সানিয়া/পর্ব-এগারো
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^
ক্লান্ত
দুই কিশোর রাত জাগতে জাগতে ঘুমিয়ে গেছে চাংড়ার উপর। হাত থেকে লাঠি দুটি
খসে পরে গেছে নীচে। কুকুরেরাও যে যার মতো বাড়ি ফিরে গেছে। হয়তো বা চলে গেছে
তাদের রাত পাহাড়ায়। একফালি রাতজাগা চাঁদ আকাশে ধীর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। সে
তার নরম আলো ছড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে সানিয়া রামুকে। ওদের ক্লান্ত চোখ,
শুকনো মুখ আর অসাড় হাতপাগুলি সোনালী ফ্রেমের মাঝে যে বড্ড বেমানান লাগে।
মনটা কেমন করে ওঠে চাঁদের। সূর্যকে দায়িত্ব দিয়ে সেও পালিয়ে যেতে চায়
তাড়াতাড়ি।
ভোরের আলো
ফোটবার আগেই উঠে পরে সানিয়া রামু। বাথানেও প্রতিদিন এই সময়েই ঘুম থেকে উঠতে
হয় তাদের। চোখে মুখে কোনরকম জল ছিটিয়ে হাতিরামদের নিয়ে তারা রওনা হয়ে যায়
পানবাড়ির দিকে। হাতিরামদের হাঁটার শক্তি লোপ পেয়েছে। তাদের টলমল বেসামাল
পা-ই বলে দিচ্ছে হাঁটবার শক্তি হারাতে চলেছে তারা। গতকাল দুপুর থেকে ওদের
পেটে পরেনি কিছুই। নিজেদের পেটের অবস্থাও তথৈবচ। হাতিরামদের পেট ভরাবার রসদ
আশেপাশেই রয়েছে প্রচুর। রাস্তার ধারে ঘাস দেখে হাতিরামদের নিয়ে দাঁড়িয়ে
পরে সানিয়া-রামু। জঙ্গলে ঢুকে মহিষেরা ঘাস চিবিয়ে মহানন্দে পেট ভরিয়ে চলে।
সানিয়া রামু ভুখাপেটে মেঠোপথের ধারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে যাত্রা শুরু
করবার। তাদের যে আরও ঘন্টা তিনেক পথ হাঁটা বাকি।
কিছুটা
বিশ্রাম কিছুটা হাঁটা। এভাবেই ক্লান্ত পা-গুলি সকাল আটটা নাগাদ পৌঁছে যায়
পানবাড়ি বাজার এলাকায়। বাজারের দু'একটি দোকান খোলা রয়েছে। দোকানের পসরা
দেখে সানিয়া রামুর পেট যেন আরও বেশী করে মোচড় দিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করলেও
দোকানের সামনে যেতে পারেনা সানিয়া। সব পয়সা যে পথেই হারিয়ে ফেলেছে সে।
পানবাড়ি বাজারেই হাতিরামদের নতুন মালিকের হাতে তুলে দেবার কথা ছিল। কিন্তু
গতকাল তারা ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেনি মহিষ নিয়ে। আজ হাতিরামদের পৌঁছে দিতে
হবে খালেক ভাইয়ের কাছে। খালেক ভাইয়ের বাড়ী বাজার থেকে খানিকটা দূরেই
বলেছিলেন বাথান মালিক। তাই পাশের চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করতেই ঠিকানা মেলে
খালেক ভাইয়ের। বাড়ির সামনের জমিতেই কাজ করছিলেন খালেক ভাই। মহিষ দেখেই সে
ছুটে আসে রাস্তার উপর। বাড়ির সকলকে ডাক দেন জোরে। ছুটে আসে তার পরিবারের
সকলে।
সানিয়া রামু বোকার
মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের দিকে ভ্রূক্ষেপ দেবার কারোই সময় নেই। সকলেই ব্যস্ত
হয়ে পরে তাদের বাড়ীর নতুন অতিথিদের নিয়ে। হাতিরামদের নাদুসনুদুস চেহারা
দেখে বেজায় খুশী খালেকভাই। হাতিরামের গলায় আদরের হাত বোলাতেই মুখ ফিরিয়ে
সানিয়াকে খোঁজে হাতিরাম। সানিয়া রামু উল্টোদিকে তাকিয়ে বসে থাকে রাস্তার
ধারে। হাতিরামরা বুঝতে পারে সবকিছুই। জোড়ে জোড়ে ডাক ছেড়ে সানিয়া রামুকে
কিছু একটা বলতে চায়। ছুটে যেতে চায় সানিয়ার কাছে রামুর কাছে। ছুটতে গেলেই
গলার দড়িতে টান লাগে। দড়ির মাথাটা ওপাশে সজোরে ধরে রেখেছে খালেক ভাইয়ের
ছেলে-মেয়েরা।
সময় নষ্ট
করতে চায়না সানিয়া রামু। কাউকে কিছু না বলেই রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সকাল দশটা বেজে গেছে। সেই গতকাল বিকেলের দুই কাপ চা ছাড়া পেটে এখনও পর্যন্ত
পরে নাই কিছু। এত কষ্ট করে এতটা পথ পেরিয়ে মহিষদুটিকে ঠিকঠাক পৌঁছে দেবার
পরও কোন কৃতজ্ঞতা জানায় না কেউই। রাগে, দুঃখে অভিমানে ক্ষুধার্ত পেটের
নাড়িভুঁড়ি সব যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। হন হন করে ছুটে চলে একরাশ অভিমান
নিয়ে। পেছন ফিরে একটিবারের জন্যও তাকায় না তারা। হাতিরাম ও তার সাথীর করুণ
ডাক কানে ভেসে আসে। সেই করুণ ডাকের মানে বোঝে সানিয়া রামু। মায়ায় জড়ানো
সেই ডাক যুদ্ধ করে চলে রাগ-দুঃখে ঢাকা পরা ভালোবাসার সাথে। অবশেষে পেছন
ফিরে একটিবারের জন্য তাকায় সানিয়া। অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে তারা। পেছনে পথের
ধুলোয় অদৃশ্য হয়েছে হাতিরাম ও তার সাথী।
সামনে
এবার পথহীন পথ। ঝোপঝাড় জঙ্গলের অলিগলি দিয়ে জলঢাকা নদীর চরের দেখা মেলে।
এই এলাকায় ডায়না মুর্তি জলঢাকারা বয়ে চলেছে নিজস্ব ছন্দে। তিনটি নদী এক নদী
হয়ে চলে গেছে সামনের দিকে। নদীর এপাড়ে আগে আসা হয়নি সানিয়ার। ওপাড়ের
গধেয়ার কুঠী, নাথুয়া তার পরিচিত। নাথুয়াতেই এক বাঁশ বাগানের গা ঘেঁষে
সানিয়াদের ছোট্ট কুঁড়েঘর। সেখানেই রয়েছে বাচ্চু ফুলমণি। সুদীর্ঘ চার বছর পর
বাড়ী পৌঁছাতে চলেছে সানিয়া। উত্তেজনায় পেটের খিদেও যেন মুখ লুকিয়েছে
জলঢাকার চরে। এ এলাকায় বন্য জীবজন্তুর দেখা মেলে খুব। একটু দূরেই ঘন জঙ্গল।
সেখান থেকে এসে হাতি, গন্ডার, বাইসনেরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায় নদীর চরে।
ওরা জল খায়, গা ভেজায়, পরিবার নিয়ে খুনসুটি করে। অনেক স্মৃতিই এভাবে এক এক
করে ভেসে ওঠে সানিয়ার চোখের সামনে। চৈত্রের শেষ। নদীতে জল নেই তেমন। কোথাও
এক হাঁটু আবার কোথাও এক কোমর। এ নদীর জল দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে
রামু। রঙবেরঙের পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা আয়নার কাঁচের মত জল দেখে রামু
ছুটতে থাকে নদীর উপর দিয়েই। সানিয়ার মনও আনন্দে ভরে ওঠে। ক্ষুদার্থ দুই
বালকের মুখে এমন হাসি ফুটিয়ে দিতে পেরে পাহাড় থেকে নেমে আসা এই অপরূপা
স্রোতস্বিনীর বুকটাও যেন গর্বে ভরে ওঠে।
নদীতে
স্নান করে গা শুকিয়ে ওপাড়ে ওঠে তারা। মৃদুমন্দ বাতাসের মত ফুরফুরে মন
সানিয়া রামুর। এভাবেই কিলোমিটার কয়েক হেঁটে এগিয়ে যায় তারা। সামনের ঘরবাড়ী
রাস্তাঘাটগুলি সানিয়ার ভীষণ চেনা। ওইতো ডুমকা কাকার বাড়ি, ওই তো শিমুল
গাছটা, ওই তো সোমারুদের জমি। শিমুল গাছের পাশের রাস্তাটা দিয়ে আধঘণ্টা
হাঁটলেই তো তার নিজের বাড়ি। শিমুল গাছটায় উঠলে উঠোনের আমগাছটা পরিষ্কার
দেখা যাবে। আর তর সয়না সানিয়ার। রামুকে নিয়ে ছুটতে শুরু করে জোরে। আবার
হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পরে একটা বড় বট গাছের নীচে। গাছের নীচে বসে থাকা একটা
ছেলে সানিয়া সানিয়া বলে ডেকে ওঠে। সানিয়া চিনতে পারে তাকে। সে যে তার খেলার
সাথী।
-আরে জটো তুই। তোক তো চিনায় যাছে না।
-তোকো না চিনা যাছে না। খবর পায়া আসিলো নাকি?
-ক্যানে? কি হইল আরো? বাচ্চু ফুলমণি বাড়ীত আছে রে?
-সবায় আছে। ফুলমণিক ও না জন্ডিস ধরিসে। খুব খারাপ অবস্থা উয়ার। যা তাড়াতাড়ি বাড়ি যা।
বুকটা
ধড়াস করে ওঠে সানিয়ার। তলপেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে। একরাশ হতাশা বুকে ঢুকে
পায়ের নীচের মাটিটা আলগা করে দেয়। থেমে যায় আবার ছোটবার ইচ্ছাশক্তিটুকু।
দুরুদুরু বুক নিয়ে ধীর গতিতে সানিয়া এগিয়ে চলে বাড়ির পথে।