স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/একাদশ পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে দশটি পর্বে অনেক কথাই বলেছি ধার করা অভিজ্ঞতায়,
তবে এবারে ছাত্রজীবনের সময়কার যা কিছু বলব, তা কিন্তু প্রত্যক্ষ
অভিজ্ঞতার। উপাচার্য অম্লান দত্তকে নিয়ে কিছু বলবার অধিকারী আমি নই,
ছাত্রাবস্থায় তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা শুনেছি, কিন্তু বুঝেছি অনেক পরে। আসলে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে উপাচার্যের যোগাযোগের কোনো হেতু ছিল
না, নামের মাহাত্মটুকু অনুভব করা ছাড়া, শুধু কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে
তিনি যখন স্বমহিমায় উপস্থিত হতেন, দূর থেকে তাঁকে দেখেছি আর শিহরিত
হয়েছি। তা ছিল যেন দেবতা দর্শনের অভিজ্ঞতা।
বাংলা
বিভাগের সূচনা ১৯৬৪তে ,সেই সূচনাপর্বের কথা ভারী সুন্দর করে লিখেছেন, ১৯৬৪
-৬৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র, শিলিগুড়ি মহাবিদ্যালয়-এর অধ্যাপক সঞ্জীবন
দত্তরায় তাঁর স্মৃতিকথায়, "উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় সে বছর (১৯৬৪) তিনটি
নতুন বিভাগ খুলবে, বাংলা -ইতিহাস- কমার্স, ভাবলাম যদি খোলে, তবে আর
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় যাব না এখানেই পড়ব। তাছাড়া বর্ধমান যাওয়াটা অত
সহজ ছিল না। ফারাক্কা সেতু হয়নি, পুজোর ছুটির পর বাংলা-ইতিহাস-কমার্সের
স্নাতকোত্তর বিভাগ চালু হল। ভর্তি হলাম, ক্লাস শুরু হয়ে গেল। পাশাপাশি
তিনটি ঘরে তিন বিভাগের ক্লাস। তিন বিভাগের ছাত্র ছাত্রী ও অধ্যাপকদের
মেলামেশা ছিল অবাধ। ইতিহাস বিভাগের প্রধান ছিলেন ডক্টর ডিপি সিনহা, সিংহলের
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন, আর ছিলেন অধ্যাপক তাপস রায় চৌধুরী।
কমার্সের ক্লাস নিতে আসতেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য
অধ্যাপক বিনয়েন্দ্র নাথ দাসগুপ্ত। কখনো কখনো বাংলা ক্লাসে ঢুকে পড়তেন
ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিতেন। পার্ট ওয়ানের শুরুতে আমরা
মাত্র দু'জন অধ্যাপককে পেয়েছিলাম - অধ্যাপক তরণীকান্ত ভট্টাচার্য ও ডক্টর
শিবচন্দ্র লাহিড়ী। পরে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন ডক্টর হরিপদ
চক্রবর্তী। পার্ট টুতে ক্লাস শুরু হলে দুজন নবীন অধ্যাপক বিভাগে যোগ দিলেন
ডঃ অলোক রায় ও ডঃ পুলিন দাস।" বাংলা বিভাগের ফার্স্ট ব্যাচের কয়েক জন
ছাত্র-ছাত্রী উত্তরবঙ্গের সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতের সুপরিচিত। একজন অধ্যাপক
গিরিজা শংকর রায়, অন্যজন ব্রততী ঘোষ রায়, রায়গঞ্জ কলেজে অধ্যাপনা করতেন,
কবি ও প্রাবন্ধিক, নানা সূত্রে ও কাজে ব্রততীদির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, ছোট
ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন, ফোনে কত গল্প হত। বাংলা আকাদেমি, সেমিনার, লোকাল
ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজ সেন্টার, ওনার নিজের পত্রিকা 'উত্তরবঙ্গ প্রগতি',
সবকিছু মিলিয়ে ব্রততীদির অভাব আজো খুব অনুভব করি। সঞ্জীবন দত্তরায়
উত্তরবঙ্গের বিদ্বজন সমাজে সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে যথেষ্ট
সুপরিচিত। বাংলা বিভাগের ওই প্রথম ব্যাচের আরো দুজন ছাত্রী আরতি
ভট্টাচার্য্য ও কল্পনা চ্যাটার্জির সাথে পরিচয় হয়। আরতিদিরা আমাদের
পাড়ায় থাকতেন, আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাই নির্মল পাল-এর সাথে পরিণয়
সূত্রে আবদ্ধ হন ।আরতিদি জলপাইগুড়ির ভবেশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্রধানশিক্ষক
ছিলেন, আর কল্পনাদির সঙ্গে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সূত্রে পরিচয়
হল। কল্পনাদি তখন ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট-এর কর্মী, আন্ডারগ্রাজুয়েট
কাউন্সিলের সেক্রেটারি ডক্টর দিলীপ চ্যাটার্জীর সহধর্মিনী ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সূত্রে এভাবে অনেকের সাথেই পরবর্তীকালে পরিচয়
হয়েছে। এখনো মনে পড়ে আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে বাবা আর মা, আরতিদি আর
নির্মলদার হাত ধরে মিলন সংঘ মাঠে আসত ওদের ছেলে ছোট্ট সায়ন, এখন সে মস্ত
ডাক্তার, বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, ডক্টর সায়ন পাল।
আমরা
যখন বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম ১৯৭৫ -৭৭ শিক্ষাবর্ষে, তখন বিভাগটি
সুপ্রতিষ্ঠিত। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন হরিপদ চক্রবর্তী, অন্যান্য অধ্যাপকরা
হলেন তরণী কান্ত ভট্টাচার্য্য, শিবচন্দ্র লাহিড়ী, অশ্রুকুমার সিকদার,
প্রণয় কুমার কুণ্ডু ও সুনীলকুমার ওঝা। সুনীলদা ছিলেন Manascript Reader
বিভাগের প্রাক্তনী এবং সুনীলদা হরিপদবাবুর বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন।
হরিপদ
বাবুকে আমরা বেশি দিন পাইনি ।ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ হতে না হতেই, হরিপদ
বাবুর অবসরের সময় এসে গেল। কোনো আনুষ্ঠানিক বিদায় সম্বর্ধনা তিনি নেবেন
না জানিয়ে ছিলেন। কর্মজীবনের শেষ দিনে বিভাগের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী
অধ্যাপকরা গিয়েছিলেন হরিপদবাবুকে বিদায় জানাতে । কোনো সাজানো অনুষ্ঠান
ছিল না, নানা কথায় শ্রদ্ধায় শুভেচ্ছায় অশ্রুসজল দীর্ঘশ্বাসে সেই
বিদায়বেলার সন্ধ্যা নেমেছিল।
অধ্যাপক
তরণী ভট্টাচার্যের কথা মনে পড়লে শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে আপনা থেকেই মাথা নত
হয়ে আসে। স্যারকে ঝাড়ন হাতে নিজের চেয়ার টেবিল পরিষ্কার করতে দেখেছি।
বিভাগীয় প্রধানের কাজ উনি বোধহয় নিঃশব্দে সামলে দিতেন। হরিপদবাবুর কাছে
কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে বলতেন, "তরণীবাবুর কাছে যাও", আমরাও স্যারের কাছে
যেতে কখনও দ্বিধাবোধ করিনি।সারাক্ষণ বিভাগ আগলে রাখতেন। সাদা ধবধবে
ধুতি-পাঞ্জাবি, ফর্সা রেশমের মতো সাদা চুল, লাল টুকটুকে ঠোঁট।আমরা অনেকেই
জলপাইগুড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বাসে যাতায়াত করতাম, সকালে কী খেয়ে আসি
বাড়ি থেকে, টিফিনে কী খাই এসব বিষয়েও স্যার খোঁজখবর নিতেন। এমন পিতৃতুল্য
হৃদয় আর অপরিসীম বাৎসল্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো অধ্যাপকের ছিল বলে মনে
হয় না। চর্যাপদ, চৈতন্যচরিতামৃত আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকানোর কি আপ্রাণ
চেষ্টা ছিল এই ঋষিকল্প মানুষটির, যা ভাবতে আজও চোখে জল আসে।
অধ্যাপক
শিবচন্দ্র লাহিড়ীর ক্লাস আমার কাছে মনে হত অনবদ্য এক কথকতার আসর। বৈষ্ণব
পদাবলী, শাক্তপদাবলী, চন্ডীমঙ্গল, বিষাদ সিন্ধু, রাজ সিংহ, পথের পাঁচালি,
স্যার যখন পড়াতেন সত্যি মনে হত "কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো "। অনবদ্য
কথকতায় লাহিড়ী স্যার কখনো রাধা, কালকেতু, অপুকে, আবার কখনো বিষাদসিন্ধুর
এজিদকে, ক্লাসের ভিতর হাজির করতেন ।
অধ্যাপক
প্রণয় কুন্ডু যাকে আমরা বলতাম P. K. K., স্যার। যিনি চাইতেন,
সময়ানুবর্তিতায় আমরা যেন খাঁটি সাহেবদের মতো হই। সাদা ধবধবে পাটভাঙা ধুতি,
আর ধুতির কোচা পাঞ্জাবির পকেটে। পাঞ্জাবির রং সবসময় এক রকম থাকত না, কখনো
সাদা, কখনো গেরুয়া আবার হলদে। সৌন্দর্যের পূজারী রাবীন্দ্রিক ভাবনায়
নিবেদিতপ্রাণ মানুষটি ছাত্র-ছাত্রীদের ঢিলেঢালা কথায় খুব রেগে যেতেন,
অভিমান করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে P. K. K স্যার
সবসময়ই বিশিষ্ট ভূমিকা নিতেন। স্যারকে নিয়ে কখনো-সখনো একটু-আধটু নির্দোষ
মজা করেছি, তবে তাতে অশ্রদ্ধার কোন জায়গা ছিল না, ভয়-ভক্তি-সমীহ করা
আমাদের তখনকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সহজাত ছিল।
আধুনিক
বাংলা সাহিত্যের অনেকাংশই বিশেষ করে কবিতা উপন্যাস পড়াতেন অধ্যাপক
অশ্রুকুমার সিকদার। গম্ভীর মানুষ, তাঁকে আমরা একটু বেশি ভয় পেতাম,
সিলেবাসের বাইরে গিয়ে আধুনিক সাহিত্যের জানালাগুলো খুলে দিতেন আমাদের
জন্য। অশ্রুবাবুর মতো অধ্যয়নশীল অধ্যাপক খুব কম দেখেছি। আমি পরে তার অধীনে
গবেষণা করেছি। অবসর নেওয়ার পরও স্যার গ্রন্থ ভবনে নিয়মিত আসতেন।
দেশ-বিদেশের সাহিত্যের সাম্প্রতিক খবর ও বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য সমালোচনা
মূলক সর্বশেষ প্রকাশিত বইটি না পড়লে স্বস্তি পেতেন না। স্যারের সাথে শেষ
আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, শেষের দিকে চোখের কঠিন অসুখে একটু হতাশ হয়ে
পড়েছিলেন, আফসোস করতেন বই পড়তে পারছেন না বলে। খুব মনে পড়ে লাইব্রেরীতে
London Magazine ছিল স্যারের খুব পছন্দের আর ভালোবাসার পত্রিকা, আজ সেই
পত্রিকায় ধুলো জমছে, কেউ হয়তো খুলেও দেখেন না।
অধ্যাপক
পুলিন দাস আমাদের নাটক পড়াতেন। কিন্তু তার পড়ানোতে কোনো নাটকীয়তা ছিল
না, 'সিরাজউদ্দৌলা'- 'সীতা' 'একেই কি বলে সভ্যতা' 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে
রোঁ' 'রাজপুরী' সব নাটকের সংলাপ একই ভাবে পড়াতেন। ক্লাসে ভীষণ গম্ভীর
থাকতেন। হাসতেন না কখনো। কিন্তু তাঁর মধ্যেও যে হাস্যরস ও ছাত্র-ছাত্রীদের
প্রতি স্নেহ ফল্গুধারার মতো বইত ক্লাসের বাইরের বহু ঘটনায় তা উপলব্ধি
করেছি।
আমাদের
সকলের প্রিয় সুনীলদা পান্ডুলিপি পাঠের শিক্ষা দিতেন। বিষয়টি নিয়ে আমার
খুব আগ্রহ ছিল, কিন্তু তার পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থা তখন আমাদের সিলেবাসে
ছিল না। সুনীলদা ছিলেন বিভাগের প্রাক্তনী, হরিপদবাবুর অত্যন্ত স্নেহভাজন।
মানিক দত্তের চণ্ডীমঙ্গল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন। বাংলা বিভাগে
অনেকদিন ছিলেন, পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চলে যান। খুব মনে পড়ে
অধ্যাপিকা গায়ত্রী দাসের কথা, তিনি রায়গঞ্জ কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন।
সম্ভবত সেই সময়ে ইউজিসির ফ্যাকাল্টি ইমপ্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম নিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন গবেষণা করতে ।তিনিও এই বাংলা বিভাগের প্রাক্তনী,
গায়ত্রীদি আমাদের এক মাস ধরে পড়িয়ে ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের 'প্রান্তিক'
কাব্যগ্রন্থটি । 'দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালীন বাংলা কবিতা' নিয়ে
তিনি অশ্রুবাবুরকাছে গবেষণা করেছিলেন। বিভাগে তখন দুইজন ছাত্র-গবেষককে
দেখতাম - তপতী রায় নাথ ও হিমাংশু মন্ডলকে । বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়
প্রতিটি বিভাগেই তখন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী-গবেষকরা এক ডোরে বাঁধা ছিলেন।
হরিপদবাবু
অবসর নেবার পর বিভাগীয় প্রধান হয়ে এসেছিলেন স্বনামধন্য অধ্যাপক ভবতোষ
দত্ত। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার আগে তিনি কোচবিহারের আচার্য
ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়-এর অধ্যক্ষ ছিলেন । পড়ানো শুরু করলেন
প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ, কিন্তু মাত্র কয়েকমাস পরেই চলে গেলেন। এর বেশ
কিছুদিন পর বাংলা বিভাগে যোগ দিলেন তার স্ত্রী অধ্যাপিকা গার্গী দত্ত। পরে
দেখেছি এই দুই অধ্যাপক দম্পতির কন্যা কারুবাকী দত্তকে, তিনি তিনি
হিমালায়ান স্টাডিজ সেন্টারের অধ্যাপিকা, এখনো অধ্যাপনা করছেন। মনে আছে
ভবতোষবাবু ক্লাস নেবার সময়, স্বল্প সময়ের জন্য এসে চলে যাবার জন্য খুব
দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন বিদায় সম্বর্ধনা নিতে রাজি হননি, চলে যাবার দিন
বিভাগের সবাইকে নিয়ে একটি গ্রুপ ছবি তুলেছিলেন। ভবতোষবাবু যাবার আগে
আমাদের এস্কারশনে যাবার বন্দোবস্ত করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা পুরী
গিয়েছিলাম। ভবতোষবাবু তাঁর প্রথম পুরী ভ্রমণের গল্প শুনিয়েছিলেন। পুরী
থেকে কোনারক গরুর গাড়িতে যাবার রোমাঞ্চকর বর্ণনা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম।
সেবারে পুরীতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগ শুধু নয়,
পলিটিক্যাল সাইন্স ও কমার্স বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরাও গিয়েছিলেন।আমাদের
সঙ্গে ছিলেন PKK sir। পুরীর সমুদ্রতট জমজমাট হয়ে গিয়েছিল উত্তরবঙ্গের
ছাত্র-ছাত্রীদের কলতানে।বর্তমানের এই সামাজিক দূরত্ব রক্ষার দুর্দিনে,
স্মৃতির সরণি বেয়ে সেইসব বন্ধু-বান্ধবীরা আজো আসে, কখনো সম্মিলিত আড্ডার
ঝড় তুলে, আবার কেউ একা একা, একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিমায়। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে
আজো যখন কলাভবনের তেতালার বারান্দায় দাঁড়াই, তখন তাদের দেখতে পাই
ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ওরা জটলা করছে, কিংবা একতলার ব্যাংকের
বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ডাকছে। মনে হয় এইতো সেদিন- "যখন এসেছিলে
অন্ধকারে/চাঁদ ওঠেনি সিন্ধু পারে/" সেই সুদূরেরস্মৃতি, হারানো দিনগুলোতে,
নিজেকে আবার নতুন করে দেখার চেষ্টা হয়তো নিঃসঙ্গ এই জীবনে সেইসব মূল্যবান
সম্বলটুকু নিয়ে ভালো থাকা।
আমরা যখন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে এসেছিলাম তখন কলেজে বারবার ভন্ডুল পরীক্ষা
হবার জেরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাস আগে পরে দুটো শিক্ষাবর্ষ একসাথে
চলছিল। নিউ পার্ট ওয়ান আর ওল্ড পার্ট ওয়ান, আলাদা ক্লাস হত। আমাদের
ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল ১৯ জন। দ্বিজেন-মলয়-মনোজ-জমিরআলী-মন্তেশ্বরকেশব-জ্যোৎস্না-অনুশীলা-শিখা-শুকলা-
ভাস্বতী-স্বপ্না-লিপিকা-শিখিকা-শীলা-কমলা
-পাঞ্চালি আর প্রতিমাদি। শেষ পরীক্ষা অব্দি আমরা সবাই ছিলাম, একমাত্র
প্রতিমাদি ছাড়া, অসুস্থ হয়ে পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন।উত্তরবঙ্গের সব জেলার
কলেজের ছেলে মেয়েরা ছিলেন আমাদের মধ্যে। একমাত্র শীলা এসেছিল ডিব্রুগড়
থেকে। ও সম্ভবত গৌহাটির কটন কলেজে পড়ত। আজ এসব ধূসর অতীত। মন্তেশ্বর,
স্বপ্না, পাঞ্চালিরা আর নেই। শীলা ওল্ড এজ হোমে। সবাই যে যার কর্ম জগত থেকে
অবসর নিয়ে, কেউ সংসারে কেউবা বাণপ্রস্থে। আমাদের অধ্যাপকরা প্রায় সকলেই
দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে গেছেন, তবুও সব সময় মনে হয়, ধাত্রীদেবতার মতো এই
বিভাগটি কথা। ছিন্ন মেঘেরদলের মতো গান ভেসে আসে রাজা রামমোহনপুর থেকে-
"তোমার ই নাম বলবো নানা ছলে,
বলব একা বসে আপন মনের ছায়াতলে।
.... . ....................... .. ..........................
শিশু যেমন মাকে নামের নেশায় ডাকে,
বলতে পারে এই সুখেতেই মায়ের নাম সে বলে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের
দেওয়া অন্নজল বহু জন বহু মুখে গ্রহণ করেছেন। পুরনো বিন্যাস অনেক খানি
বদলে গেছে। আমাদের সেই ছাত্রাবস্থার আবেগ উচ্ছ্বাস, পরবর্তী কালের
কর্মজীবনের কঠিন বাস্তব অভিজ্ঞতায় অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু ওই দুই বছরের
যতটুকু ঝাঁপিতে রয়েছে, তা পরম ভালোবাসার মহার্ঘ সম্পদ ।এই লেখায় তার
ভগ্নাংশটুকুও প্রকাশ করা গেল না। পরবর্তী কালের কর্মজীবনে
বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষাবর্ষের, বহু ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে দেখা হয়েছে,
কথা হয়েছে, সবাইকেই প্রায় একটি বিষয়ে একমত হয়ে বলতে শুনেছি, তাদের
সময়কার বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, তাদের ছাত্রজীবন যাপন,
তার কাল, সবচেয়ে সেরা, সেটাই সুবর্ণ যুগ। হয়তো আজোএমনটাই হয় ।আমার
এখনকার এই পড়ন্ত বেলার, নিভন্ত আলোয় সেই রূপকথা জগতের, মায়ামুকুরে
বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের সময়ের মুখ দেখি, আর রূপকথার সেই
পাত্র-পাত্রীদের মতো বলি, "বল তো আয়না কে বেশি সুন্দরী?"এখনো মনে হয় সেই
.আমাদের সময়টাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর ছিল। এখনো মনে হয়, জীবনটা যদি আবার
ওখান থেকে নতুন করে শুরু করা যেত! কত কিছু জানা হল না, কত কথা যাকে বলার
ছিল, বলা হল না। কত প্রশ্ন থমকে দাঁড়িয়ে থেমে গেছে, উত্তর মেলেনি । যদি আর
একবার,
"আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে
.... ............................ ... ............... .
হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়ননীরে।"