তিস্তাবাথান-১১
তিস্তা বাথান
পর্ব : ১১
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
"""""""""""""""""""""
মাইলের পর মাইল বিস্তৃত চরভূমি। তার মাঝ দিয়ে বয়ে চলে সুগভীর তিস্তা। সে তিস্তা এখনকার মত বছরের অধিকাংশ সময় শুঁকিয়ে যাওয়া তিস্তা নয়। তখন তিস্তায় ঢেউ উঠত কয়েক মানুষ সমান। তার পাড় ছিল প্রায় বারো থেকে পনের ফিট উঁচু। তিস্তার জলরাশির নীচ থেকে একরকম গুড়গুড় আওয়াজ উঠত। স্থানীয়রা একে 'কামান ডাকা' বলতেন। এ কামানডাকা তিস্তাগানও বটে। প্রাচীনকালের সেই তিস্তাগান আসলে কোন সুমধুর সঙ্গীত নয়। তিস্তার তলদেশ থেকে ওঠা ভয়ার্ত কামানডাকাই হল তিস্তাগান। মৈষাল বন্ধুরা এই তিস্তা গানের অস্তিত্ব স্বীকার নিয়েছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন তিস্তাপারের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরাও।
চর পেরিয়েই বৈকুন্ঠপুরের হাড়হিম করা জঙ্গল। দিনের বেলাতেও সেই জঙ্গলমুখো হত না কেউ। শুধুমাত্র বন্য জীবজন্তুর ভয়ে নয়। ভয় ছিল ডাকাতের। রংপুরের সেই বিখ্যাত সব ডাকাতদের কথা আপনাদের নিশ্চই স্মরণে রয়েছে। নারাণ ডাকাত, বীরবল ডাকাত, মজনু শা, ভবানী পাঠক ইত্যাদি ইত্যাদি। একদা ইংরেজ শাসকদের তাঁরা তটস্থ করে রাখতেন। এইসব ডাকাতদের ডেরাই ছিল বৈকুন্ঠপুরের ঘন জঙ্গল। তার ঐতিহাসিক কিছু প্রমাণ ও লিখিত দস্তাবেজ আজও রয়েছে। জানি অনেকেই ভাবছেন এই ডাকাত প্রসঙ্গে লেখক দেবী চৌধুরাণীর প্রসঙ্গ টানলেন না কেন? আসলে উপন্যাসের দেবী চৌধুরানী, ডাকাতরাণী হিসেবে সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জন করলেও ইতিহাসের দেবী চৌধুরাণী মোটেই ডাকাত ছিলেন না। তিনি ছিলেন মন্থনা স্টেটের প্রজাবৎসল এক জমিদারনী। তার পুরো নাম জয়দুর্গা রায়চৌধুরী দেবী চৌধুরাণী। জয়দুর্গা নাম, রায়চৌধুরী বিবাহের পর পাওয়া পদবী আর দেবী চৌধুরাণী হল তার উপাধি। সে সময়কালের ইতিহাস ঘাটলে দেবী চৌধুরাণী উপাধিপ্রাপ্ত অনেক জমিদারনীর নাম খুঁজে পাওয়া যায়। দুঃখের কথা এই যে, জীবনে একটিমাত্র ডাকাতি না করেও শুধুমাত্র সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক ও কল্পনামিশ্রিত কিছু চরিত্রের বুননের জন্য জয়দুর্গা দেবী চৌধুরাণী জনমানসে ডাকাতরাণী হিসেবেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছেন। তবে একথা ইতিহাসগত ভাবে সত্য যে জয়দুর্গা দেবী চৌধুরাণীর সাথে ভবানী পাঠক ও মজনু শা-দের সখ্যতা ছিল। সেই সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ইংরেজ কর্তৃক নিয়োজিত ইজারাদার দেবী সিংহ ও হররাম সেনের দরিদ্র প্রজাদের উপর অকথ্য নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্যই। রুখে তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন। রংপুর জুড়ে সংগঠিত হয়েছিল জমিদার ও প্রজাদের মিলিত বিদ্রোহ। যে বিদ্রোহের আগুনকে আমরা কৃষক বিদ্রোহ অথবা সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামেই জানি। এই ইতিহাস কিন্তু অনেক বড় ইতিহাস। তাই আলোচনা দীর্ঘায়িত না করে সরাসরি মৈষাল বন্ধুদের মুখ থেকে শোনা সেদিনের ডাকাতিয়া গল্পেই প্রবেশ করছি।
জঙ্গলের মাঝে ডাকাতের ডেরা। জঙ্গল ঘেঁষে তিস্তাচর। আর চরের মাঝেই বসবাস মৈষাল বন্ধুদের। তাই ডাকাতের গল্প মৈষাল বন্ধুদের কাছে থাকবেনা- তা হয় নাকি? যে সময়কালের ডাকাতের গল্প সানিয়া দা, আমিরদা বা ভগলুদা-রা লেখকের সাথে করেছেন সেই সময়কাল নারাণ, বীরবল, মজনু বা ভবানী ডাকাতদের সময়কাল নয়। সত্তর-আশি বছর আগের কথা বলেই ধরে নিতে হবে পাঠকবর্গকে। শুধুমাত্র তিস্তার পূর্ব পাড়ের বৈকুন্ঠপুরের ঘন জঙ্গল নয়- ডাকাতদের আস্তানা ছিল পূর্ব-পশ্চিম দু-পাড়েই। নদী পেরিয়ে চরের উপর দিয়েই তাঁরা হেঁটে যেতেন ডাকাতির উদ্দেশ্যে। যাবার সময় বাথানে বাথানে আওয়াজ দিয়ে যেতেন যে তাঁরা ডাকাতি করতে যাচ্ছেন। কোনোরকম চিল্লাহাল্লা যেন মৈষাল বন্ধুরা না করে। কারণ ডাকাতেরা জানতেন চরের খবরের উপর ভিত্তি করেই ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর গুলিতে বহু ডাকাত প্রাণ হারিয়েছিলেন। ডাকাতেরা আসতেন জলপথে আবার ফিরেও যেতেন জলপথে। বড় বড় ছিপ নৌকা তারা ব্যবহার করতেন বলে জেনেছি। এমনই এক ছিপ নৌকার উপর ভবানী পাঠককে গুলি করে হত্যা করেছিলেন ইংরেজ শাসকেরা। স্থানের নাম কাউনিয়া। সময়কাল ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দ।
সানিয়াদা ও বাচ্চুদাকে ডাকাতের দল একবার বেঁধে রেখেছিলেন বাথানে। অপরাধ তারা ডাকাতির কাজে বাঁধা দিয়েছিলেন। ডাকাতেরা ফিরছিল ভোরের একটু আগে আগেই। হঠাৎ করে তারা প্রবেশ করে সানিয়াদার বাথানে। বাথানের ছাউনি ছিল টিন দিয়ে তৈরি। সে টিন ডাকাতেরা খুলে নিয়ে যাবে। বাধা দেন সানিয়াদা ও বাচ্চুদা। ডাকাতেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। দু’জনকে ধরে পিছমোড়া করে বাথানের খুঁটিতেই বেঁধে রেখে দুই বান টিন নিয়ে চলে যান তারা। বাথানের টিন ডাকাতেরা এভাবে নিয়ে যায় জন্যই পরবর্তীকালে বাথান মালিকেরা বাথান নির্মাণের জন্য মৈষালদের টিন সরবরাহ করতেন না। বাথানের চাল এখনও তৈরী হয় প্লাষ্টিক আর ভাবনি দিয়ে।
ডাকাতদের কথা শুনে চললে তাদের মতো ভালো আর কেউ হত না। কোন কোন সময় উপঢৌকনও মিলে যেত। কিন্তু কথার বিরুদ্ধে গেলে পরিণতি ভালো হত না। সানিয়াদার হাতে একটি কোপের দাগ আছে। সে কোপ নাকি ডাকাতেরাই মেরেছিল। তবে কেন মেরেছিল সে কথা সানিয়া দা বলতে চাননি। আমিও আর জোর করিনি। সানিয়াদা মুচকি হেসে সেদিন বলছিলেন- ‘আরে কত ডাকাত ছিল। কতগুলা মরছে। কতগুলা সাধু হইছে। জলপাইগুড়িতেও না এখনও আছে দুই তিনজন। দেখা হয়তো মাঝে মাঝে’। যাইহোক, তাদের নাম আর প্রকাশ করছি না। মৈষাল বন্ধু, যাদের সাথেই ডাকাত নিয়ে আলোচনা করেছি তারা কিন্তু কেউ ডাকাতদের গালিগালাজ করেননি। বরং বলেছেন ওরা ডাকাতি করলেও খুনখারাপি কোনদিন করতো না। মহিলা শিশুর উপর অত্যাচার তারা ভাবতেই পারে না। তাদের মূল নজর ছিল সোনা-রূপা-কাঁসা-পিতল ও মুদ্রার উপর। গৃহস্থের কাছ থেকে সেটা বলপূর্বক নিয়েই তারা হাঁটাপথে তিস্তায় প্রবেশ করত। মাঝে মাঝেই তারা ডাকাতি করে ফেরবার পথে বাথানে চায়ের আবদার করত। মৈষাল বন্ধুরা বাধ্য হত। গভীর রাতে মৈষাল ডাকাতের এই চা-চক্র সূর্য ওঠবার আগেই শেষ হয়ে যেত। নতুন ভোরে সবকিছু ভুলে গিয়ে মৈষালেরাও তাঁদের নিত্যকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের দুর্ধর্ষ সব ডাকাতদের যে রোমহর্ষক কাহিনী বা মিথ শুনেছি তার সাথে মৈষাল বন্ধুদের ডাকাতের কোনো মিল খুঁজে পাইনি। সে সময়ে ডাকাতি ছিল কারো পেশা আবার কারো ছিল নেশা। বংশপরম্পরাতেও ডাকাতি চলত। এর প্রমাণ ইতিহাসেই রয়েছে। ডাকাতিয়া চরিত্রও ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। যেমন ভবানী পাঠক। ব্রিটিশ শাসকেরা তাকে ডাকাত সর্দার বলতেন। তিনি কিন্তু নিজের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি বা আয়েসি জীবন-যাপনের জন্য ডাকাতি করতেন না। লুঠপাঠ করে যা অর্জিত হত তা বিলিয়ে দিতেন তিস্তা-করলা পাড়ের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে। এ কারণেই হয়তো তাকে দেবতাজ্ঞানে আজও পূজা করেন উত্তরের মানুষেরা। সেকাল হোক আর একাল, ডাকাতদের জন্য মৈষালদের হৃদয়ে একটা কোমল-কোণ যে রয়েছে তা উপলদ্ধি করতে পেরেছি আমিও হৃদয় দিয়ে।
_____________________________________
কৃতজ্ঞতা স্বীকার- উমেশ শর্মা ও গৌতম কুমার দাশ
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴