শালসিঁড়ি-১১/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-১১
বিমল দেবনাথ
--------------------
নিলয় ও তাপস বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে গাউরটিকে ভালো করে দেখছিল- কোনদিক দিয়ে শুট করা যায়। যে পথে গাউরটি বাঁশঝাড়ে ঢুকেছিল ও বেরিয়েছিল সেই জায়গা দিয়ে গাউরটিকে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু শুট করার জন্য যুতসই পজিশন পাচ্ছিল না। বিকাশ দ্যাখে চারদিকে হাজার হাজার লোক যেন কোন এক বড় ম্যারাথান দৌড়ের স্টার্ট লাইনে দাঁড়িয়ে আছে- কখন গান শট হয়। চারদিকে যেন দৌড় শুরুর শেষ মুহূর্তের নীরবতা। একদিকে নিলয়ের নীরবতা হল গাউরটিকে সঠিকভাবে ট্র্যাংকুইলাইজিং করার জন্য মনসংযোগ একাগ্র করতে, অন্যদিকে হাজার হাজার লোকের নীরবতা যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রাক মুহূর্ত – ঝড় শুরুর আগের মতো। বিকাশের এটা স্বস্তি যে নিলয় বা জমায়েত হওয়া হাজার হাজার লোকের মধ্যে অনেকে জানে না সাবিত্রীর শরীরের অবস্থা এখন ঠিক কেমন।
নিলয়ের কাছে এখন পাখির চোখ হল বাঁশঝাড়ের গাউর। নিলয় জানে ওর বিফলতায় কী ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
বিকাশের কাঁধে এখন দুটি প্রাণ বাঁচানোর দায়। আমরা এই দুটি প্রাণকে দুইভাগে জানি। একজন মানুষ, সে রয়েছে জীবনরক্ষার পক্ষে। অন্যজনকে আমরা বন্যজন্তু বলি - সে আছে বধ্যভূমিতে।
বিকাশ বনের অভ্যন্তরের কোন প্রাণকে কখনো জন্তু বলে না। সবসময় বলে বন্যপ্রাণ। জন্তু তো বনের বাইরে অনেক জায়গায় থাকে- তাহলে শুধুমাত্র বনের প্রাণকে কেন শুধু জন্তু বলা হবে। বিকাশ বনের বাইরে অনেক প্রাণ দেখেছে যারা খুব হিংস্র এবং নিষ্ঠুর। এরা অন্যের প্রাণ নষ্ট করে নিজের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। নিজের লালসা চরিতার্থ করতে। বিকাশ বনের একটাও প্রাণ দ্যাখেনি যেটা মানুষের প্রতি হিংস্র এবং নিষ্ঠুর ব্যবহার করে। বনের প্রাণীগুলো বড় নিরীহ।
সাপ তার বিষ ব্যবহার করে তার খাদ্য জোগাড় করতে এবং খাদ্য হজম করতে। কখনো কখনো অন্য শিকারি-প্রাণীর থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষায় সাপ বিষ ব্যবহার করে। কিন্তু মানুষকে আক্রমণ করার জন্য বিষ ব্যবহার করে না। হাতির মস্ত মস্ত পা সৃষ্টি হয়েছে তার শরীরের ভার বহন করতে- মানুষকে পিষে মারার জন্য নয়। হাতির বড় বড় দাঁত সৃষ্টি হয়েছে খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য ও জল খোঁজার জন্য- মানুষকে আঘাত করার জন্য নয়। বাঘের শ্বদন্ত সৃষ্টি হয়েছে তার খাদ্যের হাড় থেকে মাংস ছেঁড়ার জন্য, পায়ের তীক্ষ্ণ নখ সৃষ্টি হয়েছে শিকার ধরার জন্য- কখনোই মানুষকে আক্রমণ করার জন্য নয়।
বন্যপ্রাণ মানুষের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। বন্যপ্রাণ মানুষের নিকট-সান্নিধ্য বা মানুষের অতি-উৎসাহে ভীত হয়ে কিছু দুর্ঘটনায় মানুষের সাথে জড়িয়ে যায়। আত্মরক্ষায় বন্যপ্রাণের সামান্য হরকৎ-এ মানুষের প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়। তাই বন্যপ্রাণকে মানুষের হিংস্র মনে হয়।কিন্তু সত্যিটা হলো বন্যপ্রাণদের কোন হিংসা-ই নাই; তাই হিংস্র হবার কথা নেই। ওদের ক্রোধ এবং ভাব হয় খাদ্য আর প্রজননের জন্য। মানুষ এই দুটির কোনটিতে বন্যপ্রাণীর পছন্দের নয়। কিন্তু মানুষের ক্রোধ রিপুতে রিপুতে। বিকাশ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি মাস্টারমশাই আজ কোন রিপুর বশীভূত হবে।
মাস্টারমশাই বা ওর সাঙ্গপাঙ্গ যদি দেশলাইবাক্সর মতো কাজ করে এবং সাবিত্রীর সঙ্কটজনক অবস্থা রটিয়ে দেয়; অপরদিকে নিলয় যদি গাউরকে ঘুম পাড়াতে ব্যর্থ হয়- মুহূর্তে পরিস্থিতি দাবানলের মত দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। বিকাশের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, গনগনে চোখে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
নিলয় শট করে। ফট্ করে শব্দ হয়। শটটি বাঁশের পাতায় লেগে বেঁকে গেল। টার্গেটে লাগল না। গাউরটি বাঁশঝাড়ে হঠাৎ শব্দ শুনে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিকাশের স্পষ্ট মনে পড়ে যায় কতগুলো ঘটনা…
একবার নিলয় একটা গাউরকে ট্র্যাংকুইলাইজ করে। শট খাওয়ার পর গাউরটি ১০০ মিটার স্প্রিন্ট দৌড়ের মতো ছুটতে শুরু করে। তখন মানসবাবু অন্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিসহ ক্রাউড কন্ট্রোল করছিল। সব মানুষের ঝোঁক ছিল গাউরের দিকে আর মানসবাবুদের জান কবুল ছিল ক্রাউড কন্ট্রোল করতে - দৃষ্টি ছিল লোকজনদের দিকে। পিছনে নিলয়রা কী করছিল - সে ভাবার সময় কোথায়? হঠাৎ মানসবাবু দেখতে পান যে সব লোকজন উল্টোদিকে পড়িমড়ি করে ছুটছে। ব্যপারটা কী ঘটল বোঝার জন্য পিছনে ঘুরতে যাবার মুহূর্তে গাউরটি মানসবাবুকে শিঙে তুলে নেয়। সে এক লোমহর্ষক দৃশ্য। গাউরের ডানদিকের শিঙ মানসবাবুর বাঁদিকের শার্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে আছে আর মানসবাবু ডানহাত দিয়ে গাউরের ডানদিকের শিঙ ধরে গাউরের মাথার সাথে ঝুলে আছে। সে এক ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। লোকজন নিরাপদ জায়গার আশ্রয় নিয়ে 'গেল গেল' রব তুলল। মানসবাবু তখন গাউরের মাথার সাথে ঝুলছেন। গাউরের গতিতে মানসবাবুর শার্ট ছিঁড়ে যায়। মানসবাবু তখন ষাঁড়-লড়াইয়ের ম্যাটাডরের মতো গাউরের ডান শিঙ ধরে ঝুলে থাকে আর গাউরটি যেমনতেমন ছুটতে থাকে। সবাই যে যার ইষ্টদেবতাকে ডাকতে থাকে। ঘোর বিপদে মানুষের মনে হয় এই রকমই হয়; কোন কথা মনে আসে না। হঠাৎ দেখা যায় গাউরটি তীব্র বেগে বাঁদিকের একটি কলাবাগানে ঢুকে যায়; মানসবাবু ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়। সবাই ছুটে যায় মানসবাবুর কাছে- মানসবাবু তখন সংজ্ঞাহীন। তাড়াতাড়ি চোখেমুখে জল দিয়ে সামান্য শুশ্রুষা করতেই মানসবাবুর জ্ঞান ফিরে আসে। একটু জল খেয়ে কিছুটা ঘোর কাটিয়ে উঠে বসে। তাপস হাত ধরতে গেলে নিজে উঠে দাঁড়ায়। ছেঁড়া জামাটা ঠিক করে। গাউরের শিঙ অল্পের জন্য মানসবাবুর বুককে এফোড়ওফোঁড় করে দেয়নি। গাউরের শিঙের ঘষা খেয়ে মানসবাবুর বাঁদিকের পাঁজর লাল হয়ে ফুলে আছে।
এক বয়স্কা মহিলা এসে বলে -
- বাবু, আপনের আর জন্তুর সাথে লড়াই কইরা লাভ নাই। আপনি আমাগো বাড়ি আহেন। আমাগো নিজের গরুর দুধ দিমু-গরম কইরা-খাইবেন চলেন।
মানসবাবু হেসে বলেন - না, না, তার দরকার হবে না; আমি ঠিক আছি। নিলয় তাড়াতাড়ি কর। দিন যে ফুরিয়ে এল।
এই হল শালসিঁড়ির সৈনিক। এই রকম কত শালসিঁড়ির সৈনিক প্রচারের আলো ছাড়া কাজ করে যায় দিনরাত্রি।
সবাই আবার নেমে পড়ে গাউরটিকে ট্র্যাংকুইলাইজ করতে। শেষে গাউরটিকে ট্র্যাংকুইলাইজ করে সবাই যখন গ্রামটি ছাড়ছিল, গ্রামবাসীদের সবাই করতালি দিচ্ছিল মহা আনন্দে; তখন মনে হচ্ছিল বিকাশরা যেন অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল পেয়েছে। এই রকম কিছু ঘটনা শালসিঁড়ির সৈনিকদের অনুপ্রাণিত করে আরও আরও বেশি করে পরিষেবা দিতে।
বিকাশের মনে পড়ে একবার দুটি গাউর একটা গ্রামের ভুট্টাখেতে ঢুকে পড়েছিল। গ্রামটিতে একরের-পর-একর ভুট্টা চাষ হয়েছে। গাউরদুটি ভুট্টাখেতে শান্তিতে ছিল। কিন্তু চারদিক থেকে ছুটে আসা লোকজনের হৈ-হট্টগোলে গাউরদুটি দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটতে থাকে ভুট্টাখেতের মধ্যে। একমাত্র শষ্য নষ্ট হয়ে যাবার জন্যে গ্রামবাসীরা ক্ষোভে ফুটছিল টগবগ করে। নিলয়রা সেখানে গিয়ে কিছুতেই কিছু যুত করতে পারছিল না। প্রথমত ৭-৮ ফুট লম্বা ভুট্টাখেতে গাউরটিকে একদম দেখা যাচ্ছিল না। তার উপর ভুট্টাখেতে গাউরের সামনা-সামনি যাওয়া খুব মুশকিল; কারণ ভুট্টাগাছ এত নরম যে তাকে ঢাল করা যায় না। তার উপর গ্রামবাসীরা কিছুতেই ভুট্টাখেতে কোন রকম গাড়ী ঢুকতে দেবে না। বাধ্য হয়ে নিলয়রা সবাই মিলে ভুট্টাখেতের চারদিক ঘিরে রাখে। গ্রামবাসীরা উত্যক্ত করতে থাকে কর্মচারীদের। খবর যায় বিকাশের কাছে। বিকাশ এসে দেখে যে ভুট্টাখেতের মধ্যে বিশেষ গাড়ি ঢোকালেও লাভ হবে না। কারণ গাড়ির শব্দে গাউর অন্যদিকে সরে যাবে। ট্র্যাংকুইলাইজিং করা যাবে না। একমাত্র উপায় এলাকাটি জনশূন্য করে দেওয়া। বিকাশ সাধারণ প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে ঐ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করায়। ১৪৪ ধারা জারি করার সাথে সাথে গ্রামবাসীরা বিকাশকে ঘিরে ধরে দাবি তোলে -
- যতক্ষণ এখানে বাসইন থাকবে আপনাদেরকে এইখানে থাকতে হবে।
- ঠিক আছে। আমরা থাকব।
এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসে। গ্রামবাসীরা অখুশি হয়ে ফিরে যায় যে যার ঘরে।
সেবার নিলয়রা সারারাত্রি ঐ গ্রামে অতন্দ্রিলার মত গাউর পাহারা দেয়। গ্রামের একটি মানুষও নিলয়দের খবর নেয়নি। উপরন্তু মাঝে মধ্যে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে অশ্রাব্য শব্দ ভেসে আসে নিলয়তাপসনির্মলবাবুদের উদ্দেশ্যে। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে নির্মলবাবুরা ভুট্টাখেতের চারপাশে ঘুরে দ্যাখে। নির্মলবাবুরা দেখতে পায় দুটি গাউরের খুরের ছাপ ঐ ভুট্টাখেত থেকে বনের দিকে চলে গেছে। নিলয়-তাপসরা ভালো করে দেখে বুঝতে পারে যে গাউরদুটি সবার অজান্তে ২ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে যেভাবে এই গ্রামে এসেছিল ঠিক সেইভাবে সবার অগোচরে গ্রাম ছেড়ে ফিরে গেছে বনে।
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতেই আবার গ্রামবাসীরা জড়ো হতে শুরু করে।
বিকাশ বলে-গাউর এই গ্রামে নাই। বনে ফিরে গেছে।
গ্রামবাসী বিশ্বাস করতে নারাজ।
সবাই দাবী করে - নাই তো বুঝব কী করে। সবাই ভুট্টাখতে ঢুকে খুঁজে দেখান। তারপর ছাড়ব আপনাদের।
এরকম গন্ডগোলের মধ্যে গ্রামবাসীরা প্রায় ঠেলে কর্মচারীদের ভুট্টা খেতে ঢুকিয়ে দেয়। নির্মলবাবুরা সব ভুট্টাখেত খুঁজে জখম না হয়ে বেঁচে ফিরে এসে প্রমাণ করে যে গাউর নেই- তারপর সেবার ছাড়া পায়।
এইরকম নানা ভালোকথা খারাপকথা বিকাশের মনে আসতে থাকে। হাতিবাঘচিতাবাঘভাল্লুক কত কী বন্যপ্রাণ উদ্ধার করতে গিয়ে কত কী অভিজ্ঞতা হয়। বিকাশের সাবিত্রীর জন্য চিন্তা হয়। বিকাশের মনে পড়ে রমেশের কথা-
- ডাক্তারবাবু, কেমন দেখলেন রমেশকে?
- কি আর বলব। তার তো পেটকেটে সব নাড়িভুঁড়ি বেরিয়েছিল।
- সে তো দেখিনি!!!
- সে দেখবেন কি করে। বস্তা দিয়ে এমন ভাবে বেঁধে দিয়েছে যে বাইর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না।
বিকাশ ভাবে - তাই তো। বনের গহনে কোথায় ব্যান্ডেজ পাবে তারা। হাতির রেশনের বস্তাই ওদের অনেক কাজের ভরসা।
- ডাক্তারবাবু, রমেশ বাঁচবে তো?
- মিরাক্যাল মশাই, মিরাক্যাল। রমেশের পেটটা যেন কেউ স্ক্যাল্পেল দিয়ে কেটে দিয়েছিল আর তাতে সব নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসে। তবে মেজর ইনজুরি কোন অর্গানে হয়নি। ছেলেটির ফিজিক খুব ভালো।
বিকাশ জানে গাউর, হরিণ ইত্যাদির খুরের ধার যেন স্ক্যাল্পেল থেকেও বেশি। এই খুর যদি কারো শরীরে জোরে আঘাত করে তাহলে তার শরীর ছিন্ন- ভিন্ন হয়ে যাবে। আর যদি হালকাভাবে ছুঁয়ে যায় তখন রমেশের মত অবস্থা হয়।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করেন - আচ্ছা, রমেশের কেসটা পুলিশ কেস নয় তো?
- না, না। ওকে গাউর অজান্তে আঘাত করে।
- কী ভাবে?
- রমেশ একজন মাহুত। মাহুতরা বনে হাতি ছেড়ে, হাতির পিঠ থেকে নেমে হাতির জন্য ঘাস কাটে। সেই ঘাসবনে গাউরও থাকে। হঠাৎ শব্দ শুনে গাউরা ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করে। সেইরকম একটি গাউরকে ছুটে আসতে দেখে রমেশ শুয়ে পড়ে। বনের অভ্যন্তরে নানা সংকটের মুহূর্ত মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বনের কর্মীদের এইরকম স্নায়ুশক্তি যোগায়। নচেৎ ঐরকম ছুটন্ত গাউর দেখে কোন মানুষের মাথা ঠিক রাখার কথা নয়।
- স্ট্রেঞ্জ!
- প্রতিনিয়ত এই রকমের অনেক ঘটনা ঘটে।
- আপনাদের বনে তো দেখছি প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ লেগে আছে…
যুদ্ধের কথা মনে হতেই বিকাশ নিলয়কে দেখে…ভাবে আজ যেন আবার একটা মিরাক্যাল হয়। সাবিত্রী যেন বেঁচে যায়।
নিলয় পাখির চোখ দেখার মত গাউর দেখে শুট করে।
বিকাশ জিজ্ঞাসা করে –
- লাগলো?
- হ্যাঁ, স্যার।
- কাউকে বুঝতে দিও না। বুঝতে পারলে এখুনিই সব ছুটতে শুরু করবে।
- ঠিক, স্যার।
- গাউরের দিকে নজর রাখ।
- গাউরটি ডার্ট হবার পর আমার দিকে ঘুরে গেল।
- ডার্টের সময় নোট করেছ।
- হ্যাঁ, স্যার।
ডার্টের রাসায়নিক একটা সময় পর কাজ করতে শুরু করবে। এই রাসায়নিকের কার্যকারিতা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বজায় থাকে। তারপর গাউর আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই ডার্ট করার পর ডার্ট-পরবর্তী কাজকর্ম করার সময়টা খুব সীমিত। ডাক্তারবাবু, বিকাশ গাউরটিকে চুপচাপ খুব সাবধানে দ্যাখে। বাঁশঝাড়টি বেশ বড় বলে জায়গাটা একটু ছায়াঘন ও ঠান্ডা। গ্রামের একপ্রান্তে বলে লোকজনও খনিকটা দূরে আছে। তাই আপাতত রক্ষা।
একবার নিলয় এক গ্রামে সুপারিবাগানে একটি গাউরকে ডার্ট করেছিলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে গাউরটি বসে পড়েছিল। কিন্তু যখন গাউরটি বসে লোকজন এমন হুমড়ি খেয়ে পড়ল যে গাউরের আচ্ছন্নতা কেটে গেল। গাউর উঠে দাঁড়ায়, আর তক্ষণই লোকজন এমন ভাবে পালাতে শুরু করে যে গাউর ওদের পিছু নিতে চায়। কিন্তু গাউর দৌড়াতে পারে না; রাসায়নিকের কার্যকারিতা শুরু হয়ে গ্যাছে। গাউরটি কিছুদূর গিয়ে আবার বসে পড়ে। গাউরটি ঘুমাতে চায় – ঘুমাতে পারে না। হাজার লোকের চিৎকার গাউরের ঘুমের বিঘ্ন ঘটায়। এই এক দুর্বিসহ অবস্থা। ঘুমের ওষুধ খাওয়া হলো কিন্তু নীরবতা পাওয়া গেল না, কানের কাছে মাইক্যাল জ্যাকসন চালিয়ে দেওয়া হলে; কেমন লাগবে? ঘুম আসবে? আসবেনা। গাউরের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়। তাই ট্র্যাংকুইলাজেশনের পর নীরবতার প্রয়োজন হয়- রাসায়নিকের কাজ করবার জন্য। নাহলে ঐরকম জরুরীকালীন পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত বুস্টার ডোজ দিতে হয়- বন্যপ্রাণকে ঘুম পাড়ানোর জন্য; যেটা কিনা প্রাণঘাতীও হতে পারে। সেবার নিলয়কে বুস্টার ডোজ দিতে হয়েছিল গাউরটিকে।
বিকাশ জিজ্ঞাসা করে-
- নিলয়, কী অবস্থা?
- এখন ঠিক আছে।
- বুস্টার লাগবে।
- না মনে হয়।
- এরপর ডার্ট বানাতে অসুবিধা হলে কান চুলকাবে; তাহলে সব মনে পড়ে যাবে।
- হ্যাঁ, স্যার।
- তাহলে বল; জল সবসময় জলে যায় না। ব্যারেলের খালি জায়গা ভর্তি করে ডার্ট বানাতেও কাজে লাগে…কারণ এই রাসায়নিক কাজ করে রাসায়নিকের ভরের পরিমাপের উপর…
বলতে বলতে গাউরের নাক ডাকার ঘ-র-র-র ঘ-র-র-র শব্দ শোনা যায়। নির্মলবাবুরা রেডি ছিল সরঞ্জাম নিয়ে।
- শুরু করলাম,স্যার।
- হুম; জলদি জলদি।
নির্মলবাবুদের বাঁশঝাড়ে ঢুকতে দেখে সব লোকজন চাকভাঙা মৌমাছির মতো উড়ে এল বাঁশঝাড়ের কাছে। পারলে ওরা বাঁশঝাড় উপড়ে ফেলে। আজকে অন্তত বাঁশঝাড়টি গাউরটিকে বাঁচালো হাজার লোকের বিষনিঃশ্বাস থেকে। নিলয় গাউরের পিছনের থাই থেকে ডার্ট টেনে খুলে নিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। নির্মলবাবু একটা সবুজ ভিজা কাপড় দিয়ে গাউরের চোখ ঢেকে দেয়। তাপসরা তাড়াতাড়ি সামনের পা ও পিছনের পা বেঁধে ফেলে। বাঁশঝড়ের মধ্যে কাজ চলে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। গাউরটিকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ওঠাতে হবে পরিবহণ গাড়িতে। লোড হলেই ছুটতে হবে বনের পথে প্রাণ বাঁচাতে… নির্মলবাবু চিৎকার করে বলে-গাড়িটা এখানে লাগাও...এইভাবে লাগাও…
বিকাশের কাছে ফোন আসে-হ্যালো, হ্যালো… হ্যাঁ … সাবিত্রী…কী হয়েছে…
মাষ্টারমশাইরা ঘিরে রাখে বিকাশকে…
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴