রমোদ, হাসি-ঠাট্টা, প্রেম-ভালোবাসাকে বুকের এককোনে আগলে রেখে বাথান ছাড়েন ভিনদেশি মৈষালেরা। স্থানীয় মৈষালেরা সজল নয়নে বিদায় জানান তাদের বন্ধুদের। মধ্যতিস্তার সুবিশাল আকাশ তলে হাজার হাজার ঘন্টির ঘন কনসার্ট ক্রমশ পাতলা হতে শুরু করে। সুঠাম, বলিষ্ঠ, আকর্ষনীয় মৈষাল যুবকেরা মহিষের দলের পেছনে চলতে চলতে অদৃশ্য হয় ওই দিগন্তরেখায়। তিস্তাপারের কইন্যা, তিস্তাপারের গৃহবধূ, তিস্তাপারের বাল্যবধূ, তিস্তাপারের বাল্যবিধবাদের বিদীর্ণ হয় বুক। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে তারা। পূবালি আর পশ্চিমা হাওয়া এসে মুছিয়ে দিয়ে যায় মহিষ আর মৈষালের ফিরে যাবার পদচিহ্নগুলিকে। তিস্তাপারের অসংখ্য হৃদয় তার বিরহের চোরাবালিতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে ভিনদেশী মৈষালদের। আগামী ছয় মাসের জন্য মৈষাল বন্ধুরা নিমজ্জিত হন হৃদয়ের সেই চোরাবালির মাঝে । আবেগি এই সময়ে চোখের বালিও স্নাত হয় ক্ষণস্থায়ী প্রেমের নিদারুণ পরিণতিতে। তিস্তার শন শন হাওয়ার মাঝে কান পাতলেই শোনা যায় পল্লীবাংলার জীবনমুখী সেই মৈষালী সুর.....

'মইষ চরান মোর মৈষাল বন্ধুরে
বন্ধু কোনবা চরের মাঝে।
এলা ক্যানে ঘান্টির বাজন
না শোনঙ মুই কানে মৈষাল রে।'

ভাদ্রমাসের আকাশের জল আর ভাদ্রমাসের তিস্তার জল কোনোটাই ভালো নয়। তিস্তার জল সব থেকে বেশি ঠান্ডা হয় এই ভাদ্র মাসেই। কোমর সমান জলে কষ্ট করে মাত্র দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেই জ্বর, সর্দি, কাশি অবধারিত। বাথানের মহিষকূলকে এ সময়ে জলে নামতে না দেওয়াটাই শ্রেয়। কিন্তু জল ছাড়া যে মহিষ বাঁচে না। তাই স্বাভাবিক কারণেই এ মাসে মহিষের রোগব্যাধি লেগেই থাকে। ভাদ্রের বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নীচেই মহিষদের থাকতে হয়। এই বৃষ্টির জল নাকে কানে প্রবেশ করলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। এ বিপদ শুধু মহিষের নয় এ বিপদ মৈষালবন্ধু তথা তিস্তাচরের সকল মানুষেরই। বহু মহিষকেই প্রাণ হারাতে হয় প্রকৃতির এই শীতলবাণে। মৈষালের মাথার ওপর ছাদ থাকার দরুন হয়তো মহিষকূলের মতো নিদারুণ পরিণতি তাদের হয় না। 

বিপদ শুধু ঠান্ডা জলের নয়। ভাদ্রের বন্যায় তিস্তার জল ভীষণভাবে দূষিত হয়ে ওঠে। মানব সভ্যতার সমস্ত গরল বুকে নিয়ে তিস্তা ছুটে চলে সমুদ্রের দিকে। এ সময়ে তিস্তার প্রচন্ড ঘোলাটে জল ক্ষতি করে বাথানের মহিষদের। ভাদ্রের বাণের জল পারতপক্ষে গায়ে মাখান না মৈষাল বন্ধুরা। এ জল যে ভীষণ ক্ষতিকারক। কিন্তু তিস্তাপারের যে সমস্ত মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্রোতে ভেসে আসা কাঠ ধরতে তিস্তায় ঝাঁপান ক্ষতি হয় তাদেরও। নেলভেলু, সানিয়া, বাচ্চুদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম তিস্তার ভাদ্র-জলের এই মহিমা। আলোচনান্তে নেলভেলু তো বলেই ফেললো, “দাদা, ভাদোরিয়া বৃষ্টিত তুই এঠে আসিয়া শুধু দুই মিনিট ভিজি দেখাইস”।

ভরা তিস্তার ভাঙন আর বর্ষাশেষে নদীর ভাঙন এক জিনিস নয়। স্বাভাবিক ভাবে মনে হতেই পারে ভরা বর্ষায় হয়তো নদীর পাড় ভাঙ্গে বেশি। কিন্তু একথা বা ধারনা একেবারেই ঠিক নয়। বর্ষাশেষে নদীর জল অনেকটাই কমে গেলে চরে চরে অথবা নদীর পাড়ে ভাঙনকার্য বেশি সংগঠিত হয়। তাই ভরা বর্ষায় নদী ওপরে উঠলেও ভাদ্র আশ্বিনে চরের মাঝে বেশি করে ঢুকে পরে তিস্তা। মধ্যতিস্তার বহু চর গুঁড়িয়ে দিয়ে তার ওপর দিয়ে বইতে শুরু করে তিস্তার জলরাশি। যে মৈষালেরা বাথান গুটিয়ে বর্ষার শুরুতে চলে গেছে নিজভূমে তারা ফিরে এসে পূর্ববর্তী স্থানেই বাথান বাঁধতে পারবেন কিনা তার পুরোটাই নির্ভর করে তিস্তাবুড়ির হালচালের ওপর। ভাদ্রমাসে সানিয়া, পূরন, আমির, বাচ্চু, ভগলু, আবদুর, ল্যাপারা প্রমাদ না গুনলেও তিস্তামায়ের চাল চলনের প্রতি সদা-সর্বদা সজাগ থাকেন। তিস্তাবুড়ি, খোয়াজপীর অথবা ঘাটোদেবীর কল্যাণে আজ পর্যন্ত অপ্রীতিকর তেমন কিছু ঘটেনি। এইতো মাত্র বছর পাঁচেক আগে বাথান থেকে মাত্র একশ মিটার দূরে তিস্তার ভাদোরিয়া ভাঙন এসে পৌঁছালে বুড়িমা ঠাকুর নিজেকে থামিয়ে নেন সেখানেই। “দাদা তিস্তাবুড়ি আমাদের মা, তিস্তা মায়ের কোলে আমরা থাকি। মা কি কখনও তার কোলের সন্তানদের ক্ষতি করতে পারে? জয়মা তিস্তাবুড়ি, জয়বাবা খোয়াজপীর”। কথাগুলি বলেছিলেন ভগলুদা তার বাথানের উঠোনে বসেই।    

ভাদ্রের বাণার জলে তিস্তা ঘেসা আমন ধানের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিঘার পর বিঘা ধানের চারা মাটি সমেত উপড়ে গিয়ে ভাসে তিস্তার জলে। চারাগাছের গোড়ার মাটি গলতে গলতে সতেজ চারাগাছগুলি নদীর পাড়ে এসে জমা হয়। ভাসমান চারাগাছগুলিকে সযত্নে তুলে নিয়ে পুনরায় তিস্তার পলিচরে রোপন করেন মৈষাল বন্ধুরা। অগ্রহায়নে ধান পাকলে সেই ধান বাথানে তোলেন মৈষাল বন্ধুরা। পাকা ধান থেকে চাল বের করে সেই চালে তৈরি হয় নতুন অন্ন। নতুন অন্ন পিতৃপুরুষদের সমর্পন করবার পর পাশাপাশি বাথানের মৈষালেরা একত্রিত হয়ে মহাসারম্বরে পালন করেন নবান্ন উৎসব। ভাদোরিয়া সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে আনন্দে মাতেন বাথান-মালিক ও মৈষাল বন্ধুরা। কিন্তু যার জমি ভেসে গেল তিস্তার জলে তার খবর কজনই বা রাখে? 

তিস্তার নাড়াভাসা জল অথবা নাড়াভাসা বৃষ্টির কথা হয়তো অনেকের জানা রয়েছে আবার অনেকেরই জানা নেই। আসলে অগ্রহায়ন পৌষে তিস্তার জলে নাড়া যেমন ভাসে, তার সাথে ভাসে সোনার ধানও। তিস্তার কিনারে কিনারে ধানচাষ করেন কৃষকেরা। ধান ছাড়িয়ে নেবার পর তারা ধান গাছের আটিগুলিকে ফেলে রাখেন জমিতেই। অগ্রহায়ন-পৌষে আকাশের জলে তিস্তা ওপরে উঠলে ধানের আটিগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ধানবিহীন আঁটিগুলি খুলে গিয়ে ভেসে ভেসে এসে জমা হয় তিস্তাচরের বিভিন্ন খুঁটে। চারদিকে আল আর মাঝখানে গর্ত বিশিষ্ট স্থানকেই বলা হয় খুঁট। অগ্রহায়ন পৌষের এই বৃষ্টির জলকেই মৈষাল বন্ধুরা বলেন নাড়াভাসা জল আর একইভাবে বৃষ্টিকে বলেন নাড়াভাসা বৃষ্টি। অনেক সময় হঠাৎ আসা এই বৃষ্টিতে জমির ওপর পাঞ্জি করে রাখা ধানও ভেসে যায়। সর্বনাশ সংগঠিত হয় কৃষক বন্ধুদের। ধানসমেত গাছ ভেসে এসে খুঁটে জমা হলে মৈষাল বন্ধুরা সেটা তুলে নিয়ে আলের ওপর রেখে শুঁকিয়ে নিতেন। তারপর বোঝা বেঁধে ঘরে তুলতেন। এভাবে জল থেকে ধান তুলে নেওয়াটা মোটেই অভাবের কারণে নয়। বাথানে চাল-ডালের অভাব তৎকালীন সময়ে এক্কেবারেই ছিল না। বরং সবকিছুতেই ছিল এলাহি আয়োজন। আসলে মৈষাল বন্ধুরা মনে মনে বিশ্বাস করতেন এবং মানতেন যে এই ধান নেহাত ভেসে আসা কোনো ধান নয় এ যে তিস্তা মায়ের আশীর্বাদ।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri