বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব - এগারো
মিশা ঘোষাল
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
টোটো ঘর : 'নাইকোসা' ও 'দেংসা'
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ঐতিহ্যবাহী
আদিম টোটোঘরগুলিকে (traditional Toto Cottage ) টোটো ভাষায় বলা হয়
'দেংসা'। এই 'দেংসা' বা 'টোটো-ঘর' হল প্রকৃতির অকৃত্রিম উপাদানে তৈরি এক
আদিম ঐতিহ্যের স্বাক্ষর ! এক আশ্চর্য শৈল্পিক সম্ভারে সৃষ্টি টোটোদের
নিজেদের হাতে তৈরি এক স্বতন্ত্র ঘরের নক্সা !
টোটোদের
একরাশ ভালোবাসা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এই টোটোঘরগুলি প্রকৃতির কোলে। এ এক
ভালোবাসার আস্তানা টোটোজনজাতির, আদিম প্রজন্মের স্বাক্ষর বহন করে দাঁড়িয়ে
আছে আজও এই 'নাইকোসা'গুলি !
টোটোভাষায়
'নাইকোসা' ও 'দেংসা' শব্দ দুটির অর্থ প্রায় সমার্থক হলেও এ বিষয়ে ক্ষেত্র
সমীক্ষা করতে গিয়ে বুঝেছি যে, 'নাইকোসা' ও 'দেংসা' শব্দ দুটির অর্থ এক
হলেও, কোথাও যেন একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়ে গেছে এই শব্দ দুটির গভীরে !
ধনীদার
(ধনীরাম টোটো) বক্তব্য হল, "টোটোঘর হল 'দেংসা', যা টোটোদের আদিম ঐতিহ্যের
অমূল্য নিদর্শন ; যা আজকাল টোটোপাড়ায় খুব একটা চোখে পড়ে না।"
এই
"দেংসা'ও খড়, কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি। "নাইকোসা"ও টোটোঘর। একই উপাদানে তৈরি
এই 'নাইকোসা'। খড়, কাঠ ও বাঁশ হল 'নাইকোসা' তৈরির মূল উপকরণ।
সনের (সনে টোটো) কাছে শুনেছি,"যাহাই 'দেংসা', তাহাই 'নাইকোসা'।" অর্থাৎ 'নাইকোসা' ও 'দেংসা' একই 'টোটোঘর' ।
টোটো
ভাষায় 'নাই' মানে 'খড়'। 'কোসা' বা 'সা' হল ঘর। তোর্ষা নদীর পাড় থেকে বয়ে
আনা হয় এই 'নাই' । নদীর চরে জন্মানো কাশ-বন থেকে কাশিয়ার খড় (নাই) নিয়ে
এসে, শুকিয়ে,তা দিয়ে এই বিশেষ প্রকারের 'ঘরের চাল' তৈরি করা হয়। তারপর
একটি বিশেষ গাছের কাঠের খুঁটি দিয়ে এই ঘরের ভিত মজবুত করা হয়। 'খয়ের' গাছের
কাঠের খুঁটি এই টোটোঘর বা 'নাইকোসা'র মূল উপাদান। প্রথমটায় খয়েরের খুঁটি
মাটিতে অনেকটা গর্ত করে পুঁতে দেওয়া হয়। তারপর 'শাল' বা 'খয়েরে'র বাটাম
দিয়ে এই খুঁটিগুলিকে চারপাশ থেকে আটকে দেওয়া হয়। 'খয়ের' গাছের পুরাট
(matured ) খুঁটি বেশ শক্তপোক্ত হয়। তারপর পাঁকা বাঁশ চিরে পাটাতন
বানিয়ে,মাটি থেকে দুই বা তিন ফুট উঁচুতে মেঝের আকারে বিছিয়ে দেওয়া হয়।
প্রকৃতির সবুজ গালিচায় দাঁড়িয়ে থাকা এই টোটোঘরগুলি দূর থেকে দেখতে অসাধারণ
সুন্দর লাগে দেখতে !
আদিম ঐতিহ্যবাহী এই টোটো ঘরগুলিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয়, সত্যিই এটি কোনো শিল্পীর আঁকা নিপুণ ক্যানভাস, অনবদ্য এক সৃষ্টি !
টোটোদের এই আশ্রয়স্থল নির্মিত হয় অরণ্যের গহীনে, যা মনুষ্য বসতির এক আদিম কায়দা, যা অতি নির্মল ও সুন্দর চিত্র !
এত
সাধারণ উপাদানগুলি দিয়ে নির্মিত হয় এই টোটো ঘরগুলি যে আসলে টোটোপাড়ার মতো
দূর্যোগপূর্ণ এলাকার জন্য এইরকমের ঘর একটি যথোপযুক্ত নির্মাণ !
ঝড়,
বৃষ্টি, বজ্রপাত ও ভূকম্পনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার এক অভূতপূর্ব উপায় হল
এই আশ্রয়স্থল যা টোটোঘর বা 'দেংসা' নামে পরিচিত, যা একমাত্র টোটোপাড়াতেই
দেখা যায়।
কালের ছোঁয়ায় বর্তমানে এই টোটো
ঘরগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে ! এখন টোটোপাড়াতে আজকাল কংক্রিটের বাড়িতে থাকতে
শুরু করেছে টোটোরা। আধুনিকতার ছোঁয়া এখন এই প্রত্যন্ত গ্রামেও। ইট, বালি,
সিমেন্ট ও লোহার রড দিয়ে তৈরি হচ্ছে টোটোদের বাড়ি এখন টোটোপাড়ায়। এই পাকা
বাড়ি নির্মাণে সরকারি সাহায্যও মিলছে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ এই
টোটোঘরগলি ! এই 'দেংসা' এখন টোটো সমাজের অতীতের কালগ্রাসে। টোটোদের
বর্তমানে প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা অনেকেই আর এই প্রাচীন টোটোঘরে থাকতে পছন্দ
করছে না।
আমাদের এক প্রাক্তন ছাত্র সনে টোটৌ এই টোটো ঘর প্রসঙ্গে একদিন বলেছিল, "এই ছন-খড়ের তৈরি টোটো ঘরগুলো কিন্তু খুব আরামদায়ক ম্যাডাম।"
ও বলেছিল ,"নাইকোসার ভিতরটা অনেক ঠাণ্ডা থাকে। আর শীতকালে ভিতরটা গরম থাকে।"
কিছুক্ষণ ভাবলাম, ওর কথার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কিনা! একদিন সময় করে এই ঘরগুলির কাছাকাছি গিয়ে পরখ করে দেখেছিলাম বিষয়টি।
এই 'নাইকোসা' বা 'দেংসা' যাই হোক না কেন, এই 'টোটো ঘরগুলি' আসলে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি। সেই অর্থে এই ঘরগুলি হল
পরিবেশ-বান্ধব।
বাস্তবে কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে এই টোটোঘরগুলির নির্মাণে । এ এক
অসাধারণ শৈলীর সংমিশ্রণে তৈরি। ভাবনাটা থেকেই গেলো, 'এই টোটোঘরগুলিতে এমন
কী রয়েছে যে প্রচন্ড গরমও এই টোটোঘরগুলির ভিতরে ঠাণ্ডা আবহ বজায় থাকে ?'
প্রশ্নটা
ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। ভেবে দেখলাম টোটোদের মতামতগুলিও সঠিক। 'প্রচন্ড
বৃষ্টির শব্দও নাকি এই নাইকোসায় অর্থাৎ এই ঘরগুলির ভিতরে অবস্থান করলে
শুনতে পাওয়া যায় না !' অর্থাৎ এই ঘরের ভিতর থাকলে প্রচন্ড বৃষ্টিও কিচ্ছু
মনে হয় না।
এই টোটোঘর বা "নাইকোসা" আবার প্রচন্ড গরমেও শীতলতা প্রদান করে !
ঠাণ্ডায় নরম ও গরম রাখে অন্দরমহল ! অদ্ভুত লাগল আদিম টোটোঘরের এই অদ্ভূত মেকানিজমে !
ভাবতে
বসে পাওয়া গেল এই 'নাইকোসা' তৈরির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি । প্রকতপক্ষে 'খড়' বা
'সনের' তৈরী এই নাইকোসার চালে রয়ে যায় প্রচুর বায়ু প্রকোষ্ঠ। আমরা জানি,
'বায়ু তাপের কুপরিবাহী।'
ফলে বাইরের তাপ এই
বায়ু-প্রকোষ্ঠগুলি ভেদ করে 'নাইকোসা'র ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। তাই
গ্রীষ্মকালে এই নাইকোসাগুলির অভ্যন্তরে ঠাণ্ডা আবহ বজায় থাকে।
শীতকালে
কিন্তু উল্টোটাই ঘটে এখানে। ঠান্ডার দিনে এই খড়ের চালের মধ্য যে প্রচুর
বায়ু আবদ্ধ থাকে তা প্রকৃতপক্ষে তাপ চলাচলে বাধা দেয়। তাই বাইরের ঠান্ডা
হাওয়ার স্রোতও ঘরের মধ্যে ঢুকতে পারে না। শীতকালে তাই এই 'নাইকোসা'র ভিতর
গরম থাকে। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া প্রবেশ করতে পারে না এই টোটোঘরে বা
দেংসায়।
অপরদিকে এই ঘরের অন্যান্য উপাদান যথা, কাঠ
আর বাঁশও তাপের কুপরিবাহী। ঘরে মেঝে অর্থাৎ নীচের দিকের কাঠের পাটাতন হল
বাঁশের তৈরি, যা ইনসুলেটরের কাজ করে। সেই কারণে তাপ চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়ে
গ্রীষ্মকালে ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা আবহ বজায় থাকে। তাই শীত বা গ্রীষ্ম উভয়
কালেই 'টোটোঘর' বা 'দেংসা'য় বসবাস বেশ আরামদায়ক ও মনোরম হয়।
কিন্তু
'খয়ের' গাছ বতর্মানে টোটোপাড়ায় কমে এসেছে। 'খড়'ও অপ্রতুল। যার ফলে
বর্তমানে এই টোটোঘর বা নাইকোসাগুলি ('নাই' মানে খড়, 'সা' মানে বাড়ি) আর
বেশি তৈরি হতে পারছে না। সেই কারণে আস্তে আস্তে কালের গতিতে হারিয়ে যাচ্ছে
এই টোটোঘরগুলি, অর্থাৎ 'নাইকোসা'গুলি !
সরকারি
অনুদানের টাকায় টোটোপাড়ায় এখন ইট-সিমেন্টের পাকা বাড়িও তৈরি হচ্ছে অনেক।
টোটোরা এখন পাকা বাড়িতে থাকতে শুরু করেছে টোটোপাড়ায়। টোটোঘরের পাশাপাশি তাই
গড়ে উঠেছে আজকাল কংক্রিটের বাড়ি টোটোপাড়ায় । হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ এই
টোটোঘরগুলি। কিন্তু টোটোদের সাথে কথা বললে বোঝা যায় এই টোটোঘরেই ওরা বেশি
স্বাচ্ছন্দ বোধ করে থাকতে। প্রকৃতির আলো বাতাস খেলা করে শন, বাঁশ ও কাঠের
তৈরি উঁচু এই টোটো ঘরগুলিতে। কিন্তু এই ঘর তৈরির উপাদানগুলির অপ্রতুলতার
কারণে এই টোটোঘর আজ লুপ্ত হতে বসেছে।
আমাদের
বিদ্যালয়ের সরস্বতী পুজোতে কয়েকবার টোটোঘরের( নাইকোসা) মডেল বানিয়ে
সেখানেই সরস্বতী পূজার আয়োজন করতে বলা হয়েছিল কয়েকবার। ছাত্রছাত্রীরা খুশি
হয়ে প্রথম দিকে এই টোটোঘর বানাতেই বেশি পছন্দ করত। ইদানীং ওরাও একটু
আধুনিকতার দিকে ঝুঁকেছে। টোটোঘর আর বানাতে চায় না। কষ্ট বেশি, তোর্ষার চর
থেকে শন কেটে আনা, জঙ্গলে গিয়ে বাঁশ কাটা, বয়ে নিয়ে আসা, তারপর এই যে
টোটোঘর বানানোর ঝক্বি সামলাতে চায় না আজকালকার বেশিরভাগ ছাত্ররা। তার
পরিবর্তে তারা থার্মোকল, কাগজ ইত্যাদি কেটে ডেকরেশন করে সরস্বতীর মন্ডপ
বানিয়ে পূজো করতে আগ্রহী হতে দেখা যায় ইদানিং।
তবুও
কিছু কিছু টৌটোঘরের আজও দেখা মেলে টোটোপাড়ায়। এই টোটোঘরগুলির সংরক্ষণ তাই
অত্যন্ত প্রয়োজন। নইলে হয়ত অদূর ভবিষ্যতে কালের গতিতে হারিয়ে যাবে এই
'নাইকোসা'গুলি ! এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে এই আদিম ঐতিহ্যবাহী
টোটোঘরগুলির (দেংসা) আর ভবিষ্যতে দেখা পাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র ইতিহাসের
পাতায় হয়ত একদিন ছবির রূপ নেবে এই 'দেংসা' ! দেখা মিলবে হয়তো বা কাগজে বা
সফ্ট কপিতে ! মোবাইল বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে হয়ত চোখে পড়বে এই 'দেংসা'-
যা এক অতুলনীয় সৃষ্টি! আদিম টোটোঘর "নাইকোসা" !!