চা-ডুবুরী-১২/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি : পর্ব-১২
সুকান্ত নাহা
===============
জেগে ওঠা স্মৃতি-চরে
দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মোহনায় এসে খরস্রোতা নদীও গতি হারায়। জরা এসে গ্রাস করে তাকে। সমুদ্রে মিশে যাওয়ার আগে নদীর ব্যাকুলতা বাড়ে । তখন বিস্তির্ণ পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে ঘাটে ঘাটে জীবনের গল্প শোনায় নদী। ঘাটের পাষাণ শিলা কি সেসব গল্প শোনে? কে জানে। স্রোতের মতই জীবনও যে থেমে থাকে না। বহতা নদী উৎস থেকে বয়ে আনা স্মৃতিময় পলি দু'ধারের প্লাবনভূমিতে ফেলে রেখে তাই এগিয়ে যায় শেষ পরিণতির দিকে। সেই পলির নিচে হয়ত চাপা পড়ে থাকে কত বর্ণময় ঝিনুক, নুড়ি পাথর। কখনও বা স্বর্ণরেণুও। কেউ তার খোঁজ পায় কেউ পায় না। যারা পায় তারা স্বর্ণলাভের আশায় ছুটে আসে। তেমনই একজন হল সুবর্ণ, যে স্বর্ণরেণু বয়ে আনা সেই নদীর নির্জন সৈকতে বারবার ফিরে আসে। যে নদীর নাম সত্যপ্রিয়। যার তীরে দাঁড়ালে অতীত যেন দিগন্তের গোধূলি বেলার অস্তরাগে নানারঙে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বার্ধক্যে মানুষকে শৈশব স্মৃতি কাতর করে তোলে। আর যদি সেই স্মৃতি কেউ উস্কে দেয় তাহলে মানুষ ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। সত্যপ্রিয়র হয়েছে এখন সেই দশা। ফেলে আসা স্মৃতির চরে খননকার্যে লিপ্ত হয়েছে সুবর্ণ। আর স্মৃতি তোলপাড় করে প্রতিনিয়ত নিজেকে উজাড় করে দিতে হচ্ছে সত্যপ্রিয়কে।
অনেকদিন সুবর্ণর সাথে কথা হয়নি। ছেলেটার বাগান বন্ধ। কবে খুলবে ঠিক নেই। টেনশনে আছে। তারই মধ্যে উপন্যাসের কাজটাও করে চলেছে। গতরাতে সে নিজেই ফোন করেছিল। অনেকদিন বাদে দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বলার পর বিছানায় গিয়ে সত্যপ্রিয়র ঘুম আসছিল না কিছুতেই। স্মৃতিচারণার রেশ রয়ে গেল বহুক্ষণ। শেষে তা মিশে গেল ভোররাতের ছেঁড়াঘুম, আধোস্বপ্নে। স্বপ্নের শরীর বেয়ে নেমে এলো মামাবাড়ির 'গাছি' নাজিমুদ্দিন চাচা। যেমন করে সে নেমে আসত বড় বড় তাল, খেজুর আর নারকেল গাছের ওপর থেকে তরতর করে। গাছে চড়ার কাজ করত বলে নাজিমুদ্দিনকে সবাই বলত 'গাছি'। কাকভোরে কুুয়াশাভেজা শূণ্যক্ষেতের ভেতর দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে হেঁটে আসছিল মানুষটা। টুকরো খড়কুটো ভেজা পায়ে জড়িয়ে আলপথ ঘেঁষা খেজুরসারিকে পেছনে রেখে সে উঠে এসেছিল মোরাম বিছানো মাটির রাস্তায়। ছিপছিপে দোহারা চেহারা। থুতনিতে সামান্য দাড়ি। অত শীতেও চাচার পরণে কেবল একটা চেক লুঙ্গি আর হাতাগোটানো ফুলসার্ট। কাঁধের বাঁকে অনেকগুলো ছোট মাটির হাঁড়ি। দেখতে পেয়ে চাচা হাঁটার গতি কমিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "
'' বিহান-বিহান এইদিক কই যান ছুট-খুকাবাবু..." ।
নাজিমুদ্দিন সত্যপ্রিয়কে ছুট-খুকা অর্থাৎ ছোটখোকা বলে সম্বোধন করতেন। উত্তর না পেয়ে তিনি হন্তদন্ত হয়ে মুছে যাচ্ছিলেন ভোরকুয়াশার মাঠ ভেঙে দিগন্তের দিকে।। দাঁড়ানোর সময় নেই তার। আরো অনেক বাড়ির হাঁড়ি নামানোর কাজ যে বাকি ! ভরা হাঁড়ি নামিয়ে কাঁধের ঐ খালি হাঁড়িগুলো ঝুলিয়ে চাচা নেমে আসবে গাছ থেকে। সকাল সকাল হাঁড়ির রস বড়পাত্রে ঢেলে ছুটবে পুকুরে। সেখানে হাঁড়িগুলো ধুয়ে উপুড় করে রেখে এসে লেগে পড়বে গুড় জ্বাল করতে। উঠোনের এককোনে শুকনো খেজুরপাতা আর কাঠ দিয়ে আগুন জ্বেলে শুরু হবে গুড় তৈরির কাজ। একটু বেলায় যে রস নামানো হবে তার নাম 'ওলা'। সেই রসে তৈরি হবে ঝোলাগুড়। অপূর্ব সেই গুড়ের স্বাদ। হাঁটতে হাঁটতে চাচা যখন মিলিয়ে যাচ্ছিলেন কুয়াশার ভেতর ঠিক তখনই কেউ যেন সত্যপ্রিয়কে ডাকছিল ' সতু... সতু... সতুরে.এএএ.. কই গেলি...' মানুষটাকে দেখা না গেলেও সত্যপ্রিয় চিনতে পারে এটা মহামামার গলা। সাড়া দিতে গিয়ে স্বর বের হয় না। ডাকটা এগিয়ে আসতে থাকে কাছে। আরও কাছে। ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে যায় । বিছানায় শুয়েই সত্যপ্রিয় আভাস পান ভোর হবার আগমুহূর্তে বাইরেটা নিঝুম হয়ে আছে। শীত-ভোরের শরীর থেকে চাদরটা সরাতে নিতান্তই অনীহা দেখাচ্ছে অন্ধকার। জানালা ঘেঁষে ম্যাগনোলিয়া গাছের ডালে ডানা ঝাপটে জেগে ওঠা পাখিটা তাই অস্ফূট স্বরে যেন ভর্ৎসনা করে অন্ধকারকে।
সকাল আটটা নাগাদ সত্যপ্রিয়কে এককাপ চা দিয়ে যায় কাজের মেয়েটা। সঙ্গে ছোট একবাটি মুড়ি। বাড়িতে এসময় কেউ থাকেনা। বৌমা সকাল সাতটা নাগাদ তড়িঘড়ি অফিস ছোটে। ওপাশের ঘরে নাতনী সারাদিন হয় বইয়ে মুখ গুঁজে, নয় মোবাইলে। সারাদিন দেখা মেলে না তার। মাঝে ছোট্ট ড্রয়িংরুম। এদিকের প্রান্তিক ঘরটা সত্যপ্রিয়র। বাড়ির সামনে অযত্নলালিত ফুলের বাগান। পেছনে উঠোন। উঠোন লাগোয়া বাথরুম। ছোট হলেও বাড়িটায় প্রাণ ছিল একসময়। সর্বক্ষণ সাজানো গোছানো থাকত। ফুলবাগানে ফুটে থাকত অজস্র ফুল। সব্জি বাগানে রকমারি মরশুমী সবজি। কাবেরী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেসবের তদারকি করত মালির সাথে। কাজলিডাঙা ছেড়ে কাঞ্চনপুরে চাকরি নিয়ে চলে আসার পর অনেকগুলো বছর কেটে গেল । কত মানুষ আসত সেসময় এই কোয়ার্টার-টায়। কত বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক,কবি,সাধারণ মানুষের ভীড়ে ভরে উঠত বৈঠকখানা। তাঁদের সঙ্গে গল্পে, কথায়, তর্ক-বিতর্কে জমে উঠত আড্ডা। সেই আড্ডায় কাবেরীর সাথে ছেলেমেয়েরাও এসে যোগ দিত। দেখে মনে হত সর্বক্ষণ যেন উৎসবের মেজাজে রয়েছে বাড়িটা। বন্ধু অতীন তাই এই কোয়ার্টারটার নাম দিয়েছিল 'আনন্দধাম'। এ বাড়িতে কেউ এলে কখনও তাকে না খাইয়ে ছাড়ত না কাবেরী। ঘর জুড়ে ছিল নানান ছোটখাটো অ্যান্টিক আর সারাজীবন ধরে সংগ্রহ করা নানান মূল্যবান বই। তার মধ্যে বেশকিছু উপহার পাওয়া। বাড়ির মানুষগুলোর মত সেগুলোও কখন যেন এক এক নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে। আলমারিটায় ঘুণ ধরায় সেটা এখন ঠাঁই পেয়েছে বারান্দায়। শুধু ঝুল লেগে থাকা দেয়াল আলমারিটায় গুটিকয় বইয়ের ফাঁকে এখন ঘুণপোকাদের গেরস্থালি। যেদিন থেকে সত্যপ্রিয়র দৃষ্টিশক্তি চলে গেছে, এ বাড়িতে বই পড়ার কেউ নেই। নিস্তব্ধ মধ্যরাতে বিছানায় শুয়ে ঘুণপোকাদের একটানা কুড়কুড় শব্দ শুনতে শুনতে সত্যপ্রিয়র এখন মনে হয় বুকের ওপর দিয়ে কেউ যেন করাত চালাচ্ছে। দীর্ঘদিন মেরামতি না হওয়া জরাজীর্ণ প্রাচীন কোয়ার্টারটা দেখেও মায়া হয়। মনে হয় যেন ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে বাড়িটা। ভয় হয় এই বুঝি মাটি একটু কেঁপে উঠলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে মাথার ওপর।
সকালে এ সময়টায় খোলা জানালার ধারে কাঠের চেয়ারটায় এসে বসেন সত্যপ্রিয়। অবসরের পর এখানে বসে খবরের কাগজ আর বই পড়েই অনেকটা সময় কেটে যেত। এখন সেটাও বন্ধ। এখন শুধু পাখির ডাক, সামনের হাইওয়ে ধরে অনবরত ছুটে চলা গাড়ির আওয়াজ , কচিৎ মালিদের শুকনো পাতা ঝাঁট দেওয়া, হাঁকডাক,কোদাল চালানোর শব্দ, এসব শুনতে শুনতে বেলা গড়িয়ে চলে মন্থরগতিতে। ছোট্ট স্যাঁতসেতে ঘরটায় আলোআঁধারি ঘেরা নিস্তব্ধতার মাঝে মানসিক আনন্দ দানের একমাত্র সঙ্গী পুরনো ছোট্ট রেডিওটাই শুধু নিচুস্বরে কথা বলে যায় অবিরত। বন্ধ করতে ইচ্ছে হয় না মোটেই। মনে হয় ওটা বেজে যাক। অন্তত ওটা বাজলে মনে হয় বহু মানুষের সমাগম হয়েছে বাড়িটায়। বিচিত্র শব্দ তরঙ্গের ভীড়ে চোখবুঁজে বসে সত্যপ্রিয়র মনে হয় তাঁর শূন্য আনন্দধামে হারানো মানুষেরা সবাই যেন আবার ফিরে এসেছে ।
বাইরে প্রচন্ড শীত পড়েছে ক'দিন হল। ডুয়ার্সে বহুদিন পর এমন শীতের কামড় অনুভব করা যাচ্ছে। ঠান্ডায় জানালাটাও খোলা যাচ্ছে না মোটেই। বেলা অবধি কুয়াশায় ঢেকে থাকছে চারপাশ। এমন দিনে কাজলিডাঙায় সুনয়নী, লোহার কড়াইয়ে জ্বলন্ত কাঠকয়লা এনে ঘরে রাখতেন ঘরের গরম হবে বলে। সেসময় ডুয়ার্সে দুটি মাত্র ঋতু ছিল প্রকট। এক শীত আর একটা বর্ষা। দিনের পর দিন কুয়াশার চাদরমুড়ি দিয়ে ন্যাড়ামাথা চায়ের গাছ আর পাতাহীন ছায়াগাছগুলো ঝিম ধরে থাকত। রাস্তায় লোকজনের দেখা মিলত না। লোকে বলত ডুয়ার্সের শীতে নাকি বাঘও আস্তানা ছেড়ে বের হয়না। এ সময় চা গাছের নীচে ছেঁটে ফেলা চায়ের পরিত্যক্ত ডালপালা জড়ো করে জায়গায় জায়গায় ধুনি জ্বালতো মানুষ। আর বর্ষায় টানা সাত থেকে দশদিন নাগাড়ে হত বর্ষণ। কাপড়জামা না শুকোলে সুনয়নী বাড়ির কাজের লোক বুধরামকে দিয়ে ভেজা কাপড় বালতিতে ভরে পাঠিয়ে দিতেন ফ্যাক্টরিতে। সেখানে চা শুকনোর 'শুকলাই' ঘর বা হিটার-রুমে পেল্লায় হিটার ঘেঁষে টাঙানো থাকতো তার। তারে কাপড় মেলে দিয়ে বুধরাম বসে থাকত। ঘন্টা খানেকের ভেতর সব কাপড় শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেলে আবার নিয়ে আসত বাড়িতে।
ঘরের বাতিটা নেভানো হয়নি। লেপের নিচে বসে সত্যপ্রিয় হঠাৎ ধন্দে পড়ে যান, আজ জানুয়ারির তেরো না চোদ্দো! ঘরে একটা ক্যালেন্ডারও নেই। অন্যদিন রেডিওর প্রভাতী অনুষ্ঠানে দিনক্ষণ সব শোনা হয়। আজ কোনও কারণে মিস হয়ে গেছে । মনে মনে হিসেব কষেন সত্যপ্রিয়। গত পরশু স্বামিজীর জন্মদিন উপলক্ষে রেডিওতে কথিকা পাঠ করছিলেন একজন। তার মানে আজ চোদ্দ। তাহলে তো আজই সংক্রান্তি। পৌষ সংক্রান্তি। গঙ্গা সাগর মেলা। ঘরে ঘরে পিঠে পুলির উৎসব। বাড়িতে এইদিনে মা কত পিঠে পায়েস করতেন। ছোটকা দেশের বাড়ি থেকে নলেনগুড়, পিঠে তৈরির রকমারি মাটির সরা,ছাঁচ এসব নিয়ে আসতেন গামছায় বেঁধে। পাকঘরে কাঠের উনুন জ্বালিয়ে পিঠে তৈরি করতেন মা। তার আগে খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে উঠে তুলসী তলায় আলপনা এঁকে কলাপাতায় তিল, কদমা, কমলা দিয়ে পুজো দিতেন। মায়ের শাঁখের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত সেদিন। পরবর্তীতে কাবেরীও শাশুড়ির নিয়মগুলো যথাসাধ্য ধরে রেখেছিল। এখন আর এ বাড়িতে সে সব পাট নেই। সব উঠে গেছে।
সত্যপ্রিয়র মনে ভীড় করে আসে মামাবাড়ির কথা। এমন শীতের সকালে নাজিমুদ্দিন 'গাছি' উঠোনের এককোনে মাটির উনুনে খেজুর পাতা জ্বালিয়ে খেজুরের রস জ্বাল দিত। তৈরি হত গুড়। বাতাসে ভেসে বেড়াত খেজুর গুড়ের গন্ধ। আগের দিন বিকেলে মাটির হাঁড়ি গুলো গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে যেতেন নাজিমচাচা। অন্ধকার কুয়াশা মাখা ভোরে লুঙ্গি গুটিয়ে চাচা গাছে চড়ে পেড়ে আনতেন রসের হাঁড়ি। স্বচ্ছ , পরিস্কার সেই রসে যেন অমৃতে স্বাদ লেগে থাকত। বেলা বাড়তেই বাড়ির ছোটদের বড়মামিমা গরম রুটির সাথে সেই ঝোলাগুড় মাখিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতেন। সংক্রান্তির দিনে দুই মামি মিলে তৈরি করতেন রকমারি পিঠে-পুলি। বিধবা, নিঃসন্তান বড়মামির কথা মনে পড়ে খুব সত্যপ্রিয়র, যে তাঁকে সন্তানের মতই ভালবাসতেন। রান্না ঘরে পিঁড়ি পেতে পাতে তুলে দিতেন রকমারি পিঠে পুলি, পায়েস।
ভাবতে গিয়ে কত কথাই না ভীড় করে আসে মনে। মনে পড়ে বাড়ির সামনে চন্দনা নদী পেরিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। নদী পেরিয়ে যাওয়ার পথে পরিত্যক্ত নীলকুঠিটা চোখে পড়লে গা ছমছম করে ওঠা। মনে হত এই বুঝি কোনও সাহেব ঘোড়া ছুটিয়ে চাবুক হাতে বেরিয়ে আসবে ভেতর থেকে। কখনও নদী না পেরিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে গেলে দেখা হত মৈনুদ্দিন চাচার স্ত্রী ময়না চাচির সাথে। রোদ মাথায় করে খালি পায়ে সত্যপ্রিয়কে স্কুলে যেতে দেখলেই ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসতেন। বলতেন,
"আ'সো বাবা, আ'সো... একটু বইয়া যাও। মুখখান পুইড়া কি অইসে! "
ভেতরে নিয়ে গিয়ে মাটির বারান্দায় পাটি পেতে দিয়ে ঘামসিক্ত মুখটা মুছিয়ে দিতেন আঁচলে। তারপর কোনদিন নাড়ু-মুড়কি, কোনদিন জল-বাতাসা হাতে দিয়ে পাখার বাতাস করে দিতেন। খাওয়া হয়ে গেলে বলতেন, " যাও বাবা, অহন যাও ইস্কুলে। সাবধানে যাইও। "
মামার সাথে স্কুলে ভর্তি হতে যাওয়ার দিন পথে মৈনুদ্দিন চাচাকে প্রথম দেখা। মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, " তুমার নগে হেইডা কে ছোড়দা? " গ্রামের লোক মামাকে কেউ ছোড়দা কেউ বিশ্বাস মশায় বলে ডাকত। মামা পরিচয় দিতেই মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলেছিলেন, " চিন্তা কইরো না । আমরা হগ্গলেই তুমার আপনজন। "
এখন ভাবলে বড় অবাক লাগে সত্যপ্রিয়র, দিনে দিনে কত বদলে গেল পৃথিবী। বদলে গেল মানুষ। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির মাঝখানে আজ দেয়াল। কত অবিশ্বাস, কি ভীষণ হিংসার বাতাবরণ।
মনে পড়ে বর্ষায় দু'কুল ছাপানো চন্দনার কথা। সুবর্ণকে বর্ণনা দিতে গিয়ে গতরাতে আবার যেন নদীটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বারবার। ডুয়ার্সের নদীগুলো যেমন সারাবছর ঝিমিয়ে থাকে,বর্ষায় জল পেয়ে হয়ে ওঠে রুদ্ররূপী খরস্রোতা, চন্দনাও ছিল কতকটা তেমনই। বড় নদী গড়াইয়ের শাখা নদী ছিল চন্দনা। শীতে শীর্ণকায় নদীটাই বর্ষায় বহরে বেড়ে প্রায় আধ কিলোমিটার ছড়িয়ে পড়ত। তবে ওদিককার নদীগুলোতে জল বাড়ে ধীরে। একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে দু'কূল ছাপিয়ে যায় নিঃশব্দে। বর্ষার আগে নদীতে যেদিন প্রথম জল আসতো মহামামা সেটা কিভাবে যেন বুঝতে পারত। মহামামার আসল নাম ছিল মহাদেব। বয়সে সত্যপ্রিয়র চাইতে কিছু বড়। দূরসম্পর্কের এই ছেলেটি মামাবাড়িতেই আশ্রিত ছিল। গাট্টাগোট্টা শরীর। একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায় ছোটবেলায়। এই মহামামাই সত্যপ্রিয়কে চিনিয়েছিল পলাশপুর গ্রামের আনাচ কানাচ। নদীনালা, খালবিল। ছেলেটা এমনিতে বেশ সহজ সরল ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে বড়, হেঁয়ালি মেশানো অস্বস্তিকর কথা বলত। নদীতে জল আসাকে ও বলত 'জল-পড়া'।
-' সতু, যাইবি নাকি? গাঙে জল পড়সে। দ্যাখতে যাই চল। '
বর্ষা তখনও তেমন শুরু হয়নি। নদীর ধারে পৌঁছে সত্যপ্রিয় দেখে কোথায় কি! জল তো যেমন ছিল তেমনই!
-' কই মামা। তুমি না বললে জল পড়েছে? জল তো বাড়েনি একফোঁটা! ' ক্ষুন্ন গলায় প্রশ্ন করে সত্যপ্রিয়।
মহামামা হাসে। তারপর আঙুল তুলে চরের দিকে দেখিয়ে বলে,
' ঐ দ্যাখ, কত্ত বেনেবউ আইয়া বসছে গাঙের ধার। '
-' তাতে কী হ'ল? ' অবাক হয় সত্যপ্রিয়।
-' হেই পাখি গুলা আইলেই বুঝবি, গাঙে জল পড়সে। গাঙের গাভীন হইতে আর দেরী নাই। '
-' মানে! ' জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সত্যপ্রিয়।
মহামামার চোখেমুখে কৌতুকের ঝিলিক, ' গাভীন বুঝো না! গরু বিয়াইত্যা হইলে তারে কয় গাভীন। গাভীন হইতে গ্যালে প্যাডে জল-পড়া নাগে, বুঝছ ভাইগ্না। কয়দিন পরেই দ্যাখবি নে গাঙের প্যাড(পেট) কেমন হুইল্যা(ফুলে) উডে। 'বলে একচোখে অদ্ভূত ভাবে হেসে ওঠে মহামামা। ইংগিতের অভিমুখ আঁচ করে সত্যপ্রিয়র মুখটা আরক্ত হয়ে ওঠেছিল সেদিন।
দেখতে দেখতে কদিন বাদেই তুমুল বর্ষা এল। আর সত্যি সত্যিই গর্ভিনী হয়ে উঠল নদী। জল বাড়লেই নদীতে নৌকো নামতো। নানা আকারের নৌকা। ছোট ছিপ নৌকা থেকে শুরু করে পাল তোলা ডিঙি অবধি। লগি ঠেলা, পাল তোলা, নামানো, দিনমান মানুষজনের পারাপার - সব মিলিয়ে প্রচন্ড কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত। অঘ্রাণে ফসল কেটে আনা অবধি চলত নৌকা চলাচল।
নদী প্রসঙ্গ উঠতেই সুবর্ণ অবধারিত প্রশ্নটা করেছিল।
' ওপার বাংলায় তো শুনেছি চারদিকে খাল, বিল নদী। মাছও তো ছিল তবে প্রচুর। মাছের বিষয়ে কিছু বলুন না শুনি। পদ্মার ইলিশ তো বিখ্যাত। ইলিশ তো নিশ্চয়ই খুব খেয়েছেন। '
প্রশ্ন শুনে সত্যপ্রিয় হাসেন, 'দ্যাখো, মাছের কথা যদি বললে তো বলি, মাছ শুধু যথেষ্ট খাইইনি। দেখেওছি। এবং কীভাবে ধরা হত তাও। সে সম্পর্কে বলি। ইলিশের কথায় আমি পরে আসছি। আমার এক মাসতুতো দিদির বাড়িতে গিয়ে ইলিশের পাহাড় দেখেছিলাম। সে গল্প পরে বলছি। তার আগে বলি, আমার ছোট মামার ছিল মাছ ধরার সখ। উনি ছিলেন গ্রামের একজন মান্য ব্যক্তি। কোর্ট কাছারির কাজে সবাই মামার কাছে আসত। মামা তাদের শহরে নিয়ে গিয়ে, উকিল মোক্তারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। গ্রামের তখন ছোটখাট সমস্যা লেগেই থাকত। বিশেষ করে চরের কাজিয়া। কাজিয়ার নিস্পত্তি করতে দু পক্ষকে নিয়েই মামা ছুটতেন শহরে। পরবর্তীতে এই কাজিয়ার বিবরণ শুনতে গিয়েই মামার একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে। সেটা পরে বলব।
তো, সেই ছোটমামা বাঁশ কেটে নিজেই নানা ধরনের মাছধরার ফাঁদ বানাতেন। কোনওটার নাম 'ধোয়ার' কোনওটার নাম 'বানা', এছাড়া বল্লমের মত কোঁচ তো ছিলই। এই কোঁচ দিয়ে মামা আড়মাছ ধরতেন। রাতে বর্ষার জল যখন চুপিসারে ঢুকে পড়ত বাড়ির কাছে মুখিকচুর বনে, নানা ধরনের মাছ ভেসে আসত সেখানে। জলের তোড়ে এক দেড় কেজি ওজনের আড়মাছও ঢুকে পড়ে আটকা পড়ে যেত। এক হাতে লন্ঠন অন্যহাতে কোঁচ নিয়ে মামা যেতেন আড়-শিকারে। বর্ষায় মাঝেসাঝেই কই মাছের ঝাঁকও ভেসে এসে কানকোয় ভর দিয়ে উঠোন পার হত । ডুয়ার্সের ছেলে আমি। অমন দৃশ্য দেখিনি কখনও। আমার উচ্ছ্বাস দেখে বড়মামি বলতেন, 'ধরবি নাকি? '
আমি তো একপায়ে খাড়া। বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়তাম কই মাছ ধরতে। ধরে ধরে রাখা হত গরুর জাবনা দেয়া 'চারি'র ভেতর। পরদিন খাওয়া হত সেই মাছ।
মামাবাড়ির পাশেই ছিল সূত্রধর পল্লী। তার পাশ দিয়েই ছিল কোঠরাকান্দি খাল। খালের যোগাযোগ ছিল কিছু দূরে ব্যাঙডুবি বিলের সাথে। এই বিল ছিল পদ্ম আর শাপলায় ভরা। বর্ষায় বিলের জল ভরে খেলে তা উপচে ঢুকে পড়ত খালে।এই খাল আর বিলের সংযোগ স্থলেই মামা 'বানা' আটকে রেখে আসতেন। '
-" 'বানা' কী? " প্রশ্ন করে সুবর্ণ।
' বানা হল একটি বিশেষ ধরনের বাঁশ আর জংলি লতাপাতা দিয়ে তৈরি বেড়ার মত দেখতে। যেটা স্রোতের মুখে বসিয়ে দিলে বয়ে আসা মাছ ওতে আটকে পড়ত। ভেসে যেতে পারত না। তার মাঝখানে একটু ফাঁকা করে সেখানে বসানো হত 'ধোয়ার'।
-' সেটা আবার কী? ' সুবর্ণ জানতে চায়।
-' এদিককার আদিবাসীদের কখনও মাছ ধরতে যেতে দেখেছ? দেখবে ওরা মাছ ধরতে গেলে বাঁশের তৈরি চোঙা মাইকের মত দেখতে একধরনের ফাঁদ নিয়ে যায়। যেটাকে ওরা বলে 'কুমনি'। সেটা নদীতে পাথরের খাঁজে স্রোতের মুখে পেতে রেখে আসে ওরা। ফাঁদের চওড়া মুখ দিয়ে মাছ ঢুকে সরু মুখে আটকা পড়ে যায়। আর বের হতে পারে না। খানিকটা সেরকমই দেখতে কেবল পেটটা বেশ মোটা। এই ফাঁদটার নামই হল 'ধোয়ার'। সন্ধে নাগাদ ধোয়ার পেতে রেখে মামা চলে আসতেন। পরদিন সকালে আমাকে বলতেন, ' চল মাছ নিয়ে আসি।' গিয়ে দেখতাম কত রকম মাছ ধরা পড়েছে। বাগদা চিংড়ি থেকে শুরু করে, খলসে, পুঁটি, রায়েত বলে একধরনের পোনা মাছ,ট্যাংরা আটকা পড়ে আছে ধোয়ারে।"
" আচ্ছা, ঐ ইলিশ মাছের ব্যাপারে কী বলছিলেন যেন? " সুবর্ণ ইলিশ প্রসঙ্গ ভোলেনি দেখে সত্যপ্রিয় একটু যেন কৌতুক অনুভব করেন। তারপর উৎসাহিত হয়ে বেশ মজলিশি স্বরে বলতে থাকেন,' হ্যাঁ, শুধু ইলিশ নয়, ইলিশের পাহাড় বলতে পার। একসাথে অত ইলিশ জীবনে দেখিনি। সেবারে কদিনের জন্য দিদির বাড়িতে গেছি । দিদি থাকতেন রাজবাড়ীতে। রাজবাড়ী এখন বাংলাদেশের একটি উপজেলা। জামাইবাবু ছিলেন রাজবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক। তখন বর্ষাকাল। সকালে দিদির রেল কোয়ার্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখি সারসার গরুর গাড়ি চলেছে সামনে দিয়ে। গাড়িগুলোর পেছনটা ঢাকা। কৌতূহলী হয়ে ভাবছি কী আছে ভেতরে। জামাইবাবু অফিসে। দিদি রান্নাঘরে ব্যস্ত। কাকে জিজ্ঞেস করি ভাবছি। এমন সময় একটা গরুর গাড়ি বাড়ির গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়োয়ান গাড়ি থামিয়ে নেমে এল। হাতে একটা বড় ব্যাগ। লোকটা ভেতরে এসে সোজা পেছনের রাস্তা দিয়ে অন্দর মহলে ঢুকে গেল। তার পেছন পেছন গিয়ে দেখি কল তলায় গিয়ে সে ব্যাগটা উপুড় করে চার চারটে ইলিশ ঢেলে দিয়ে গেল। দিদি বেরিয়ে এসে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, 'তোমরা এইভাবে অ্যাতোগুলা কইরা মাছ দিয়া যাইয়ো না রোজ আমিরুদ্দিন ভাই। সায়েব কিন্তু খুব গোঁসা করেন।'
লোকটা কোনও উত্তর না দিয়ে হেসে চলে যায়। খানিক বাদে আরও কয়েকটি গাড়ি থেকে এভাবেই মাছ এল। আর মুহুর্তে কলতলা ভরে উঠল ইলিশ মাছে। চা বাগানের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের ছেলে আমি। অভাবের পরিবারে বাড়িতে কোনদিন ইলিশ মাছ আসতে দেখিনি। অত ইলিশের প্রাচূর্য দেখে আমি তো অবাক। গাড়িগুলো চলে যেতেই যখন ভাবছি অত ইলিশ খাবে কে। দেখি বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে ব্যাগে করে দিদি আশপাশের কোয়ার্টার গুলোতে বিলিয়ে দিলেন মাছগুলো। ওরা এভাবে বিনে পয়সায় কেন মাছ দিয়ে যায় প্রথমে বুঝিনি। পরে জানতে পারি ঐ গাড়ি গুলোতে করে পদ্মার ইলিশ যায় স্টেশনে।সেখান থেকে কলকাতায়। আর জামাইবাবুর হাত দিয়েই ঐ মাছগুলো বুক হত। ওঁকে খুশি করতেই তাই ঐ মাছের ভেট।
একদিন জামাইবাবুর সাথে স্টেশনে গেছি। দেখি সারসার গরুর গাড়ি করে মাছ বোঝাই হয়ে আসছে। গাড়োয়ান গাড়ি থামিয়ে গরুগুলো জোয়াল সমেত খুলে দিয়ে গাড়িটা উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে প্ল্যাটফর্মের বাইরে পাকা চত্বরে। ঢালতে ঢালতে ছোটখাটো ইলিশের পাহাড়ে পরিনত হচ্ছে যেন। বহু মানুষ ব্যস্ত হাতে কাঠের বাক্স বানাচ্ছে একপাশে। আরেক পাশে ভাঙা হচ্ছে বরফের চাঁই । আর সেই বরফ কাঠের প্যাকিং বাক্সে ঢেলে মাছ প্যাকিং হচ্ছে দ্রুততার সাথে। তারপর বাক্সগুলো জড়ো করা হচ্ছে প্লাটফর্মে। বিকেলে চিটাগাং মেল এলে বাক্সগুলো নাকি চলে যাবে কলকাতার বৈঠকখানা বাজারের আড়তে। সেবারে কত যে ইলিশ খেয়েছি সুবর্ণ,কী বলব! '
'ইলিশের কথা তো শুনলাম। আচ্ছা, ঐ কাজিয়ার কথা যেন কী বলছিলেন? ' সুবর্ণ খেইটা ধরিয়ে দেয়।
'' ওহো, ভোলোনি দেখছি, আজই শুনবে? অনেকক্ষণ তো হল। আমি নাহয় নিস্কর্মা মানুষ, তোমার তো কাজ আছে। " সত্যপ্রিয় বলেন।
" আপাতত আমারও তো সেই দশা, কাকাবাবু। কোনও কাজ নেই। যদ্দিন না বাগান খুলছে এই অবসরে ভাবছি লেখাটা শেষ করব। আপনি বলুন, অবশ্য আপনার যদি অসুবিধে না থাকে। "
" না, না। আমার তো বলতে ভালই লাগে। তবে, তার আগে একটু জানতে চাই, তোমাদের বাগান খোলার ব্যাপারে কিছু হল? " সত্যপ্রিয়র শান্ত স্বরে উৎকন্ঠা ফুটে ওঠে।
-"আগামী সপ্তাহে মিটিং ডেকেছে লেবার কমিশনার। গত দুটো মিটিংএ তো মালিকপক্ষের কেউ এলো না। এবারে সরকার তরফেও চাপ আছে। দেখা যাক কি হয়। "
কয়েক মুহুর্তের নীরবতা ভেঙে সত্যপ্রিয় বলে ওঠেন, " দ্যাখো সুবর্ণ এমন দুর্দিনে আমাকেও পড়তে হয়েছিল, যখন হঠাৎ করে কাজলিডাঙা বন্ধ হয়ে যায়। আমি জানি, এসময় মানুষের মনের অবস্থা কেমন হয়। চল্লিশ দিন বন্ধ ছিল বাগান। সেসময় আমি চুটিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করি। কম দৌড়াদৌড়ি করতে হয়নি আমাকে বাগান খোলানোর জন্য। বাগানের চারটি ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে গঠন করেছিলাম জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি। আমি ছিলাম কমিটির উপদেষ্টা। একসময় যখন বাগানের শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা হয়, টি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে, তখন ওখানকার সহকারি সম্পাদক দাসসাহেব ডেকে বললেন, সত্যবাবু, আপনাকেই কিন্তু দায়িত্ব নিতে হবে রেশন বিলি ব্যবস্থার। সে কি বলব তোমাকে, আমার কোয়ার্টারের ঘর ভর্তি তখন রেশনের চাল, গম। দিনরাত সেসবের হিসেব মেলাও আর সেই সাথে বাগান খোলানোর জন্য মিটিং মিছিল তো আছেই। খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে কেটেছিল দিনগুলো। "
-' মালিকদের এই যে বাগান বন্ধ করে দেওয়ার অস্ত্র তবে আগেও প্রয়োগ হত বলছেন। '
" হ্যাঁ, সে তো হয়েইছে। তবে এখনকার মত এত ব্যপক হারে কখনও হয়নি। বর্তমানে এমনটা কেন ঘটছে তার বেশ কিছু কারণও রয়েছে। চা-বাগানের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস থেকে শুরু করে আজকের এই যে ' লক-আউট' এর সংস্কৃতি, এ এক সুদীর্ঘ আলোচনার বিষয়। আরেকদিন নাহয় সেসব আলোচনা করব। '
-' সেই ভাল, অনেক রাত হল। আপনি বরং ঐ একটু 'কাজিয়া ' বিষয়টা বলে শেষ করুন" ।
-' বেশ। কাজিয়া মানে ঝগড়া বা লড়াই বলতে পার। দখলের লড়াই। সম্পত্তি রক্ষা বা বিস্তারের জন্য পেশীশক্তির প্রয়োগ। আর যার উৎস বিন্দু হল মানুষের ষড়রিপুর অন্যতম, লোভ। বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় তা তো জানই। নদী তার চলার পথে অভিমুখ বদলে ফেললে জেগে ওঠে চর। নদীর ধারে প্রায়শই এমন জেগে উঠত চর। চরের মাটিতে ফসল ফলে প্রচুর। তাই তা দখলের জন্য শুরু হত মানুষে মানুষে লড়াই। কখনও পরিত্যক্ত চরদখল নিয়েও কাজিয়া হত। আমার মামাবাড়ির গ্রামেও হামেশাই এমন কাজিয়া লেগে থাকত। আর তা নিস্পত্তি করতে দুইপক্ষ দ্বারস্থ হত আমার মামার। মামা তাদের নিয়ে শহরে যেতেন। সেখানে আদালতে উকিল ডেকে কখনও কোর্টের বাইরেই মিটমাট হত। কখনও কেস ফাইল হলে চলত বহুদিন। "
এটুকু বলে সত্যপ্রিয় থেমে যেতেই সুবর্ণ ধরিয়ে দেয়,' বুঝলাম। কিন্তু আপনার মামার কি একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলছিলেন...'
' ও হ্যাঁ, ' বলে সত্যপ্রিয় বলতে থাকেন, " একদিন ফজলুল বলে একজন এসেছে মামার কাছে। বাইরের লোক কেউ এলে তাদের বসানো হত উঠোনের একপাশে পাকা ঘরটায়। সেখানে বসেই মামা লোকজনের কথা শুনতেন। ফজলুল এসে বসেছে সেই ঘরে। হাতে তার একটা খেটো লাঠি। সেসময় গ্রামের মুরুব্বি গোছের মানুষরা কেউ কেউ হাতে লাঠি নিয়ে চলাচল করতেন। মামা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ' ফজলুল তোরা যে কাজিয়া করিস, কিভাবে লড়াই টা শুরু হয় বলত একটু।' ফজলুল উঠে দাঁড়িয়ে অভিনয়ের ঢঙে ডেমোনেস্ট্রেশন দিতে থাকে কিভাবে তারা একহাতে বাঁশের তৈরী ঢাল অন্যহাতে একটি বল্লম, আর পায়ের দু আঙুলের ফাঁকে আরেকটি বল্লম চেপে ধরে ব্যাঙলাফ দিতে দিতে এগোয় প্রতিপক্ষের দিকে। দু'পায়ের আঙুলে কিভাবে বল্লম চেপে নেয় তা বোঝাতে সে লাঠিটা পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে গুঁজে নিয়ে সে উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে ,' হালারা আউগাইতে আউগাইতে যেই না নাগুড়ের(নাগাল) ভিতর আইয়া পড়বেনে এই র'ম কইরা দি-ই হালাগোর দিকে ছুইড়্যা। ' বলে উত্তেজনার বশে সাঁ করে পায়ের লাঠিটা ছুঁড়ে দেয়। আর অসতর্কতায় সেটা গিয়ে আঘাত করে মামার পায়ে। মামা চিৎকার করে পা ধরে বসে পড়েন। আর ঘোর কাটতেই ফজলুল ছুটে এসে মামার পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ে। তারপর তার সেকি কান্না। কাঁদছে আর বলছে,' হায় হায়, এ-কি করলাম ছোড়দা। আমি বুঝবার পারি নাই। আমারে ক্ষমা কইরা দ্যান... আমার নাইগ্যা আপনের কি সব্বোনাশ অইলো।"
সেই আঘাতই পরে মামাকে কাবু করে ফেলেছিল। এদেশে ফিরে আসার পর আর মামাকে দেখিনি। একদিন চিঠি পেলাম মামা আর নেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴