সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
10-January,2023 - Tuesday ✍️ By- অমিত কুমার দে 729

মনোময় মানসে

মনোময় মানসে
অমিত কুমার দে
=============

মানস নদী ডাকছিল, মানসের বনজঙ্গল ডাকছিল। অনেকদিন ধরে। এর ওর তার কাছ থেকে মানসের গল্প শুনে শুনে ডাকটা আরো গাঢ় হচ্ছিল। প্রিয়জন সুদীপ-রীনা মজুমদার, বন্ধু সঞ্জীব চক্কোত্তির পোস্টানো ছবি দেখে দেখে লোভ বাড়ছিল। ইউ-টিউবার শুভঙ্কর পারিধার পাঠানো ভিডিও আরো উস্কে দিল মানস যাবার ইচ্ছেটাকে। সকলের সঙ্গেই চলভাষে মানস নিয়ে বিস্তর কথা হল। কিন্তু সময় মিলছিল না। একবার বৃষ্টি বন্যায় বাদ পড়ে গেছিল। আর একবার হঠাৎ কাজের চাপে। বাইশ সালের শেষাশেষি জেদ ধরে বসলাম, যেভাবেই হোক মানস জাতীয় উদ্যান ঘুরে আসবই।
খুব ইচ্ছে ডুয়ার্সের কুয়াশা কুয়াশা সকালে আবছায়া ফুঁড়ে এগিয়ে যাব নিজে স্টিয়ারিং ধরে। তারপর বারোবিশা ছাড়িয়ে সাতাশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে শীতের আসাম দেখতে দেখতে গোসাইগাঁও বঙ্গাইগাঁও পেরিয়ে পৌঁছে যাব বরপেটা রোড।
ঘরনী যথারীতি বাধ সাধলেন, এত দূর রাস্তা একা একা ড্রাইভ করা চলবে না। জেদাজেদিতে আবার মানস যাওয়া বানচাল হয় আর কি! পঁচিশে ডিসেম্বর আমার প্রথম কর্মস্থল নাথুয়ায় একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে দাদা-বৌদি জীবন ও কণিকা সরকারকে রাজি করিয়ে ফেললাম। তারপর বইমেলার স্টল গুটিয়ে ২৯ ডিসেম্বর সকালে বেরিয়ে পড়লাম।

বন্ধু সঞ্জীব দিয়েছে ময়ূরী নেচার ক্যাম্পের রঞ্জন গর্গের নম্বর। রওনা হবার আগে তাকে ফোন করে দুখানা ঘরের বন্দোবস্ত, হাতি সাফারি ও জিপ সাফারির ব্যবস্থা করে রাখলাম।
বরপেটা রোডের ভিড় আর জ্যাম ছাড়াতেই বন-বন গন্ধ! একটা নদী যেন বলে দিচ্ছে – আর একটু! দু নম্বর গেটের সামনে থেকে ডান দিকে টার্ন নিতেই ডানে চা-বাগান, বাঁয়ে অরণ্য। পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা একটা। রঞ্জন ভুইয়াপাড়া রেঞ্জে জিপ সাফারির ব্যবস্থা করে রেখেছে। ডোমনিক গয়ারি তার পুরনো জিপ নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। এক রাভা বসতির মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে যেতে ডোমনিক আসামের গল্প শোনাচ্ছিল। বনে ঢুকবার আগেই বিপত্তি। টায়ার পাঙ্কচার্ড! দক্ষ হাতে খুব তাড়াতাড়ি সারিয়ে নিল। আমি সেই অবসরে প্রায় অবলুপ্ত আসামের মাটি লেপা বাঁশের গুটিকয় ঘর দেখে নিচ্ছিলাম। বয়স্ক মেয়েরা ট্রাডিশনাল পোশাকে, নতুনরা জিন্স টপ পরে বুনো রাস্তায় যাচ্ছে, কে জানে কোথায়!
ভুইয়াপাড়ার গেটে গান-ম্যান উঠলেন। তারপরই জঙ্গুলে পথ। প্রচুর বুলবুলি পাখি জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে, ডানা মেলছে। নাম না জানা অনেক পাখি উড়ছে। মাঝে মাঝে জন্তুর গায়ের বোটকা গন্ধ। জীবনদা বললেন – “এত বড় বড় ঘাসে আমরা ওদের দেখতে না পেলেও ওরা ঠিক আমাদের দেখছে!” হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষল। রাস্তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে এক পূর্ণবয়স্ক দাঁতাল। আমাদের দিকেই স্থির তাকিয়ে। পাশে সঙ্গী সাথীও আছে। নেহাত অনিচ্ছাতেই পথ ছেড়ে ঘাসজঙ্গলে হেলতে দুলতে চলে গেল। মনে হচ্ছিল আমাদের দেখে পড়ন্ত বেলায় নিতান্তই বিরক্ত তিনি! কতটা বিরক্ত তা বুঝেছিলাম ফিরবার পথে! আমরা কোনো ঝামেলা না করাতেও তিনি তেড়ে আসলেন আমাদের জিপের দিকে। জিপের পেছনে অনেকটা পথ ছুটেও এলেন এবং একটা পিলে চমকানো হাঁক ছেড়ে ক্ষান্ত দিলেন!
দইমারি ক্যাম্পে গিয়ে প্রশান্তিতে মন ভরে গিয়েছিল। একটা তিরতিরে নদী। তীরে বাঘের পায়ের ছাপ। একটু দূরেই ভুটান পাহাড়। নিঝুম বিকেল বুকের মধ্যিখানে কেমন ঢুকে পড়ল। ফিরে আসতে ইচ্ছেই করছিল না। ফেরার সময় দিক-দিগন্ত অবশ করে দিয়ে ময়ূর ডাকছিল সব দিক থেকে। দেখা মিলল একটা বুনো শূকরের। উড়ে গেল কয়েকটা ধনেশ পাখি। দইমারীর এবং ভুইয়াপাড়ার অপরাহ্ণটা একটা গভীর সনেটের মতো বুকে গেঁথে থাকল!
মানসে এসে আবার টের পেলাম আসামের অনবদ্য আতিথেয়তা। অসামান্য রান্না। পরিবেশনেও যে কত আন্তরিক হওয়া যায় তা মনে থাকবে বহুদিন। দু নম্বর গেটের উল্টোদিকের চা-দোকানের তিল মেশানো বেকারির বিস্কুট, একটু পাশেই কূল নাথ-এর কাঁচা গুয়া-পানের স্বাদ কোনোদিন ভোলা যাবে!

১৯২৮-এর পহেলা অক্টোবর মানস অভয়ারণ্যের (Sanctuary) স্বীকৃতি পেয়েছিল, ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে। কোচবিহার ও গৌরীপুরের রাজারা এখানে আসতেন শিকার করতে। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো একে World Heritage Site হিসেবে ঘোষণা করে। পোচিং এবং জঙ্গী কার্যকলাপের জন্য ১৯৯২ সালে ইউনেস্কো একে World Heritage Site in danger তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১১-এর ২১ জুন সেই বিপদ তালিকা থেকে মুক্ত হয়ে মানস এখন আনন্দময় জাতীয় উদ্যান। এখন ৫০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি এলাকা নিয়ে গাছ, ঘাসঝোপ, হাতি গন্ডার হরিণ ওয়াইল্ড ওয়াটার বাফেলো জায়ান্ট স্কুইরেল রুফড টার্টেল গোল্ডেন ক্যাপড লেঙ্গুর পিগমি হগ গ্রেট হর্ণবিল ইত্যাদি ইত্যাদি সহ মানসের ভরা সংসার। বেড়াতে গেলে কখনো কখনো ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের দেখা মেলে। না মিললেও ঘাসজঙ্গলে তাকিয়ে তাদের খোঁজার রোমাঞ্চটাও কম নয়!

দ্বিতীয় দিন আমরা ভোরে চললাম হাতি সাফারিতে। যার পিঠে বসলাম তার নাম মীরা, সঙ্গে তার দুষ্টু মিষ্টি ছেলে বুধুয়া। নাগেশ্বর নামে ৩২ বছর কাজ করা এক্সপার্ট মাহুত। এক ঘন্টা ঘাসবনে ঘুরে বেড়ালাম, সকালের টাটকা রোদ সব অন্যরকম করে রেখেছিল। ঝাঁপ দিয়ে ঝোপ পেরোল হরিণী। বুধুয়ার কীর্তিকলাপ দেখতে দেখতে মন ভরে যাচ্ছিল। পরে মীরার পিঠ থেকে নেমে তাকে আদরও করা গেল কিছুক্ষণ, যদিও সে ব্যস্ত ছিল মায়ের দুধ খাওয়া-তে। মীরা স্নেহময়ী মায়ের মতো আমার দিকে বাড়িয়ে দিল তার লম্বা শুঁড়, স্পর্শ করে থাকল খানিক।
আমি ভাবছিলাম, কীভাবে কোথায় কার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় কে আর আগাম জানে!
আন্তর্জাতিক সীমানা বলে গেটের দায়িত্বে বিএসএফ জওয়ানেরা। আমার জন্ম-জেলার দুই তরুণ  সেদিনের গেট-দায়িত্বে – ইলিয়াস মামুদ ও অমিত কুমার দাস। খুব খাতির হয়ে গেল তাদের সঙ্গে। ভুটান থেকে গাড়ি বোঝাই কমলা আসছে।
নেচার ক্যাম্পে আমাদের ঘরে ফিরে একটু সাজুগুজু করে, গরম গরম লুচি ডিম ডাল খেয়েই সারাদিনের সাফারিতে বেরিয়ে পড়া। আজ বাঁশবাড়ি রেঞ্জ ও মাথানগুড়ি হয়ে রয়্যাল ভুটান। গেটে ঢুকতেই বাঁদিকে একঝাঁক ময়ূর ময়ূরী। জীবনে কোনোদিন এত ময়ূর-ময়ূরী একসঙ্গে দেখা হয়নি! সঙ্গে বন্ধুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু তাগড়াই মোরগ এবং আরো কত পাখি। ক্যামেরা বাগাতেই তারা অনেকেই পোজ দিয়ে গেল!
তারপর ধুলোওড়া জঙ্গুলে পথে গোটা দিন বুনোদের খুঁজে বেড়ানো। গান-ম্যান দয়াল পাঠক কখন যেন আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেল। ড্রাইভার ডোমনিক তো মন চুরি করেই নিয়েছে। অল্প কথা বলে, কিন্তু মুখ জোড়া আসামের সরল সাদা-সাপ্টা হাসি! হেলেদুলে ঘাস খেয়ে চলেছে বুনো বাফেলো, আমাদের খুব একটা পাত্তাও দিল না।
বেকি নদী আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ভুটানে চলল! তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমাদের তিস্তার আপন বোন! নীল জল কী স্নিগ্ধ। নদীতীরে ঘাস চিবিয়ে চলেছে বাফেলো। দয়াল দেখাল – “ ওই দেখুন ভুটান রাজার অবসর কাটানোর প্রাসাদ!” নদীর ওপাড়ে জঙ্গুলে পরিবেশে রাজকীয় আয়োজন! আমি আর কী করতে পারি রাজাদের হিংসে করা ছাড়া!
অপরূপ পথ পেরিয়ে ভুটানের পানবং সেতুতে গিয়ে থামলাম। ২০১৪-র ১০ এপ্রিল ভুটানের রাজা জিগমে খেসর নামজেল ওয়াংচুক এই সেতুর উদ্বোধন করেছেন। বড় লোহা কংক্রিটের ব্রিজের পাশেই দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু। এক কথায় – দারুণ! ভুটানি বাচ্চা মেয়েরা বসে আছে চা মো-মো ট্রাডিশনাল খাবার নিয়ে। সামনে যেতেই আমরা পাকড়াও। খেতেই হবে। তেজপাতা দেওয়া চায়ে চুমুক দিতেই অদ্ভুত ভালোলাগা। সহজ সরল প্রবীণ ভুটানি মানুষ ঝুড়ি ভরে কমলা নিয়ে নেমেছেন। সদ্য ছেঁড়া। আমরা খেলাম, কিনলাম অনেক অনেক!
হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম তিরন্দাজি প্রতিযোগিতার আসরে। জমে উঠেছে লক্ষ্যভেদের কম্পিটিশান! সঠিক নিশানায় তির লাগলেই দলগত ভুটানি গান নাচ।
গেলাম একটা ছোট্ট বাজারে। ঘরের সামনে পসরা সাজানো। দয়াল ও ডোমনিক ঢুকে গেল ভুটানের পানীয় কিনতে। আমাকে বলল – “স্যার, এখানে ভুটানে তৈরি উৎকৃষ্ট মদের দাম খুব কম! কিনতে পারেন!!”

ফিরতি পথে আবার বন। গন্ডারের দেখা না মেলার আক্ষেপ জীবনদা ও সকলের। ডোমনিকের আপ্রাণ চেষ্টা – গন্ডার দেখাতেই হবে। সূর্য প্রায় ডুবছে। আমরা পৌছলাম বুড়াবুড়ি ক্যাম্পে। যেন আমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে রয়েছে গন্ডার যুগল! হেলে-দুলে রিলাক্সড মুডে। যেন বলছে – “লাইট ফুরিয়ে আসছে, জলদি ফোটো তোলো!!”
একের পর এক ছবি তুলতে তুলতে জীবনদা বললেন – “অসামান্য একটা ট্যুর হল।”
দিনের সব আলো নিবিয়ে দিয়ে পাখিরা তখন তাদের ঘরে ফিরছে!

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri