নানা রঙের গানগুলি-১১/শৌভিক কুন্ডা
নানারঙের গানগুলি-১১
শৌভিক কুন্ডা
------------------------------
আর দু বছর পর সিনেমাটি পঞ্চাশ বছর ছোঁবে। সুতরাং হিসেব অনুযায়ী, যখন রিলিজ হয়, আমি তখন ১১ বছরের। কিন্তু সে সময় যেমনটা হ'ত, বোম্বে, কলকাতা ঘুরে এ মফস্বলি সিনেমাহলে পৌঁছতে পৌঁছতে আমার বালকবেলায় কৌতূহল হানা দিতে শুরু করছে। নিষ্পাপ সারল্য দূরে চলে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে নিষিদ্ধ, গোপনীয় কিছু গোলাপি ধারণা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। আর আমি একা হতে চাইছি। একা হতে শুরু করেছি। কল্পনায় উড়ে উড়ে যাচ্ছি নিজের তৈরী গল্পকথার দেশে। হ্যাঁ, সেই সময়ই আমার ওপর এসে আছড়ে পড়লো নরম, খুব নরম একটা গান! আর সে সময় সিনেমার গানের ক্ষেত্রে আলোর চেয়ে শব্দ আগে ছুটতো। তাই 'মিলি' দেখার আগেই শুনে ফেলেছিলাম "বড়ি সুনি সুনি হ্যায়
জিন্দেগী য়ে জিন্দেগী.....!
আচ্ছন্ন করে রাখতো আমাকে এই গান। একটা মেঘলা বিষাদে মুড়ে রাখতো আমার ছুটির দুপুর, ঘুম না আসা রাতগুলোকে। আর তারপর যখন রূপশ্রী হলের পর্দায় দেখে ফেললাম মিলি আর শেখরের রূপকথা, সে গান আরও বেশি করে গেঁথে ফেললো আমাকে। অলস অবসরে, বিশ্রামের কল্পনায় আমি নিজেকে আটকে ফেলতাম সেই দৃশ্যে, যেখানে মিলির কানে প্রতিবেশীর ঘর থেকে ভেসে এলো "বড়ি সুনি সুনি হ্যায়.….."। কাচের আবছায়া পেরিয়ে শেখরের পায়চারি, আর এই গান, একাকীত্বের সেরা সংজ্ঞা হয়ে পৌঁছেছিলো মফস্বলি এই তখনকিশোরের কাছে।
এখনো অমর হয়ে আছে কথা গুলো :
" পতা নাম লিখ কর
কাঁহি ইউ হি রাখ কর
ভুলে কোয়ি য্যায়সে....."
নাম-ঠিকানা লেখা এমন কতো কতো চিরকুট তো সত্যিই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে, যত্নে যাদের রাখার কথা ছিলো, অথচ বেখেয়ালে কোথায় যে রেখেছিলাম!
"মিলি" তেমনভাবে ব্যবসা করতে না পারলেও, যোগেশের লেখা, শচীন দেব বর্ম্মনের সুরে এই গানটি কিন্তু আজ অবধি হিন্দি সিনেমার দুঃখের গানের তালিকায় অন্যতম হিসেবে রয়ে গেছে। আর, এই গানটিই সম্ভবত শচীনকত্তার রিহার্স করানো শেষ গান। আকাশবাণীতে আমিন সাহানিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ গানের রেকর্ডিং বিষয়ে কিশোরকুমার অনেক কথা জানিয়েছেন, যে রিয়েল লাইফবর্ণন রিল লাইফের থেকে কম আকর্ষণীয় নয়!
শচীনকত্তার বাড়িতে তালিম এবং রেওয়াজ চলছিলো গানের। পরদিন রেকর্ডিং। রিহার্সাল চলতে চলতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন শচীন। কিশোর ফিরে আসেন নিজের বাড়িতে। কিছুক্ষণ পরেই রাহুলদেবের এত্তেলা। ডাক্তার শচীন কত্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন হাসপাতালে ভর্তি হতে। কিন্তু কত্তা বেঁকে বসেছেন। ভর্তি তিনি হবেন, তবে রেকর্ডিং হয়ে গেলে পর! রাহুল আর কিশোর যুক্তি করে কত্তার বিছানার পাশে। কিশোর বিকৃত গলায় শচীনদেবের কাছে জানালেন, এরকম স্বর নিয়ে তো রেকর্ডিং সম্ভব হবে না। আর্জি জানালেন, কত্তা যাতে হাসপাতালে ভর্তি হন। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরুন। ইতিমধ্যে গলা ঠিক হয়ে গেলে রেকর্ডিং হবে। শচীনদেব রাজি হলেন। ভর্তি হলেন হাসপাতালে। এদিকে নির্দিষ্ট সময়ে রাহুলদেবের উপস্থিতিতে গানটি রেকর্ড কোন হ'ল। শোনা যায় প্রথমে শচীনকত্তা ক্ষুব্ধ হলেও গান শোনার পর বলেছিলেন, "কিশোর ছাড়া এ গান আর কেউ গাইতে পারতো না এমন ভাবে।" এর অল্প সময় পরেই কোমায় চলে যান সুরস্রষ্টা। '৭৫ সালেই তাঁর সুরলোক যাত্রা, অক্টোবরে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴