আমি এক যাযাবর-১২/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
১২তম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
আগেই লিখেছিলাম, রেশম পথে পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে দু'একটা দিন রিশি বা পেডংএ কাটিয়ে যাওয়া যায়। রিশির কথা তো আগের পর্বেই শেষ করেছি, এবার যাওয়া যাক পেডংএ। স্থানীয়রা পেদং, পেদুংও বলে থাকেন। রিশি থেকে মাত্রই ১৫ কিলোমিটার। ফলে সেবাস্টিয়ানের ডেরায় থেকেও, সারাদিন কাটিয়ে আসা যায় পেডংএ। পর্যটন মানচিত্রে এখনো তেমন জায়গা করে নিতে পারে নি বলে, ছোট্ট এই পাহাড়ি জনপদ টি তার অনাঘ্রাত সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে পেরেছে অনেকটাই।
পেডং কথাটির অর্থ বাঁশগাছ। বিশেষ করে কালিম্পং থেকে আলগাড়া হয়ে যে পথটা গেছে, তার দুপাশজোড়া বাঁশ গাছের ঘন জমায়েত এই নামকরণের সার্থকতা যোগায়। ৫৫০০ ফুট উঁচুতে পেডং বাজারটি বেশ ঘিঞ্জি। তবে পথের মাঝে মাঝেই নির্জন সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে হাতে গোনা কয়েকটি হোটেল, হোমস্টে মাথা তুলেছে। আমার পছন্দ হয়েছিল 'নীলপাহাড়ি'।
এ অবশ্য এখনকার পেডং। প্রাচীন কালে এই পাহাড়ি গ্রামটি এতটা গুরুত্ব হীন ছিলো না।যে হেতু এর অবস্থান রেশমপথের ওপরেই। কেন্দ্র স্থানে একটি গীর্জা। তার পাশেই শতাব্দীপ্রাচীন স্কুল। স্কুলের খেলার মাঠ ছাড়ালেই সারি সারি পাহাড় চূড়া।
ইতিহাস বলে, প্রাচীন সে যুগে পেডং ছিলো সিকিমের অধীন। পরবর্তী কালে ভুটানের রাজা যুদ্ধে ছিনিয়ে নেন একে। সে সময়ই গড়ে ওঠে পেডংভ্রমণে অবশ্যদ্রষ্টব্য দামসাম ফোর্ট। বর্তমানে দূর্গটি ভাঙাচোরা অবস্থা পেলেও, পাহাড়-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে এই ঐতিহাসিক স্মারকটি দেখে নেওয়া শ্রমসার্থক হবে। পেডং থেকে ঘুরে আসি চলুন রিকিসাম। খ্রীষ্টিয় উনিশ শতকে এই রিকিসাম পাহাড়ের মাথা থেকে কামান চালিয়ে ব্রিটিশরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো দামসাম ফোর্টকে, দখল নিয়েছিলো পেডংএর, ভুটান রাজকে হারিয়ে। এর কিছু দিন পর এই রিকিসামে তারা গড়ে তোলে অনিন্দ্যসুন্দর এক বাংলো। দীর্ঘ দিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকবার পরে, স্থানীয় মানুষেরা এই বাংলোতে অশরীরী আত্মাদের উপস্থিতি অনুভব করে নাম দিয়ে ফেলে ভুত বাংলো।! আমার সৌভাগ্য সে বাংলোয় আমি রাত কাটিয়েছিলাম। না শরীরী, না অশরীরী, কেউই আমাকে ডিস্টার্ব করে নি সে সময়। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় ভুতবাংলো আগুনে খাক হয়ে যায়। এখন কেবল তার ধ্বংসাবশেষ অতীতের সাক্ষ্য বয়ে চলেছে। পেডং বা রিকিসামে রাত কাটানোর সেরা আকর্ষণ রিকিসাম থেকে ভোরবেলার সূর্য ওঠা দেখতে পাওয়া!
পেডং থেকে মূল রেশমপথের রেশ ধরে দেখে নেওয়া যায় আরিতার লেকটিকেও। স্থানীয় মানুষের মুখে অবশ্য এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের চলতি নাম 'লামপোখরি'। পেডং থেকে রেনক।সেখান থেকে আরিতার মাত্রই ৫ কিলোমিটার। ছোট্ট গ্রামটিতে সবার আগে মন কেড়ে নেয় ফুল, ফুল আর ফুল! ব্যক্তি মালিকানার বাড়ি, হোটেল, রিসর্ট, সবই যেন চিরবসন্তে রঙিন। নির্জনতা বিলাসী যাঁরা, আরিতার যেন তাঁদেরই জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। মধুচন্দ্রিমা যাপনকামী যুগলের জন্যও 'লামপোখরি' এক আদর্শ জায়গা।
জনবসতি থেকে সামান্যই দূরে পান্নাসবুজ 'লামপোখরি' হ্রদ, পাইনের দীর্ঘ প্রাচীর পাহাড়ায় রেখেছে তাকে। পবিত্রতার প্রতীক হয়ে হ্রদের চারদিকে উড়ছে রঙবেরঙের প্রার্থনা পতাকা। লেকের ধারেই গড়ে উঠছে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ যুক্ত নানা রিসর্ট। প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে অলস হাঁটুন লেকবেষ্টন করা বাঁধানো রাস্তায়। মন চাইলে, বোটহাউজ থেকে পেডাল বোট ভাড়া করে ভেসে পড়ুন জলে। আপনার এই জলবিহারের সঙ্গী হয়ে যাবে রাজহাঁসের ঝাঁক, লাফিয়ে উঠে একঝলক দেখা দিয়েই জলের গভীরে লুকিয়ে যাবে রঙিন মাছেরা। নানা রঙের ফড়িং উড়ে বেড়াবে বোটের পাশে পাশে।
লেকের একপাশে রয়েছে গুরু পদ্মসম্ভবের মন্দির। দোতলায় তাঁর বিশাল মুরতি। এর শান্ত, পবিত্র নির্জনতায় বিশ্রাম নিতে পারেন। আর পাখির চোখে আরিতারকে দেখতে চাইলে বোটহাউজের উল্টো পারে। বনের ভেতর দিয়ে পাকদণ্ডী বেয়ে, কয়েকশো সিঁড়ি ভেঙে, আর এক মন্দির। পরিশ্রম? সে তো বটেই! কিন্তু মন্দিরের চত্বর থেকে হাত বাড়ালেই আকাশকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলছেন যখন, অনেক নীচের আরিতার লেক যখন আপনার চোখের সামনে মগ্ন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মত ফুটে উঠছে, তখন তো সকল ক্লান্তি ভুলে আপনারই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবেঃ
"স্বর্গ সত্যিই যদি কোথাও থাকে
তবে সে এখানে, এখানেই! "
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴