ইষ্টিকুটুমে চিকরাশি সহজ উঠোনের সাহিত্যের চড়ুইভাতি
ইষ্টিকুটুমে চিকরাশি সহজ উঠোনের সাহিত্যের চড়ুইভাতি
অমিত কুমার দে
=======================================
নামটা দিয়ে নিজেরই মজা হচ্ছিল! এমনও হয় নাকি! ‘সাহিত্যের চড়ুইভাতি’!! সাহিত্য আবার চড়ুইভাতিতে যায় কি? চিকরাশি ও সহজ উঠোনের সম্পাদক নিজেই গোলকধাঁধায়! তবে নামটা তো দিয়ে ফেলা গেল!!
প্রায় দেড়টা দিনের বেলা ও দু’খানা আস্ত রাত ঊনত্রিশ জন মানুষ একসঙ্গে কাটিয়ে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল – চিরন্তন সাহিত্যই কূটকচালির বাইরে গিয়ে তার প্রিয়জনদের নিয়ে, আর আবছা রোদ অঢেল কুয়াশা রহস্য-রাত শিশিরভেজা চা-বাগিচা মায়াবী শীতের নদী পাখিদের অনর্গল কথাবলা এবং অনেক সব নিরুচ্চার নিয়ে একটা চড়ুইভাতিই করে ফেলল! সাহিত্যই মুখ্য হয়ে থাকল সেখানে।
চোদ্দ জানুয়ারি তেইশ নিমতি মোড় থেকে পাটকাপাড়ার দিকে ঘুরে আমরা চিকরাশি টিম বেলা একটা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছিলাম, সব আয়োজন ঠিকঠাক দেখে নেবার জন্য। ইষ্টিকুটুম খামারবাড়ির মালিক সুব্রত কুন্ডুও চলে এলেন, গাড়িভর্তি নানান শাকসব্জি মাছমাংস বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং বুকভর্তি এক আকাশ আতিথেয়তা নিয়ে। কাকে কোন ঘরে দেব ফাইনালি দেখে নিলাম। ঘরে ঘরে ঢুকে দেখি সব নিপাট সাজানো গোছানো।
এটাও বলা দরকার – সুব্রত দুপুরেও কোনো ফাঁক রাখেননি। অতিকায় আকৃতির সরপুটি মাছ, দুরন্ত ডাল, রাইশাক-ভাজা ইত্যাদি দিয়ে আমাদের ক’জনাকে খেতে বসালেন। এবং জানালেন রাত থেকে আরো ভালো হবে। খেতে খেতে ভাবছিলাম – এর থেকেও ভালো আরো কিছু হয় নাকি!
এই আয়োজনটি মাথায় আসার পর একটা Whats App Group খুলে সহজ উঠোনের সক্রিয় সদস্যদের জানানো হয়েছিল। তারপর তারিখ নিয়ে অনেক দোলাচল। এ বলছেন এ তারিখে পারব না, ও বলছেন ও তারিখে পারব না। অনেকে ‘যাব কি যাব না’ বলে বলে ঝুলিয়ে রাখলেন! এমন একটা সময় এলো, মনে হল ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’! কিন্তু এ বান্দা কোনও কিছুই ছেড়ে পিছিয়ে আসার মানুষ নন। তাই শেষে স্থির করলাম – পাঁচ জন হলেও হবে! চূড়ান্ত করলাম – তেইশের চোদ্দ জানুয়ারি বিকেল থেকে ষোল জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত চলবে আমাদের সাহিত্য পর্যটন, একসঙ্গে থেকে।
বিকেল থেকে একে একে সবাই পৌঁছতে লাগলেন। পঁচাত্তরের তরুণী চিত্রা পাল এসেই ছুটে উঠে পড়লেন দোলনায়। সমবয়সী তরুণ প্রশান্ত নাথ চৌধুরী এক নিমেষে সব আপন করে নিলেন। দুই পঁচাত্তরকে দোলনায় দুলিয়ে শুরু হল এই চড়ুইভাতি। দোলনা ঠেলতে ঠেলতে জীবনকে তখন অন্য রঙে দেখছে তাদের কন্যাতুল্যা পপি ও শুক্লা। উৎসাহ দিয়ে চলেছেন বাহাত্তরের যুবতী বেলা দে। তিনিও মহা উৎসাহে দোলনায় উঠলেন। পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মিঠে গলায় গেয়ে উঠলেন “দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা...”।
সন্ধ্যায় আমাদের ডর্মিটরিতে শুরু হল সাহিত্যের ঘরোয়া আসর। বেলুন ফুলিয়ে, ফ্লেক্স টাঙিয়ে, চেয়ারগুলোকে রঙিন জামা পরিয়ে ঘরটা আমরা সাজিয়েছিলাম। সাজাতে সাজাতে ছোট্টবেলার কত কত অনুষ্ঠানের স্মৃতি মনে পড়ছিল। সেই সরস্বতী পুজোর মন্ডপ সাজানো, গ্রামের অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজানো ইত্যাদি ইত্যাদি। কত যুগ পর বেলুন ফোলালাম! একটা নস্টালজিক আলোছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল ভেতরে। অধ্যাপক বিপ্লব রায় বেলুনে সুতো বাঁধার কায়দা শেখাচ্ছেন, পপি-শুক্লা ফোলাতে ফোলাতে বলছে “গাল ব্যথা করছে!”
ইতিমধ্যে ফোনে জানলাম, বাসযাত্রার দীর্ঘ ধকল পেরিয়ে নিমতি মোড়ে নেমে মুক্তিদির হাঁটু লক! হাঁটতে পারছেন না। গাড়ি নিয়ে ছুটলাম। মুক্তি চন্দ-র কন্ঠের সঙ্গে আমার পুরো কৈশোর তরুণ-যুবকবেলা জড়ানো। “আকাশবাণী শিলিগুড়ি” বলে তিনি যেই কোনও ঘোষণা বা অনুষ্ঠান শুরু করতেন, আমি অবশ হয়ে শুনতাম। আমার স্বপ্নের মানুষটি সপরিবারে চিকরাশির পাগলামিতে সাড়া দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হয়! সন্ধ্যা মাখতে মাখতে ইষ্টিকুটুমে এলেন মুক্তি চন্দ, অতনু চন্দ ও অনুরিমা চন্দ (মোহর)। এসেই খুশি, শরীরের কষ্ট তাঁর নিমেষে উধাও!
প্রশান্তদা, প্রশান্ত নাথ চৌধুরী, কবিতা পড়তে এলেন। বললেন – “এই পঁচাত্তর বছরের জীবনে এই প্রথম কোনও সাহিত্যবাসরে আমি কবিতা পড়ছি!” এই মানুষটি কী নিবিড়ভাবে সবাইকে নিমেষে আপন করে নিয়েছিলেন – আমরা অভিভূত।
ও, একটা কথা জানানো দরকার। ঘরে সবার জন্য চেয়ার পাতা হলেও অনেকেই উঠে জাঁকিয়ে বসলেন বিছানায়। প্রায় আট জন শোয়ার ঢালাও বিছানা, যেন বিছানার মাঠ! বেলা দে, চিত্রা পাল কী ভালোবেসে জীবন ছোঁয়া কবিতা পড়লেন। প্রিয় কবি উত্তম চৌধুরী তাঁর নিজের উদ্ভাবন ‘দশপদী কবিতা’ পড়লেন নিবিষ্ট মনে। আমরা আচ্ছন্ন। ফ্রেশ হয়ে চন্দ পরিবার অনুষ্ঠানের ঘরে ঢুকলেন। মুক্তিদির নির্দেশ – সবাই নিজের মতো করে নিজেদের পরিচয় দিন। তাই হল! সন্ধ্যা গাঢ় হতে হতে সবাই এসে হাজির। মুক্তিদি যেন এই আসরের অঘোষিত সভাপতি! সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে কী সুন্দর করে নিজেদের কথা বলে গেলেন। উঠে এল কত জীবনযুদ্ধের ইতিবৃত্ত। আর সেই কথার আড্ডায় কখন রাত্রি ঘনিয়ে এল! মাঝে চা ফুলের পকোড়া, মুড়ি-চানাচুর, চা। পপি যত্ন করে পরিবেশন করলেন। বৃন্দাবন বাড়ুই অস্ফুটে বললেন – “ঠিক মায়ের মতো!”
শিশির রায়নাথ আসার পথে মুঠোফোনেই বায়না করেছেন – রাইশাক আর বেগুনপোড়া চাই! সুব্রত-র কানে সেই আব্দারের কথা তুলে দিতেই সাত কিলোমিটার দূরে গ্রামে গিয়ে নিয়ে এসেছেন টাটকা রাইশাক। পরদিন দুপুরে রান্না হবে। রাতে হল বেগুনপোড়া, তাঁর ক্ষেতের থেকে বিকেলে তোলা তরতাজা বেগুন, শীতের রাতে এর আমেজই আলাদা। ভাত/রুটি, ফুলকপির তরকারি, পনীর, চিকেন কষা। এবং খেতে খেতেও বিস্তর আড্ডা।
চার বিচিত্রবয়সী অবাধ্য বালক অনেক ঘুরে-ফিরে একটু বিলম্বেই হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু এসেই সবার সঙ্গে পরমাত্মীয়। একসময় তাঁর কবিতা সবাইকে চমকে দিত, তারপর হঠাৎ কবিতার ভুবন থেকে নিরুদ্দেশ। সদ্য ফিরে এলেন মহা জৌলুসে! লেখা, পাঠ, পর্যটন সবেতেই এক আলাদা ঘরানা শিশির রায়নাথ। ভাস্কর মৈনাক ভট্টাচার্য এসেছেন, লেখাতেও যিনি ভাস্কর্য তৈরি করে ফেলেন। বিমল দেবনাথ সহজ উঠোনের একান্ত প্রাণের জন, এখানেই উত্তরের অরণ্য নিয়ে ধারাবাহিক উপন্যাস ‘শালসিঁড়ি’ লেখার সূত্রে চিরদিনের মতো জড়িয়ে গেছেন সাহিত্যে। আর টগবগে মনোজ পাইন, বুক খুলে ‘দাদা’ বলে ডাকে, বড্ড ভালো কবিতা লেখে। এসে তাঁর প্রতিবাদ “আমাকে কেন আমাদের টিম থেকে আলাদা করা হল?” শিশিরদা-মৈনাকবাবু-বিমলবাবু ‘বুলবুলি’ নামের ঘরটায়, আর মনোজকে পাঠানো হয়েছে ‘মুনিয়া’য়, সুকান্ত নাহা, উত্তম চৌধুরী, সুধাংশু বিশ্বাস-এর সঙ্গে! গায়ে হাত দিয়ে আদর করে বিস্তর বোঝানো হল – “পাশাপাশিই ঘরদুটো তো! যতক্ষণ খুশি গিয়ে আড্ডা দাও!” যাই হোক, শান্ত হল কবি মনোজ, বাঁকুড়ার ছেলে – কিন্তু অন্তরে ডুয়ার্স মেখে আছে বেশ!
আর একটা পাপও করা হল! নাট্যকার-অভিনেতা সুধাংশু বিশ্বাস এসেছেন সহধর্মিনী পম্পাকে নিয়ে। পম্পাকে বরের কাছ থেকে তুলে নিয়ে রাখা হল মীনাক্ষী ঘোষ, মিশা ঘোষাল, ড. সাগরিকা দত্ত, কৃষ্ণা সেন-এর সঙ্গে ‘মৌটুসী’তে! পম্পা বড্ড ভালো মেয়ে, হাসিমুখে এই ক্ষণিক বর-বিচ্ছেদ মেনে নিয়ে নিমেষে আপন হয়ে গেল!
দুই বর্ষীয়ান বান্ধবী চিত্রা পাল ও বেলা দে-কে নিয়ে তরুণ প্রশান্তদা (৭৫) এসেছেন, সঙ্গে ভালো মানুষ পার্থ বন্দ্যোপাধায়। পদের গরিমা যাকে ভারী করে না, মাটির মানুষ হয়ে একদম আপনজন হয়ে উঠলেন কবি পার্থ সারথি চক্রবর্তী। নয়া সাইলি বাগান থেকে চা-দেশের দুর্নিবার ঘ্রাণ নিয়ে হাজির হয়েছেন সুকান্ত নাহা, সহজ উঠোনে যার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চা-ডুবুরি’ প্রকাশিত হয়ে একটা অসামান্য সাহিত্যদলিল হয়ে উঠেছে। জাতীয় শিক্ষিকা, টোটোপাড়া যাকে এখনো স্পর্শ করে থাকে, মিশা ঘোষাল এসেই জানিয়েছেন রোববার ভোরে উঠে সবাইকে যোগ-ব্যায়াম করাবেন। বিখ্যাত ডাউহিল স্কুলের (কার্শিয়াং) প্রধানশিক্ষিকা ড. সাগরিকা দত্ত ব্যাগভর্তি কবিতা, মনভরা ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয়েছেন। মীনাক্ষী ঘোষ চির-স্বতন্ত্র, সুধাংশু তাঁকে বললেন “শুধু অসামান্য বাচিক শিল্পী নন, মীনাক্ষীদি স্টাইল আইকন!” তিন দশকের বেশি মীনাক্ষীর সঙ্গে বন্ধুত্ব, আমার কত কবিতা দেশে বিদেশে কত জায়গায় উনি বলেছেন। কী অদম্য প্রাণশক্তি, আমায় মীনাক্ষী মোহিত করেন সবসময়। দুরামারির বৃন্দাবন বাড়ুই দশকের পর দশক সুস্থ্য সংস্কৃতি প্রসারে নীরবে কাজ করে চলেছেন, অহংকারহীন এক অনবদ্য সহজ সরল মানুষ। বারবার বলেছেন – “এতসব গুণী মানুষের সঙ্গে আমি মেলাতে পারব তো?” প্রশান্তদা প্রথম পরিচয়েই তাঁকে ‘বৃন্দা’ বলে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কে বলে আগে কোনওদিন তাঁদের দুজনার দেখাই হয়নি! আমার নিজের মানুষ কৃষ্ণ চন্দ্র দাস ও সঞ্জয় পাল এসেই কাজে নেমে পড়ল। ‘স্যারের’ ভরসা যে ওরা।
আর একটা সারপ্রাইস ছিল আমার জন্য, সুব্রত-র সঙ্গে আলিপুরদুয়ার থেকে এসেছিলেন আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরুণ অধ্যাপক বিপ্লব রায়। ভাইটির সঙ্গে এতদন পর দেখা হবার পর কী অসীম ভালোলাগা। দুপুর থেকে টানা আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় কবিতা শুনিয়ে ফিরে গেলেন গেল সুব্রত-র সঙ্গেই।
রোববার সকালে উঠে অনেকেই মিশার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! যদি ব্যায়াম করায়! ওকে ফাঁকি দিয়ে আমরা অনেকেই চা-বাগানের পাশ দিয়ে চললাম কালজানি নদীটির দিকে। যেতে যেতে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম অতনু চন্দ-র কথা। কী জলদগম্ভীর শৈল্পিক কন্ঠস্বর! মুক্তিদির কাছে অভিযোগ জানালাম – “দিদি, এটা তো আপনার ভারী অন্যায়, এত দারুণ কন্ঠটি কেন কাজে লাগল না?” মোহর জানাল – বাবা ওরকমই, আড়ালে থাকাতেই আনন্দ। দুই কৃতী সন্তানের পিতা মেয়েদের কথা বলতে বলতে যখন কালজানির দিকে চলেছেন, অদ্ভুত মায়াবী রোদ তাঁকে ছুঁয়েছে। শ্রদ্ধা জাগে এমন মানুষের সান্নিধ্যে। তাঁকে কোনওভাবেই মাইকে আনা যায়নি, অথচ সকলেরটা মন দিয়ে শুনেছেন।
কিছুক্ষণ পর কৃষ্ণ সঞ্জয় বৃন্দাবনদা নদীর তীরে হাজির হাঁপাতে হাঁপাতে! সঙ্গে বুক চিতিয়ে মিশা! কৃষ্ণ বলল – “স্যার, আপনারা তো পালিয়েছেন, কিন্তু আমাদের একঘন্টা এক্সারসাইজ করালেন ম্যাডাম। এবার আপনাদের টার্ন!” মিশাও ছাড়বার পাত্রী নন। “লাইন করুন, লাইন! কুইক!” নদীর তীরে অগত্যা তাঁর নির্দেশে সারিবদ্ধ আমরা – মুক্তিদি অতনুদা মোহর প্রশান্তদা আমি। তাঁর দেখানো কসরত করতে করতে ঠান্ডা উধাও! আমরা বলছি “এবার ছুটি!” আর মিশা নতুন নতুন ব্যায়াম দেখিয়েই চলেছেন!
রোববার সকালে অনুষ্ঠান শুরু হল পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় ও পপি দে-র গান দিয়ে। বিনা রিহার্সালে দুজন মিলে মনের আনন্দে গাইছেন, আর একে একে ঘর ছেড়ে সবাই এসে টাটকা রোদে বসছেন, ইষ্টিকুটুমের আঙিনায়। “মন মোর মেঘের সঙ্গী” শুনে স্বত:স্ফূর্ত নাচে মেতে উঠলেন কৃষ্ণা সেন, মালবাজার থেকে অবসরপ্রাপ্ত গণিতশিক্ষিকা কৃষ্ণা মীনাক্ষীর সঙ্গে এসে সবার মন জয় করে নিয়েছেন।
শিশির রায়নাথ পড়ে চললেন তাঁর চিরন্তনী কবিতা, গায়ে কাঁটা দেওয়া অনুভূতি, শেষ করলেন বিখ্যাত “ক্যাপ্টেন” দিয়ে। অনেকের অনুরোধে পুরো কবিতাটি স্মৃতি থেকে বললেন। আমরা শিখে চলেছি। সুকান্ত নাহা কবিতা গল্পে মন ছুঁলেন সবার, এবং অনুরোধে পড়লেন তাঁর বাগানিয়া নির্মাণ ‘ধানু মাহালি’। সুকান্ত চড়ুইভাতিতে অনবদ্য দাগ কেটে গেছেন। রাতে আদিবাসী গানের সঙ্গে যেমন দুর্দান্ত নেচেছেন, তেমনি ঘোর লাগিয়েছেন বাউল গানে। মনোজ পাইন এক গুচ্ছ কবিতা পড়লেন, নিপুণ বাচনে। প্রশান্তদা চিৎকার করে উঠলেন – “এতকাল কেন তোমার কবিতা পড়িনি?” মৈনাক ভট্টাচার্য-র গল্প যেন একটা কথা-স্থাপত্য হয়ে বসে গেল সবার ভেতর। মীনাক্ষী ঘোষ ও সুধাংশু বিশ্বাস ডুয়ার্সের পটভূমিতে পরিবেশন করলেন সুধাংশুর লেখা শ্রুতিনাটক “একটি মৃত্যু এবং”। বলে বোঝানো কঠিন, কী অসামান্য মুহূর্ত তাঁরা নির্মাণ করলেন। সবার চোখ ভিজে গেছে। অভিনয় করতে করতে মীনাক্ষীর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, কী ইনভল্ভমেন্ট! পার্থ সারথি চক্রবর্তী-রা চোখ মুছছেন। বিমল দেবনাথ মঞ্চে এলেন প্রাকৃতিক লিপস্টিক হাতে! শালপাতা! সাগরিকা পপি-রা তা ঘষে অবাক! লাল হয়ে যাচ্ছে। বিমলবাবু কবিতা ও গদ্য শোনালেন। (অনেকে তাঁকে ‘অরণ্যদেব’ বলে ডাকছেন কানে এল!
মুক্তিদি নিজের লেখা একটি ছোট্ট কবিতা পড়েই চলে গেলেন আমার অনেকদিন আগের লেখা ছড়া ‘ইষ্টিকুটুম মিষ্টি পাখি’তে। একজন যথার্থ বাচিক শিল্পী কী যাদু করতে পারেন তা অনুভব করছিলাম, নিজের লেখাটিকে নতুন করে আবিষ্কার করে। মুক্তিদি অপূর্ব পড়লেন সুকান্ত নাহা-র একটি গল্পও।
মিশা ঘোষাল নিজের ক’খানা কবিতা শুনিয়েই সকলের দাবিতে চলে গেলেন টোটোপাড়ায়। টোটোগানে প্রাঙ্গণ ভরিয়ে দিলেন। সাগরিকা দত্ত তাঁর মায়ের লেখা কবিতা পড়লেন, ‘উত্তরবঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক অমিত কুমার দে-র দুটি কবিতাও তাঁর পরিবেশনে।
দুপুরে সুক্তো, ডালের বড়ি দিয়ে অর্গানিক পালং শাক, শিশিরদার প্রিয় রাইশাক, বিশাল সরপুটি, ছোট মাছের চচ্চড়ি ইত্যাদিতে রসনা ভরপুর!
খেয়েই দুই দল দুই দিকে হাওয়া! বিমল দেবনাথের নেতৃত্বে একদল পোড়ো বস্তিতে, প্রশান্তদার দলপতিত্বে আরেক দল মনের মানুষ স্পটে (বানিয়াদহ নদী) ও চিলাপাতায়। দুই দলের সংযোগ মুঠোফোন। চলছে ছবি আদানপ্রদানের লড়াই। অসমবয়সী এক ঝাঁক শিশু।
ফিরে আবার সবাই মিললাম। এদিন পৌষ পার্বণ। সুব্রত আদিবাসী মায়েদের দিয়ে বানিয়ে এনেছেন আদিবাসী পিঠে। চায়ের সঙ্গে সেই নতুন পিঠে খেতে খেতে আমরা আবার সাহিত্যেই ফিরলাম।
আমি অনেকের ইচ্ছেয় পড়লাম আমার ‘রাজেশ্বরী’। সুব্রত অনেক কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে আমার রাজেশ্বরীও আজ অলক্ষ্যে দুই হাত মেলে আগুন তাপাতে বসেছে! আগুনরঙে আগুন হয়ে উঠেছে সে!! প্রশান্তদা সন্ধ্যাটাকে রহস্যময় করে তুললেন আরণ্যক ভূতের গল্প পড়ে। শুক্লা রায়, চিকরাশি সহজ উঠোনের সহযোগী সম্পাদক, অনুভবী কবিতায় সবাইকে আচ্ছন্ন করলেন, পড়লেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি “পইলা সাঞ্ঝির কথা”র প্রথম পর্বটি, এটি সহজ উঠোনেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তমিলের কবিতা পড়লেন, তাতে ডুয়ার্সের রঙ আঁকা। বৃন্দাবন বাড়ুই পড়লেন আমার ছন্দের লেখা “ভালো থেকো” ও সংলাপ “বৃদ্ধাশ্রম”, বললেন তাঁর মুগ্ধতার কথা। পপি দে সবাইকে কাঁদিয়ে দিলেন তাঁর বরের লেখা শ্রুতিনাটকে। “একটি কাব্যিক সকাল”। তাঁকে সহযোগী শিল্পী হিসেবে সহযোগিতা করলেন তাঁর বর! সুব্রত এসে চিকরাশির সম্পাদককে পরিয়ে গেলেন ভালোবাসার উত্তরীয়। তাঁর যোগ্য সহধর্মিনী চম্পা আমাদের সঙ্গে অনেক ভালোবাসা নিয়ে ছিলেন নীরবে। ভাইয়ারাম ওঁরাও, যে এত সুন্দর রেঁধে রেঁধে খাওয়ালো আমাদের, রোববার রাতে সে মাইক নিয়ে শোনাতে লাগল আদিবাসী গান। তাঁর গানের ছন্দে কোমড় দোলালেন সুকান্ত বিমল এবং আরো অনেকে।
নিজের কবিতা ও দলিত সাহিত্যের অনুবাদ পড়লেন অনুরিমা চন্দ (মোহর)। মোহর এই আসরের সেরা আবিষ্কার। জেএনএউ-এর স্কলার, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপিকা, নানান দেশ কাজের সূত্রে ঘোরা এই তরুণী আমাদের অনেক স্বপ্ন দেখালেন, উত্তরের সাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে পৌঁছে দেবার অঙ্গীকার নিলেন। তাঁর সহযোগিতায় অদূরেই সহজ উঠোনে শুরু হবে অনুবাদের বিভাগ। সৃজনআসর শেষ হল তাঁর গাওয়া “আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে” দিয়ে। সবাই তখন দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন। মাঠের আগুন তখন অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে!
রাতে ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে চিকেন কষা থাকলেও শিশিরদার চাওয়ায় বেগুনপোড়া ছিলই। নলেন গুঁড়ের পায়েসও হয়েছে কাঠের উনুনে।
গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বারবার মুঠোফোনে খোঁজ নিয়েছেন। রাতে চলভাষেই অংশ নিলেন আমাদের সঙ্গে। লাউডস্পীকারে তাঁর কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ল তাঁর প্রিয় ইষ্টিকুটুমে, এই ফার্ম হাউস তাঁকে দিয়েই উদ্বোধন করিয়েছিলেন সুব্রত কুন্ডু।
রাত ঘনাচ্ছে, সবার মন কেমন করছে। কাল সকালেই ফিরে যাওয়া। আবার সেই দৈনন্দিন রুটিনে! কুয়াশাও ঘন হয়ে আসছে আরো। হঠাৎ মনোজের বাই উঠল – রাতের অরণ্য দেখতে যাবে, ডুয়ার্সের অরণ্যদেব সঙ্গে আছেন যে। তিনখানা গাড়ি বেরিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে, বিমল দেবনাথের দলপতিত্বে। কর্তাগিরি সামলাতে হলে অনেক ইচ্ছেয় তালা দিতে হয়। ওরা জঙ্গলে বেরোতেই আমি শেষ লগ্নের কাজ নিয়ে বসলাম। সবার কাছে এবারের মতো বিদায় চেয়েও নিয়েছি। কারণ ভোরবেলা আমায় বেরোতেই হবে। বাকিরা সুবিধেমতো বের হবেন। ফোনে সুব্রত জানাল – রুটি সবজি ডিম তো থাকবেই, যারা দূরে যাবেন তাঁদের জন্য ফেনা ভাত আলু সেদ্ধ ঘি-র বন্দোবস্তও করে দেবে।
আর একটা কথা – সাহিত্যের মানুষ নন, তবু মীনাক্ষী প্রশান্তদা ও বিমলবাবুর বাহনের চালক ভাইয়েরা নিজের থেকে মিশে গিয়েছিল গোটা দলের সঙ্গে। ওরাও ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন আমাদের।
ষোল তারিখ কুয়াশা ডিঙিয়ে ফিরছি। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে জমে যাচ্ছি ঠান্ডায়। বারবার আনমনা হচ্ছি – ইষ্টিকুটুমে কি কিছু ফেলে এলাম? অনেক মূল্যবান কিছু??
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴