গঞ্জহাটের আখ্যান-১২/সুবীর সরকার
গঞ্জহাটের আখ্যান-১২
সুবীর সরকার
-------------------------------
৪০.
চর কালপানি দিয়ে মন্থর লয়ে ছুটতে শুরু করে মজনু শাহের ঘোড়াটি।বাদামি কেশর।নিভৃত আর মায়াময় চক্ষুদ্বয়।মজনু তার এই ঘোড়াটি কিনেছিল ছত্রশালের হাটে।বিবি ফুলজান ঘোড়াটির নাম রেখেছে সুমি।এই ঘোড়া নিয়ে,ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ধান পাট তামাক নিয়ে এক হাট থেকে আরো আরো দূরে কাছের হাটগুলোতে ঘুরে বেড়ায় মজনু।মজনু শাহ।ভালো বাঁশি বাজাতে পারে বলে লোকমুখে তার নাম মজনু মাস্টার।ধুবুরি শহরের এক কবি মজনু আর তার ঘোড়াটিকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিল।সেই থেকে গঞ্জ হাটে মজনুর বেশ কদর।খাতিরদারি।
মাঝে মাঝে মজনু মনের সুখে ফাঁকা রাস্তায় সুমিকে ছোটাতে ছোটাতে গলা ছেড়ে গান ধরে_
"আরে চলে রে মোর ঘোড়ার গাড়ি রে
কাদো পন্থ দিয়া
আরে নওদারি নাইওরি গুলা
দেখি থাকে চায়া রে"
আমরা দেখি মস্ত এক আবছায়ার ভিতর লীন হয়ে যাচ্ছে মজনু শাহের ঘোড়াটি।
৪১.
শুকনো চরের বালু শরীর জুড়ে লেগে থাকা মরিচ বেচা পাইকার, রেডিও বাজাতে বাজাতে কিংবা বলা ভালো রেডিওতে গোয়ালপাড়ার গান শুনতে শুনতে এই প্রাক সন্ধ্যেতে কোন এক হাট থেকে ফিরতে ফিরতে বারবার কেন জানি আনমনা হয়েই পড়ছিল!
এই কুড়ি পঁচিশ মাইল পরিধি জুড়ে তার পরিচিতি মরিচ বেচা পাইকার।আবার পাইকারের রেডিও প্রীতির কারণে সম্প্রতি অনেকেই তাকে "রেডিও বাজা পাইকার" বলেও ডাকতে শুরু করেছে।প্রায় তিন কুড়ি বছর ধরে তার কাজ মরিচের পাইকারি।তার বাবা,বাবার বাবা সকলেই ছিল মরিচের পাইকার।সেই কবে যে সে তার আসল নাম নিজেই ভুলে গেছে তার কোন ঠায় ঠিকানা নাই!আচ্ছা,এই সব বিস্মরণ কি তাকে আনমনা করে দিয়েছে!
এইসব ভাবতে ভাবতে পাইকার তার অন্যমনস্কতা আর রেডিও সমেত গঙ্গাধরের ফেরিঘাটে এসে পৌঁছান।আর শুরু হয় ঘাটোয়ালের সাথে কিঞ্চিৎ হাসিমস্করা।তখন রেডিওতে বেজে উঠেছে আব্দুল জব্বারের গান_
"চাষার মুখত আর
নাইরে সেই গান"
৪২.
ধান পান গুয়া কলাগাছের পৃথিবীতে বেশ কেটে যায় মানুষের জীবন।গদাধর আর গঙ্গাধরের তাগড়াই মাঝিরা মাঝে মাঝে বাইচের নাও ভাষায়।তখন নদী জুড়ে তীব্র এক হুল্লোড়।গমগম গমগম শব্দের কোরাস।দু পারে সারি বেঁধে দাড়িয়ে থাকা সহজ সরল আমোদপ্রিয় মানুষেরা মেতে ওঠে বাইচ খেলার গানের সুরের মাদকতায়_
"আরে হাউসের মেলা বাইচ খেলা
গদাধরের কাছারে
ও রে ইয়াকুব ভাইয়ের
নাও ফাইনালে"
জীবন জীবনের মতন।মরণঘেরা জন্মঘেরা হাসি আর কান্নার।জীবনের পর জীবন কেটে যায়।চাঁদের রাত পেরিয়ে মজনুর ঘোড়াটি সারারাত হেঁটে হেঁটে চলে আসে গঙ্গাধরের উজানে।সেখানে তখন ভোরের আলো আর বাতাসের ভেতর মুনসি করিমের কয়েকশো "বাথানের মহিষ" ব্যপ্ত এক সিলুয়েট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মজনুর ঘোড়াটি,বলা ভালো মজনু মাস্টারের ঘোড়াটি তখন কিছুটা দ্বিধা নিয়েই মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে থাকে আরো আরো চাঁদের রাতের দিকে। সে এক মস্ত পর্যটনের মতন হয়তো বা!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴