উত্তরবঙ্গের পত্রপত্রিকা : এক অনুসন্ধান-১১/অভিজিৎ দাশ
উত্তরবঙ্গের পত্র-পত্রিকা : এক অনুসন্ধান/১১
অভিজিৎ দাশ
দৃশ্যমুখ
"সৃজনশীলতাই একজন লেখকের ধর্ম। কিন্তু লেখার একটি অভ্যেস তৈরি হলে এবং নিয়মিত চর্চায় ক্ষেত্রটি দীর্ঘায়িত হলে স্বভাবতই একটি পত্রিকা প্রকাশের অদম্য তাগিদ মনের ভেতর অনুভূত হয়। আর তখন জন্ম হয় এক-একজন সম্পাদকের। 'দৃশ্যমুখে'র সম্পাদক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা ঠিক সেরকমই। শব্দের সঙ্গে নেহাত খেলাচ্ছলে বা নিজস্ব মনোজগতের আড়াল তৈরির অভিপ্রায়ে যার কবিতা লেখা শুরু ১৯৭৮ সাল থেকে, সে আরও এক গুরুদায়িত্ব নেয় ঘাড়ে ১৯৯১ সালে। অবশ্য এর বেশ কিছু দিন আগে 'চেতনা' নামে একটি পত্রিকার যথাক্রমে সহ-সম্পাদক ও পরবর্তীতে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। তবে সাহিত্য ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র হওয়ার মানসিকতা এবং পত্রিকাকে তালিকাভুক্তকরণের জন্যই 'দৃশ্যমুখে'র উজ্জ্বল প্রকাশ। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে এমনই লিখেছিলাম। 'যুক্তিনির্ভর পরিবর্তনশীলতা, পরিবর্তিত সাহিত্য পরিবেশ ও প্রত্যয় এবং মার্জিত রুচির প্রশ্ন স্বভাবতই এই মুহূর্তে হানা দেয়। এসবেরই অবিচ্ছিন্ন ও পূর্বপরিকল্পিত রূপ 'দৃশ্যমুখ'।"
দৃশ্যমুখে'র সম্পাদক আলিপুরদুয়ার সারদাপল্লীর উত্তম চৌধুরীর কলমে পত্রিকা শুরুর পেছনের কাহিনি এভাবেই ভাস্বর হয়ে ওঠে। দস্তুরমতো সম্পাদনার অভিজ্ঞতা নিয়েই 'দৃশ্যমুখে'র সূচনা। উত্তম চৌধুরী আরো দুটি পত্রিকা 'নোনাই' এবং 'মাদলে'র সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সম্পাদনার ক্ষেত্রে 'দৃশ্যমুখে'র পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় বেণু দত্তরায়, সমীর চক্রবর্তী, হরেন ঘোষ, সুধাংশু কর্মকার, তুষার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ তাদের মনের মাধুরী মেশানো লেখা পাঠিয়েছেন। তখন আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি হয়নি। ফলে লিনোকাট বা মেটাল ব্লক ছিল ছবি, নকশা বা হাতে লেখা নামাঙ্কন ছাপানোর উপায়। তাও মেটাল ব্লক সব জায়গায় তৈরি হত না এবং লিনোকাট সবাই করতে পেত না। 'দৃশ্যমুখে'র প্রথম তাই শিলিগুড়ি থেকে ছাপিয়ে আনা হয়েছিল।
লিটল ম্যাগাজিনের আর্থিক সংকট একটি বড়ো সংকট। পকেটের অর্থ খরচ করে নিয়মিতভাবে পত্রিকা বের করা কঠিন হয়। এই পত্রিকার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
বিজ্ঞাপনে ভরসা করে লাভ হয়নি। বিজ্ঞাপন চাইতে গেলে অনেকেই মাছি তাড়ানোর মতো করেছেন। তাই দু'বছর পত্রিকা বন্ধ ছিল। অথচ অনেকেই জানতে চায়, "পত্রিকা থেকে কেমন আয় হয়"।
তাই ১৯৯২-এ দ্বিতীয় সংখ্যার পর ১৯৯৫-তে তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যার লেখক তালিকাটিতে অন্যান্যদের সাথে ছিলেন কেদার ভাদুড়ী, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, কমল চক্রবর্তী, দেবী রায়, ভাস্বতী রায়চৌধুরী, অরুনেশ ঘোষ প্রমুখ। অর্ধেন্দু চক্রবর্তী সম্পাদককে লিখেছিলেন, "লজ্জা কেন? লেখা ছেপেছেন এতেই আমি কৃতজ্ঞ। ছোটো কাগজের কত সমস্যা তা যদি না বুঝি তাহলে তো নিজেকে অপরাধী মনে হবে।" গুণীজনের এরকম উৎসাহ দৃশ্যমুখের চলার পথের পাথেয় হয়েছে।
বন্ধুর পথ পেরিয়ে ৩৩ বছর ধরে 'দৃশ্যমুখ' আজও প্রকাশনার গর্ভে উজ্জ্বল। বিশেষ করে কবিতা ও অণুগল্পের ক্ষেত্রে এর গর্বিত সঞ্চালনা আজও সমুজ্জ্বল। আমন্ত্রিতরা যেমন লেখা পাঠিয়েছেন তেমনি আমন্ত্রণ ছাড়াই অনেক ভালো ভালো লেখা এসেছে। সেগুলি নির্বাচন, ছাপতে দেওয়া, অলংকরণ, প্রচ্ছদ নির্মাণ, প্রেসে তাগাদা দেওয়া, ছাপার পর প্রকাশ করা, লেখকদের পত্রিকা বিলি, প্যাকিং-- সম্পাদক সব কাজ প্রায় একার হাতেই করেছেন এবং করে চলেছেন। তবু এর মধ্যে কিছু বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করেছেন তিনি। ১৯৯৮-তে অনুবাদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। দেশ-বিদেশের কবিতার অনুবাদে ভরে উঠেছিল এ সংখ্যা। উইলিয়াম ব্লেক, আলেকজান্ডার পুশকিন, লেডিজ ল্যারিসা ভেসিলেভার লেখার অনুবাদও ছিল। আঞ্চলিক ভাষার কবিতা সংখ্যা, সহস্রাব্দ সংখ্যা, জীবনানন্দ দাশ সংখ্যা বিশেষ সংখ্যার সরণিতে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
এছাড়াও 'দৃশ্যমুখ' একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। ১০০ জন কবির কবিতার সম্ভারে সজ্জিত হয়ে 'দৃশ্যমুখ কবিতা সংকলন' গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে। উত্তরের কয়েকজন কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার কৃতিত্ব দৃশ্যমুখ সম্পাদকের ঝুলিতে আছে।
সম্পাদক নিজে একজন কবি। তিনি অনুগল্পেরও যশস্বী লেখক। তিনি 'দৃশ্যমুখ'কে সবসময় রুচিশীল এবং প্রকৃত সাহিত্যের কাগজ হিসেবে হাজির করার কাজে সচেষ্ট থেকেছেন এবং এখনও সেই সক্রিয়তায় শৈথিল্য দেখা যায়নি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
