বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-১১/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং
পর্ব-১১
ড. রূপন সরকার
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির প্রভাব সরাসরি গিয়ে পরে দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে। ১৮৩৫ সালে অধিগ্রহণের সময় দার্জিলিং ছিল একটি গ্রামমাত্র। সর্বসাকুল্যে ২০টি পরিবার মিলে কমবেশি ১০০ জনের বসবাস। এই মানুষগুলির বেশিরভাগই ছিল কৃষিজীবী। সমগ্র অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলময়। ঘন জঙ্গল, অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রতিকূল পরিবেশের কারণেই হয়তো এই অঞ্চলে লক্ষণীয়ভাবে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে নি। কিন্তু ব্রিটিশ অধিগ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যেই চিত্রটা পাল্টে যায়। ব্রিটিশ অধিগ্রহণ ও স্বাস্থ্যনিবাস ঘোষণা, স্থানীয় মানুষের কাছে একটি সুযোগ এনে দেয়। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষেরা দলে দলে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের পার্বত্য শহরগুলির মধ্যে শিমলার পরেই দার্জিলিং শহর জায়গা করে নেয়। দার্জিলিংকে ইউরোপীয় শহরের মতো গড়ে তুলতে কোম্পানি কোন কার্পণ্য করে নি। ফলে শুরু থেকেই শহর যত বাসযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে নিকট দূর নানা স্থান থেকে বৈচিত্রময় মানুষের ঢল নেমে আসে এই শৈল শহরে। ফলস্বরুপ ১৮৭২ সালের প্রথম জনগণনায় দেখা যায় দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,১৫৭ জন। এই জানগণনায় আরো দেখা যায় এখানে প্রায় ৬৩টি জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। এর মধ্যে শতকরা ৬১টি জন ছিল নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষ। ২৭ জন রাজবংশী, ওঁড়াও, মালপাহাড়ি, মুন্ডা, সাঁওতাল এবং লেপচা এবং ১ জন তিব্বতি। অবশিষ্টরা তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দু, মুসলমান এবং ইউরোপীয়। কোচ, মেচ, ধীমাল, মাড়োয়াড়ি, ফিরিঙ্গি, আদিবাসী নিয়ে দার্জিলিং ছিল বৈচিত্রময় মানুষের এক আজব কারখানা।
মনে রাখতে হবে জনসংখ্যার এই উচ্চলম্ফন ঘটে যায় দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথ নির্মাণের পূর্বেই। সহজেই অনুমেয় দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলপথ চালু হওয়ার আরামদায়ক যাত্রার পর চিত্রটা কেমন দাঁড়াবে, হয়েছিলও তাই। দার্জিলিংয়ের সাথে বাংলার অন্যান্য জেলার ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, আর্থ-সামাজিক কাঠামো, রীতিনীতি ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। এর সাথে সাথে পঞ্চাশের দশক থেকে গড়ে ওঠে একের পর এক চা-বাগান। ফলে দার্জিলিং হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির এক চলমান পরীক্ষাগার। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে পরিলক্ষিত হয়। ফলে ১৮৭২ সাল থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭,০১৮ জন, অর্থাৎ ১০০% বৃদ্ধি ঘটে। ৫০ মাইল দীর্ঘ দার্জিলিং - হিমালয়ান রেলওয়ে চালু হওয়ায় এক দশকের মধ্যে, অর্থাৎ ১৮৮১ থেকে ১৮৯১ সালের মধ্যে শহরের জনসংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৪,১৪৫ জন। কিন্তু পরবর্তী দশকে বৃদ্ধিতে ভাটার টান পরে এবং মাত্র ২০% বৃদ্ধি পেয়ে শহরের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৬,৯২৪ জন। জনসংখ্যা বিস্তারে স্থবিরতার পেছনে শহরের ব্যয়বহুল জীবন যাপন এবং নতুন করে জনবসতি বিস্তারে স্থানাভাবকে দায়ী করা হয়। উনবিংশ শতকের শেষলগ্ন পর্যন্ত দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যার চিত্রটি ছিল এমনই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴