দাঁড়াবার জায়গা/এগারো
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
স্কুলের
সামনে বিশাল খেলার মাঠ। সে মাঠে মূলত ফুটবল খেলা হতো। এই স্কুলে তখনও
ক্রিকেটের ব্যাপার ছিলো না। আর হতো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, যাকে আমরা
বলতাম স্পোর্টস। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো জানুয়ারির প্রথমদিকে।
ফলে, প্রথম স্পোর্টস পেলাম ক্লাস সিক্সে উঠে। মূল প্রতিযোগিতার আগে নানা
বিভাগে বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হলো কয়েকদিন ধরে। কোনও খেলাতেই আমি যোগ্য ছিলাম
না সঙ্গত কারণেই। শারীরিকভাবে এতই দুর্বল ছিলাম যে, প্রাথমিক যোগ্যতাই
অর্জন করতে পারিনি। তাতে খুব মন খারাপ হয়েছিলো। তবে, গো অ্যাজ ইউ লাইক
প্রতিযোগিতায় একবার চেষ্টা করে দেখার লোভ হলো। আমি হকার সেজে হাজির হয়ে
বলাই বাহুল্য ব্যর্থ হলাম। আমার খেলার ইচ্ছেটাই মরে গেলো। নিজের অযোগ্যতা
মেনে নিতে পারছিলাম না, ফলে মনে মনে সব দোষ দিলাম স্কুলের ঘাড়ে! নিজের
ব্যর্থতা মেনে নিতে যে কষ্ট হয় সেটা সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম। কিছুদিন
যেতেই অবশ্য খেলায় নিজের দুর্বলতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। পরে, ফুটবল
মাঠে যেমন নেমেছি, তেমনই ক্রিকেটেও নেমেছি। তবে, স্বীকার করা ভালো,
কোনওটাতেই তেমন সুবিধে করতে পারিনি।
একদিন
টিফিনের সময় স্কুল ভবনের পেছনে, পশ্চিমদিকের ছোট্ট মাঠে, ছায়ায় আমরা কয়েকজন
খেলছিলাম। খেলা মানে, হুটোপাটি, দৌড়োদৌড়ি এইসব। একসময় দেখি আমাদের
ক্লাসের কয়েকজন বিড়ি টানছে! এই দৃশ্য আমাকে অস্থির করে তোলে। এরইমধ্যে
একজন কাছে এসে তার হাতের ধোঁয়া ওঠা বিড়িটা এক টান মেরে আমার দিকে বাড়িয়ে
দিয়ে বলে, ‘নে, একটা টান মার’। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছিটকে আসি। সে আমার
পিছু নিলে আমি দৌড় লাগাই। সহপাঠী হলেও মুখ তার দাড়ি-গোঁফে ভর্তি। পড়া না
পারলে অরুণবাবু একদিন তাকে বলেছিলেন, ‘বুড়ো ভাম! কেন যে তুই স্কুলে আসিস!
তোর তো কলেজে পড়ার কথা! এখনও ক্লাস সিক্সে হামাগুড়ি দিচ্ছিস! তাও লজ্জা
নেই’! সে আমার কানের কাছে ‘ফুঁ’ করে বিড়ির ধোঁয়া ছুঁড়ে দেয়। আমি চিৎকার
করে কেঁদে উঠি। এবারে, সে ও তার বিড়িখোর সঙ্গী আমাকে জাপটে ধরে বলে, ‘চুপ।
চিৎকার করলে গলা টিপ্পা মাইরা ফ্যালবো। কাউরে কইবি না। কইলে কিন্তু খবর
আছে’। এই হুমকিতে আমি চুপ করে যাই। কিন্তু অস্থিরতা কাটে না। শুধু কি বিড়ি
খাওয়া? আরও কত কত ঘটনা এরা প্রায় রোজই ঘটাতো। একটা দুটো বলা গেলেও বেশিটাই
বলা যাবে না। ছাপার অক্ষরে কেন, মুখেও উচ্চারণ করা যাবে না। ভয়ানক সেসব
অভিজ্ঞতা জীবনে কারও সঙ্গেই শেয়ার করা সম্ভব নয়। কিন্তু, এসব ঘটনা আমার
পরোক্ষে উপকারই করেছে। নিজেকে এদের সঙ্গে একাসনে বসাতে তীব্র ঘৃণাবোধ গভীর
অন্ধকারে আমাকে পথ দেখিয়েছে।
স্কুলে শিক্ষকদের কাছে
প্রবল ভালোবাসা, প্রশ্রয় পেয়েছি। অরুণবাবুকে একদিন বললাম, ‘স্যর, আমাদের
ম্যাগাজিন হবে না’? তিনি বললেন, ‘আমাদের স্কুলে তো ম্যাগাজিন হয় নাই
কোনওদিন’। আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। জেনকিন্স স্কুলের বিভিন্ন বছরের
ম্যাগাজিন বাড়িতে দেখেছি, পড়েছি। আমারও খুব ইচ্ছে, এই স্কুলেও ম্যাগাজিন
হোক। আমিও তাতে লিখবো। একদিন ক্লাস চলাকালে এলেন হেডস্যর মনমোহন সেন। তিনি
সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের স্কুলেও ম্যাগাজিন হবে। সম্পাদক
থাকবেন অরুণবাবু আর...’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই থাকবি’। আমার শরীরে
শিহরণ খেলে গেলো। সেদিন ক্লাস থেকে হেডস্যর চলে গেলে অরুণবাবু বললেন,
‘টিফিনের সময় আমার কাছে আসিস তো’। গেলাম। স্যর বললেন, ‘কবিতা, গল্প সবার
কাছ থেকে চেয়ে নে। তুইও লিখবি, যা খুশি। খুব ভালো ম্যাগাজিন হবে আমাদেরও’।
ভালো-মন্দ
বলতে পারবো না, তবে, কোচবিহার উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাদ্রি সাহেবের
ইস্কুল বলে যার সমধিক পরিচিতি, সেই প্রথম ম্যাগাজিন দেখলো। তাও, ক্লাস
সিক্সের এক ছাত্রের হাত ধরে! অরুণবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘লেখাগুলায় গণ্ডগোল
থাকলে ঠিক করে দিবি’। সেটা যে করিনি তা নয়, কতটা সঠিকভাবে সে কাজ করেছি বলা
অসম্ভব। তবে, নিজের দুটো লেখা ছিলো তাতে। একটা গল্প আর একটা ‘কবিতা’, যেটা
আসলে পদ্য মাত্র। অরুণ স্যরের হাতে আমি দুটো লেখাই দিয়েছিলাম। তিনি দুটোই
ছেপেছিলেন। আর, সেবছরই এই স্কুলে আমার শেষ বছর। সেইসঙ্গে, ছবি আঁকা, মূর্তি
গড়ার সঙ্গে কবিতা লেখাও আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। পাঠ্যবইয়ে তখনও কিছু
আকর্ষণ থাকলেও আমার দিনরাত কেড়ে নিলো ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া আর কবিতা
লেখা। খুঁজে পেলাম এক অবাধ মুক্তির আকাশ। পরিণত বয়সে একাধিক সাক্ষাৎকারে
প্রশ্ন করা হয়েছিলো, কেন লিখি। আমার একটাই জবাব বরাবর, নিজেকে জানার জন্য,
নিজেকে উপলব্ধি করার জন্য, নিজের মুখোমুখি হবার জন্যই লিখি। শিল্পের সঙ্গে
সহৃদয় হৃদয় সংবেদ্যতার অলঙ্ঘ্য সম্পর্ক বলেই লেখার পাঠক চেয়েছি, নিশ্চিত।
তবে, যে-কোনও পাঠকে আমার মন ভরেনি কোনওকালেই। আমার চাই বিশেষ পাঠক, সহৃদয়
পাঠক, দীক্ষিত পাঠক। ডুগডুগি বাজিয়ে পথচারীদের আকর্ষণের ইচ্ছে কখনই হয়নি।
অরসিকের কাছে রস পরিবেশনের মতো দুর্বুদ্ধি কখনও স্থান পায়নি মনে। জনপ্রিয়
হবার আকাঙ্ক্ষার মতো দুর্বলতাকে জীবনে কখনও প্রশ্রয় দিইনি। আর, এই মানসিকতা
গড়ে ওঠায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে সম্ভবত জেনকিন্স স্কুলের চারটি বছর।
জীবন
আসলে ভালো-মন্দ মিশিয়ে, সাদা-কালো সিনেমার মতো। সেকারণে, বুঝি, পাড়ার
স্কুলেও অনেক পেয়েছি। অনেক সহপাঠীর অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং অধিকাংশ শিক্ষকের
প্রশ্রয়, অপরিসীম স্নেহ আমাকে চিরঋণী করেছে। তবু, আমার স্বপ্ন জুড়ে
জেনকিন্স স্কুল আমাকে টানতে থাকে। এবং, এবারে সত্যিই আমার স্বপ্নের
জেনকিন্স স্কুল! ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম। প্রথম কয়েকদিন ক্লাসের সকলেই
অপরিচিত। ক্লাস শুরুর দু-তিন দিনের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো। রতন ঘোষ নামে
একজন আমাকে প্রথম বেঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আমি মৃদু আপত্তি
করেছিলাম। তাতে লাভ হয়নি। সে আমার বইপত্র মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আমি মন
খারাপ করে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। আসলে, ক্লাস সেভেনে প্রায় সকলেই শহরের
সদর এমই স্কুল থেকে আগত। তারা সকলেই শুধু নিজেদের কাছে ঘনিষ্ঠই নয়, সকলেই
সম্পন্ন পরিবারের, সকলেই বেশ স্বাস্থ্যবান। তারা সকলেই কিছু ভালো ছাত্র নয়,
বরং কেউ কেউ খুব নিম্নমানের ছাত্র। কারও কারও মুখের ভাষা প্রায় অশ্লীল।
কিন্তু তাদের সকলের মুখের ভাষা আমার চেয়ে আলাদা। আমার মুখের ভাষায় প্রমিত
ভাষার ছাপ প্রায় নেই। উচ্চারণে সেটা খুবই স্পষ্ট। ফলে, কেউ কেউ আমাকে
স্পষ্টতই অবজ্ঞা করতো। তবে, এসব বড় জোর কয়েক সপ্তাহ। তারই মধ্যে নিজেকে
গুছিয়ে নিতে পেরেছি। ক্লাসে পড়া পারলে শিক্ষকদের প্রশংসা পেয়েছি। ফলে,
দ্রুত অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। বেশ কয়েকজন বন্ধু পেয়েছি। তখন
আমাদের বাড়িতে স্বপনকুমারের গোয়েন্দা গল্পের ভাণ্ডার। সম্ভবত, সেজদা সেসব
কিনতো, দাম বোধহয় পঁচিশ পয়সা ছিলো। আমি সেখান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে যেগুলো
পড়তাম, সেগুলো পরে ক্লাসেও নিয়ে যেতাম। আর, স্বপনকুমারের গল্প আমাদের
কয়েকজনকে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলো। একদিন, স্বপনকুমারের ‘দস্যু
কালনাগিণী’ পাঠ্য বইয়ের খাঁজে লুকিয়ে স্কুলে গিয়েছি। প্রথম ক্লাস থেকেই
আমার ভেতরে উসখুস। বন্ধুদের চমকে দেবার ইচ্ছে আমাকে অস্থির করে তুলেছে।
প্রথম ক্লাস শেষ হতেই ঝুলির ভেতর থেকে বেড়াল বের করার ভঙ্গিতে বের করি
‘দস্যু কালনাগিণী’। প্রথমে আমার পাশে বসা নবারুণ লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে,
‘দেখি, দেখি’। আর, তার এই চেঁচামেচিতে ক্লাসের প্রায় সকলেই ব্যাপারটা জেনে
যায়। সকলেই হামলে পড়ে। বইটা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এর হাত
থেকে ও কেড়ে নেয়, আবার ওর হাত থেকে আরেকজন। এভাবে অনেকটা সময় ধরে চলতেই
থাকে বিরামহীন কাড়াকাড়ি। সেই সময়ে জেনকিন্স স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে
সম্ভবত সবচেয়ে ঠান্ডা মেজাজের ছিলেন ঝা (দীনেশ ঝা) স্যর। খুবই শান্ত
প্রকৃতির মানুষ। অসম্ভব ছাত্রদরদি। খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। তাঁর যে রাগ
থাকতে পারে কেউই কোনওদিন কল্পনাই করিনি। ফলে, আমাদের মধ্যে তাঁর আগমন নিয়ে
কোনও সতর্কতা ছিলো না। যথারীতি তিনি ক্লাসে এলেন। আমরা কয়েকজন দাঁড়ালাম।
স্যর হাতের ইঙ্গিতে আমাদের বসতে বললেন। তারপর স্বপনকুমার নিয়ে কাড়াকাড়ি
দেখলেন কয়েক সেকেন্ড। যারা বই নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলো তারা খেয়ালই করেনি
যে, স্যর ক্লাসে এসেছেন। ফলে, যা হবার তাই হলো। প্রচণ্ড গর্জনে ফেটে পড়লেন
স্যর। যতদূর মনে পড়ছে, কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়িতে অনেকেই জড়িত থাকলেও শেষ
পর্যন্ত প্রদীপ আর রাতুল ধরা পড়ে যায়। স্যর অনেকটা দৌড়ের ভঙ্গিতে এগিয়ে
এসে দুজনের চুলের মুঠি শক্ত করে ধরেন। তারাও নিজেদের ছাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা
করে চলেছিলো তখনও, চুলের মুঠি যে স্যরের হাতে সেটা বোধহয় তারা বোঝেনি।
স্যর, দুজনকে ছাড়িয়ে প্রথমে নিলডাউন করিয়ে রাখলেন। তারপর কী মনে করে ফের
সক্রিয় হলেন। প্রথমে প্রদীপকে ধরে খালি হাতেই কিল-চড় মারতে শুরু করলেন।
তিনি মেরে চলেছেন, আর প্রদীপ পরিত্রাহী চিৎকার করে চলেছে। সে বারবার বলছে,
‘স্যর, ভুল হয়ে গেছে। আর কোনওদিন করবো না’। সে কাতর মিনতি করেই চলেছে, আর
স্যর তাকে মেরেই চলেছেন। তখন স্যরের মুখটা কী ভয়ানক লাগছিলো। একজন শান্ত,
দরদি শিক্ষক ক্রুদ্ধ হলে কী পরিস্থিতি হতে পারে আমরা বুঝে যাই। তখন আমাদের
সকলের মুখ শুকিয়ে গেছে আতঙ্কে। ওদিকে, প্রদীপের বেধড়ক মার খাওয়া দেখতে
দেখতে রাতুলের প্যান্ট ভিজে গেছে। এবারে, প্রদীপকে ছেড়ে স্যর রাতুলকে নিয়ে
পড়লেন। চুলের মুঠি ধরে পিঠে দুমদাম কিল, চড় মারছেন, আর ফোঁস ফোঁস করছেন।
অনেকটা সময় ধরে দুজনকে মারধরের পর তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি
কাঁপছিলাম ভয়ে। কারণ, এই সমস্ত কাণ্ডের পেছনে একজনই দায়ী, সেটা আমিই। আমার
ডান পাশে নবারুণ (চক্রবর্তী, পরে কলেজ জীবনে ফুটবল খেলতে গিয়ে গুরুতর আঘাত
পেয়ে মারা যায়) দেখছি কাঁপছে। আমার বাঁ-পাশে তাপস (সিনহা) ঘাপটি মেরে বসে
বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। আমি অন্যদের দেখছি, কারণ, আমি জেনে গেছি আজ আমার
জীবন শেষ। কে বাঁচাবে আমাকে! কিন্তু, বিস্ময়কর ঘটনা যে, স্যর বহুবার রাতুল
আর প্রদীপকে প্রশ্ন করেছেন, ‘এই বই স্কুলে কে এনেছে?’ কিন্তু, দুজনের কেউই
সত্যটা ফাঁস করেনি! আমাদের স্কুল জীবন নিয়ে যখনই ভাবি তখনই এই বিষয়টা খুব
গুরুত্ব পায় আমার কাছে। স্কুলে স্বপনকুমারের বই নিয়ে যাওয়া অপরাধ হলে সেই
অপরাধে অপরাধী আমিই। শাস্তি হলে আমারই হওয়া উচিত। অথচ, দুই বন্ধু আমাকে
বাঁচাতে সত্য গোপন করতে কুণ্ঠিত হয়নি। পুলিশের মার বলে একটা কথা আছে। সেরকম
প্রায় Vপুলিশের মার খেয়েও রাতুল, প্রদীপ নিজেদের বাঁচাতে সত্যিটা প্রকাশ
করেনি। এটাই হয়ত জেনকিন্সিয়ান স্পিরিট, যে কথা জেনকিন্সের প্রাক্তনীরা
প্রায়ই বলে থাকেন।