পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ১১
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
বাহো
বাইরে অনেকগুলো গলার আওয়াজ শুনে বেরিয়ে দেখে বাইরের ঘরটায় বেশ আড্ডা চলছে। সকাল থেকে একা একা কাজ করতে করতে হাঁফ ধরে গেছে বসমতীর। বাইরের ঘরে আড্ডা দেখে ভালোই লাগল। নিজেও একটু আড্ডামুখী হল। কান্তেশ্বর বেরিয়ে গেলে বাচ্চাগুলোও একটু পরে স্কুলে যায়। বাড়িটা একেবারে ফাঁকা। একা একা বসমতীর ভালোই লাগে না। আড্ডা দেখে খুশিই হল সেজন্য। হাসিমুখে হাঁক দিল,
“কিরে বুদেশ্বর, আজি কাজৎ যাইস নাই!”
বুধেশ্বর টেনে টেনে উত্তর দিল,
“না যাং মোসি। হামারে ওয়াখানোত আরো ঘাস হইসে। তে যে অউদ করেছে! আজি আর না পাইম। কালি খুব সাকালে ধরিম। বেলা হইতে হইতে বাদ দিম।" উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। এমন রোদে রোয়া মানে ধানগাছের গোড়ার ঘাস তুলতে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা। বুধেশ্বরের মা কখন এসেছে বসমতী দেখেনি। কথা শুনে তাকাল। গলাটাকে যথাসম্ভব উচ্চে তুলে বুধেশ্বরের মা উত্তর দিল,
“তোমাকে যতোমন গরমখান নাগে, গনেশের বাপক দ্যাখ যায়া। বড্ড চায়া কালা ছাতি একখান নিসে, মাথাৎ গামছা বান্দিয়া কেমন ওয়াবাড়িৎ সাকাল থাকি পড়ি আছে।"
এবার এসব বিতর্ক পাশ কাটিয়ে কলেশ্বর বসমতীকে হাঁক দিল,
“দি, তোমার ডারিয়া ঘরটাৎ বচচি, কোনেক চা-টা না খোয়ান।"
বসমতী মুখ ঝামটা দিল,
“তোর খালি চা-চা। গরমত বলে মানষি মরেছে।"
কলেশ্বরও ছাড়বার পাত্র নয়। হেসে হেসে উত্তর দিল,
“কায় মরে মরুক, হামরা না মরি। মরিলে তোর হাতত চা খায়ায় মরিমো”। বলাবাহুল্য উপস্থিত সবাই কলেশ্বরকেই সমর্থন করল। এরমধ্যে একজন বলে বসল,
“ডারিয়া ঘরটা বানেবার সোমায় না জানায় আছিলো চা'র কেটলিটা কোনেক বেশি নাচিবে।"
বসমতী আবার একটা কৃত্রিম মুখঝামটা দিয়ে বাড়ির দিকে ফিরে চলল, সাথে সাথে চলল বুধেশ্বরের মা। কেটলিতে চা, সাথে কয়েকটা কাপ আর আর কয়টা চাল ভেজে কোথায় নেবে ভাবছে আর ভালো থালা খুঁজছে দেখে বুধেশ্বরের মা বলে,
"নানাগে তো থালি দি। খুচিটাতে নেক।"
তাই সই। তেল নুন কাঁচা লংকা পেঁয়াজ মাখানো চালভাজা নিয়ে আবার বাইরের ঘরে আসতেই খাবারের এত আয়োজন দেখে জনতা রীতিমতো উল্লসিত হয়ে গেল। হাতে হাতে কাপগুলো উঠতে উঠতে শুরু হল নাই কাজের আলোচনা। আলোচনা আসলে কিছুই না। হঠাৎই এই গরমে বুধেশ্বরের মাছ মারার ইচ্ছে হয়েছে। এই ছেলেটা এমনিতেও মাছ দেখলে স্থির থাকতে পারে না। ও-ই প্রস্তাব তুলল,
“আজি সোগায় বাড়িৎ, চল, ডাঙিটা ছেঁকি। মেলা জল শুকাইসে।"
দু’একজন দোনোমনা করলেও সবাই রাজিই হয়। যেমন কথা তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক হাঁকে গোটা পাড়া জেগে উঠল। জাল, বালতি, দড়ি, কোদাল, কোঁচা, খোলোই নিয়ে প্রায় গোটা পাড়াটাই মাঠমুখী হল। মহিলারাও পিছিয়ে নেই। অনেকেই রান্নার দায়িত্ব আর কারো ঘাড়ে চাপিয়ে, কেউ বা দ্রুত ভাত একটা সব্জি নামিয়ে ছুটল। এমনিতেও গ্রাম্য গেরস্তের খাওয়ার আয়োজন খুব সামান্যই। তাই মাছ মারার এই আনন্দ কেউ ছাড়তে চাইল না। মুহূর্তে এপাড়া থেকে ওপাড়াতেও 'বাহো' দেবার খবর গেল। সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড শুরু হল যেন। ফসলের মাঠের মাঝখান দিয়ে বেশ চওড়া একটা নদীর মতো চলে গেছে। স্থানীয় ভাষায় এটা ডাঙি। প্রত্যেক বছর ভাদ্রের শেষে বা আশ্বিনের মাঝামাঝি জল প্রায় শুকিয়ে এলে মাঝ বরাবর বাঁধ দিয়ে একপাশ থেকে জল সেঁচে অন্যপাশে ফেলা হয়। জল পুরো সেঁচে মাছ মারা হয়। আবার একইভাবে অন্যপাশটার জল এপাশে সেঁচে ফেলে মাছ মারা হয়। এটা দুই একজনের কাজ নয়। একসঙ্গে চার-পাঁচজন, কখনও তার বেশিই মানুষ লাগে।
ঝপাঝপ কোদাল চালিয়ে মাঝ বরাবর বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেল। খুব কঠিন কাজ। অনেক সময় বাঁধ দিতে দিতেই জলের তোড়ে নরম মাটি গলে গিয়ে বাঁধ ভেঙে যায়। তবে যা-ই হোক ডাঙির পাড়ে একবার জড়ো হলে আর ফেরার প্রশ্নই নেই। তখন অন্য কোথাও থেকে চাকা চাকা ঘাসসহ মাটি কেটে এনে ফেলা হয়। তার সাথে কাঠের ছোট গুঁড়ি বা বস্তায় মাটি ভরে হলেও বাঁধ দেওয়া চাই। বাকিদের কেউ কেউ তেলের খালি টিনের গলায় দুদিকে মোটা দড়ি বাঁধতে ব্যস্ত। এর মধ্যে এদের আবার চায়ের তৃষ্ণা পেয়ে গেল। বুধেশ্বর কোদালের কোপ ঝপাঝপ ফেলতে ফেলতেই রসবালাকে ডাকতে থাকে,
“ মামি, ও মামি, কয়টা আর মানষি আছি, আনোখেনে বারে কোনেক চা বানেয়া।"
রসবালা মুখ মোচড়ায়।
“মোক কি তুই একেলাকে দেখিছিত তোর মাওটাক চোকুত না পড়েছে?"
“কোনেক দুধ চা খাবার মোনাছে বারে, হামার বাড়িত দুধে নাই। তোমার গাইয়া দুধের গরগোরা চা বানেয়া আনিবেন। মানষি এলায় কেমন ভাল কবে!"
রসবালা এবার আসল কথা বলে,
“হামার যে চিনিয়ে নাই বাউ, এতোলা মানষির চা হবে না ওঠে। কন্টোলের চিনি কদ্দিনে শ্যাষ। আর হাটের কতা কি কইম, অল্প পাইসার টামটুম জিনিস, নয়ে না, নগতে ফুরায়।"
বুধেস্বরের মা বলে,
“হামার কোনেক নিগা। হ্যা নেক ছোরানিটা। আন্দন ঘরত শিকিয়াত আচে কাইচের ছোট্ট একেনা বয়াম।"
এবার আর রসবালা না করল না, বুধেস্বরের মেয়েকেই ডেকে বলল
“চলত মাই মোর নগত, জলের জগটা এলায় আনিস। এইলা মরার মানসিগিলা এলা চা খালে জলও চাবে।"
মাঝখানে বাঁধ দেওয়া হয়ে গেলে দুজন দুদিকে দড়ি ধরে জল ছেঁকে ফেলতে লাগল। তামাক ক্ষেতেও তো এভাবেই জল টেনে নালায় ফেলে পরে থালা দিয়ে জলটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে জল ছেঁকে ফেলার কাজটা বেশ পরিশ্রমসাধ্য। দুজন জল ছেঁকার দায়িত্ব নেয়, দু তিনজন কোদাল হাতে বাঁধের তত্ত্বাবধানে থাকে। কোথাও এতটুকু ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ মাটি চাপা দিয়ে মেরামত হয়। টিনের দড়িও সময়মতো হাতবদল হতে থাকে। সবাই স্বেচ্ছায় অন্যদের বিশ্রামে পাঠিয়ে নিজেরা হাত লাগায়।
এভাবেই চলতে থাকে। ক্রমশ একসময় একদিকের জল কমে আসল। এখন এক দেখার মতো দৃশ্য। নানা ধরণের মাছ বিভিন্ন দিক থেকে লাফাচ্ছে। নেমে মাছ ধরার জন্য সবাই আঁকুপাকু করলেও নামায় নিষেধ আছে। কয়েকজন মিলে অতি উৎসাহী সবাইকে পাহাড়া দিতে থাকে যাতে হুট করে নেমে না যায়। আগে কয়েকজন খুব আলগোছে আস্তে আস্তে মাছ মারবে যাতে মাছগুলো হুটোপাটিতে কাদার ভেতরে লুকিয়ে না পড়ে। মোটামুটি মাছ মারা হয়ে গেলে সবাইকে নামতে দেওয়া হয়। তখন যে যার মতো নেমে পড়বে। মাছ দেখে সবার মন চঞ্চল। কেউ কেউ প্রায় নেমেই পড়ছে। কিন্তু কড়া নিয়ম!
সে অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য। নিষেধ উঠতেই সবাই হুড়মুড় করে কাদার মধ্যে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। বসমতীও পরনের কাপড়টা একটু গুঁজে নিয়ে নেমে পড়ল। তারও এ ব্যাপারে উৎসাহ কিছু কম নয়! আসলে খাওয়ার থেকেও সবাই মিলে মাছ মারার আনন্দটাই অন্যরকম! বছরে মাত্র দু'একদিন এই সুযোগ মেলে। সকাল থেকে পরিকল্পনা করেও সব শেষ হতে হতে বিকেল পেরিয়ে গেল।
সারাদিনের অতি পরিশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন হলেও কারো উৎসাহ এতটুকুও কমেনি। এরপর আবার সবাই বসেছে মাছ ভাগাভাগি করতে। সব মাছ একজায়গায় করে ঘর প্রতি, সদস্য হিসেব করে আন্দাজমতো সব মাছ ভাগ করে তবেই যে যার বাড়িমুখো হল। যারা অনুপস্থিত থাকল পৌঁছে দেবে যে যে কাছে আছে। এ বিষয়ে এই পাড়ার খুব সুনাম। এখন কিছুদিন গোটা পাড়ায় মাছ শুকিয়ে সুঁটকি, তারপর সিদল বানানোর ধুম শুরু হবে। বসমতী আবার সিদলটা ভালো বানাতে পারে না। রসবালাই করে দেয় প্রতিবার। রসবালার হাতের সিদলও যেমন, সিদল রান্নাও তেমন।
-------------------------------------------------------
খুচি - বাঁশের তৈরি গোল ঝুড়ি।
ছোরানি - চাবি।
সিদল - সুঁটকির সঙ্গে কালো কচুর ডাঁটি কেটে সাম-গাইনে ছেঁচে মিশিয়ে ভালো করে তেল হলুদ মাখিয়ে শুকিয়ে রেখে দেওয়া হয়। ওটাই সিদল। সারা বছর পুড়িয়ে বা রেঁধে খাওয়া যায়।
------------------------------------------------------
ছবি : রীতা রায়