কুকীজ/শুক্লা রায়
কুকীজ
শুক্লা রায়
ভাঙা চালা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে আমরা ক'জন দাঁড়িয়ে গেলাম। ভেতরে এক খুনখুনে বুড়ি উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে কিছু একটা রান্না করছে। পেট খিদেয় মোচড় দিচ্ছে। সুতরাং সবাই মিলে ঢুকে পড়লাম। ভাঙাচোরা তাকের মধ্যে কয়েকটা কাচের বয়াম রাখা। বেশিরভাগ বয়ামই ফাঁকা। একটা বয়ামে ক'খানা বিস্কুট আর একটাতে কুকীজ। আমরা আসলে ইঁট-ভাঁটায় কাজ করা শ্রমিক। বর্ষাকালে ভাটাখানা বন্ধ থাকায় ভুটানে গিয়েছি কাজের সন্ধানে। ওখানেও সবার কাজ জুটল না। কয়েকজন সেজন্য ফিরে আসছি। পরেরবার হবে এই আশ্বাসবানীটুকুই শুধু সঙ্গে আছে, এই যা সান্ত্বনা। ভেতরে ঢুকে দেখি দোকানের অবস্থা সত্যিই শোচনীয়। বসার জায়গাটাও ভাঙাচোরা। "বুড়িমা, চা হবে? চায়ের সঙ্গে কী হবে? রুটি হবে?"
বুড়ির চালসে পড়া চোখে খুশি ও দুঃখ একসঙ্গে খেলা করে গেল। চা হবে। রুটি করতে পারবে না, আটা নেই। তাই সই। আমরা নিজেদের মতো গল্প করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সবাই চিন্তিত। যাওয়ার সময় অনেকেই টাকা ধার করে গিয়েছি। কাজে ঢুকলে ফেরত দেব এসে। তা তো হল না। কী যে হবে। আমাদের মধ্যে দীনেশ বাড়ির গরুটাকে বিক্রি করে এসেছে। টাকা-পয়সা তো যাতায়াত আর ওখানে খাওয়ার খরচে প্রায় শেষ। বাড়ির লোক তো ভাবছে আমরা কাজে ঢুকেছি। অথচ খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। তাও ফেরার সময় ট্রাক ড্রাইভারটা খুব বেশি ভাড়া নিল না। আমাদের জামাকাপড় আর চেহারা দেখেই বুঝেছে, কাজের খোঁজে গিয়েছি। নামিয়ে দিল একটা ফাঁকা রাস্তার মোড়ে। বলে দিয়েছে সামনে এগোলেই আর একটা মোড় পাব। সেখান থেকে গাড়ি ধরলে বীরপাড়া। মোড়ের খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে এই বুড়ির দোকান।
বুড়ির অশক্ত শরীরে কাজের ভার দেখে আমাদেরই কষ্ট হচ্ছিল। আলাপ জমালাম। দোকান লাগোয়া ঝুপড়ি দেখিয়ে বুড়ি বলল ওটাই ওর ঘর। ভেতরে তাকালাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সেখান থেকে কাশির আওঞোআজ আসছে। বুড়ির বুড়ো কাশছে। ক'দিন থেকেই জ্বর আর কাশি। নইলে দোকান দুজনেই করত। আগে খুব চললেও এখন আর চলে না। একটু সামনে এগিয়ে একটা ভালো চায়ের দোকান হয়েছে। সেখানেই সবাই যায়। সেজন্য এখন দোকানে জিনিসপত্র রাখাও কমিয়ে দিয়েছে। বিক্রি নাই! দোকানটার দিকে একঝলক তাকালেই সেটা বেশ বোঝা যায়। "বুড়িমা তোমার ছেলে নাই গো?"
বুড়ি একটু থমকে গেল। দুর্বল শরীরেও যে মানুষটা এতক্ষণ অর্নগল কথা বলছিল সে মানুষটা হঠাৎ কেমন নিভে গেল। একটা নিঃশ্বাস নেমে এল ধীরে ধীরে। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, "ছিল। কিন্তু ভাগ্যে নেই। ছেলেটা গাড়ি চাপা পড়ে চলে গেল হঠাৎ। ও থাকলে কী আর আমাদের এই বয়সে পেটের চিন্তা করতে হত? পায়ের উপর পা দিয়ে বসে খেতাম।"
উপস্থিত সবার মনখারাপ হয়ে গেল। কেউ একজন জিজ্ঞেস করল ক্ষতিপূরণ দিয়েছে? বুড়ি বলল, "কে দেবে ক্ষতিপূরণ। তখন ছেলের শোকে আমরা পাগল হয়ে গেছি রে বাবারা। তখন টাকা-পয়সার কথা মাথায় ছিল না। আজকে ছেলেটা বেঁচে থাকলে এই তোমাদের বয়সীই হত। বিয়ে করাতাম। বৌ আসত। আর আমরা বুড়ো-বুড়ি আরাম করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতাম।" বুড়িটার কথাগুলো যেন বুকে আঘাত করছিল। বুকটা কেঁপে উঠল। মা মারা যাওয়ার একবছরও হয়নি এখনও। মরার সময় চিনি দেওয়া লাল চায়ে কুকীজ ভিজিয়ে খেতে চেয়েছিল। সামান্যই আব্দার। সেটুকুও পায়নি। অসুস্থ দেখেও সেদিন শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম রোয়া বোনার কাজে সাহায্য করতে। ছোট শ্যালকের শরীর খারাপ ছিল। ও বাড়ি থেকে খবর পাঠিয়েছিল যাওয়ার জন্য। মা ডেকে বারবার বলেছিল, "বাবারে, একটা জ্বরের ট্যাবলেট এনে দিয়ে যা।" গা করিনি। গরমকালের জ্বর, এমনিই সারে। ফিরে আসতে আসতে সব শেষ। মুখাগ্নী করতে গিয়ে আগুন যেন নিজের বুকেও লাগছিল সেদিন। মাসির বাড়ি কাছেই। মুখ কালো করে বলেছিল, "আজকাল ব্যাটার বিয়ে দিতে না দিতেই ব্যাটা দেখি পরের হয়ে যায়। আমারও একটা আছে। মরার সময় জলটাও মুখে পাব কিনা সন্দ।" তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, "ব্যটার জন্ম দিয়ে কী লাভ, বুড়া কালে যদি না-ই দেখে। লোকে খালি ছেলে ছেলে করে। বাবারে, তোরও তো ছেলে আছে। তোর ছেলে তোর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে দেখিস। দেখছে তো। দেখে দেখেই না শিখবে।"
জ্বরের মুখে লাল চা দিয়ে একটা কুকীজ খাওয়ার জন্য হেদিয়ে মরছিল বুড়িটা। মা শোনে না দেখে আমার ছোট ছেলেটা পরেরদিন দৌড়ে গিয়ে আমার মাসিকে খবর দিয়েছিল। বাচ্চা মানুষ। প্রাণে দয়ামায়াটা বেশিই আছে। ওর ছোট ঠাকুমা শুনে যখন কুকীজ নিয়ে এসেছে ততক্ষণে জ্বরের ঘোরে বুড়ি অজ্ঞান। মাথায় জল দিয়ে ভ্যানে তুলে ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে মাঝপথেই শেষ। আমার বৌ বাড়ির কাজ আর গরু ছাগল নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে দেখার সময় পায়নি বুড়িকে।
"বাবা, এই নাও, চা নাও।" বুড়ির ডাকে চমকে উঠি। দুঃখের ছাপ তখনো চোখে লেগে থাকলেও, বুড়ি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। ভালো করে তাকালাম। এক হাতে চা, এক হাতে কাগজে মোড়ানো একটা কুকীজ ধরা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴