চা-ডুবুরী-১১/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি : পর্ব-১১
সুকান্ত নাহা
===============
কোজাগরী
-' বাবু, এ বাবু...বাবু...ইখনতক নিঁদাথিস(এখনও ঘুমোচ্ছিস)...' ডাকটা শুনে মনে হচ্ছিল স্বপ্নের ভেতর বহুদূর থেকে যেন কেউ ডাকছে। ঘুম ভেঙে চোখ বুজে সুবর্ণ আরো একবার ডাকটা শোনার অপেক্ষা করে। ফের শোনা যায়, 'এ বাবু , সোনাবাবু... উ-ঠ বেটা ,মোয় আ-লো(আমি এসেছি) দুরা খুল(দরজা খোল)...' এ গলা সুবর্ণর চেনা, খুব চেনা...। ডাক নাম ধরে একনাগাড়ে সে ডেকে চলেছে। কতদিন বাদে সে এলো.. কিন্তু এখন তো তেমন হাঁটতে পারে না, এতটা পথ এলো কিভাবে! ইদানিং কানেও নাকি কম শুনছে, সেজন্যই কী এত জোরে কথা বলছে সে...!
' হ -উ-উ... রহবে, আ-ও-থো' ' দাঁড়াও আসছি' বলে বেশ জোরে একটা আওয়াজ দিয়ে বিছানা ছাড়ে সুবর্ণ। চটপট জামাটা পড়ে ঘড়ি দেখে। আটটা বাজে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। ভাঙা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাইরের চনমনে রোদ এসে ঢুকছে ঘরে। অফিস থাকলে এ সময়টাতে দম ফেলার ফুরসৎ থাকে না। চটিটা পায়ে গলিয়ে বাইরের দরজা খুলে বেরোতেই, সিঁড়ির ওপর বসে থাকা বৃদ্ধ মানুষটা চোখে পড়ে। মুখভর্তি সাদা দাড়ি। ছোট করে কাটা চুল। খুব রোগা হয়ে গেছে । কোলের ওপর বাঁশের একটা লাঠি। পরনে সেই খাকি রঙা ঢোলা হাফ-প্যান্ট। রক্তের জোর কমে গেলে যা হয়,শেষ শরতের হিমেল শীতেই গায়ে চাপিয়ে নিয়েছে ফুল সোয়েটার । এক দশক আগে মৌয়াবাড়ি হাটে কেনা কাঁধ-কনুইয়ে তালিমারা জলপাইরঙা ঢোলা ফৌজি সোয়েটারটা, শীতকালে যেটা পড়ে সে কাজে আসত, জায়গায়-জায়গায় ছিঁড়ে গিয়ে ভেতরের জীর্ণ জামাটার আভাস দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে থেকেও বেশ হাঁপাচ্ছে সে। হাঁপানির টানটা বেশ বেড়েছে মনে হয়।
সুবর্ণকে দেখে ফোকলা দাঁতে একগাল হেসে কপট শাসনের স্বরে বলে, 'মুরুখ নিঁদাইসলা(খুব ঘুমোচ্ছিস যে) বেটা। ঘরে কোই নখে কি-কা...বহুরিয়া ম-নে...?' ছোট বেলাতেও বেলা করে ঘুমোতে দেখলে সে একথাই বলত। আর বাড়িতে এলে বহুরিয়া অর্থাৎ বৌমা মানে তূর্ণার খোঁজ করে সে করবেই। তূর্ণা থাকতে যখনই আসত, নানান পুরনো গল্প করত সে তূর্ণার সাথে। ছোটবেলায় সুবর্ণ কি-কি দুষ্টুমি করতো, সুধাময় তার পেছনে কঞ্চি নিয়ে দৌড়তেন আর সে রান্নাঘরের পেছনে কচুবনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ত-সে সব কথা, বাঁশঝাড়ে আটকে পড়া কুকুরছানা উদ্ধার করতে গিয়ে মৌমাছির হুল খাওয়া থেকে শুরু করে পোষা হাঁস খাটাশে নিয়ে গেলে পা ছড়িয়ে বসে সুবর্ণর মড়াকান্না কিছুই বাদ যায়নি। তূর্ণা ওর ভাষা কিছু বুঝত, কিছু বুঝত না। তখন হিন্দিতে বোঝানোর চেষ্টা করত সে। তাঁকে যত্ন করে চা-জলখাবার করে দিত তূর্ণা। কাজ সেরে হাতে কলমছুরি( চা গাছ কলম করার ছুরি)টা নিয়ে ঘর্মাক্ত খালি গায়ে, জামাটা কাঁধের ওপর ফেলে,'মোয়া যাথো বহুরিয়া...'( আমি যাচ্ছি বৌমা) বলে হাঁটা দিত বাড়ির পথে। সুবর্ণর বিয়েতে সুধাময় তাকে নিয়ে গেছিলেন শিলিগুড়ির বাড়িতে। কিনে দিয়েছিলেন এক সেট ফুলপ্যান্ট, সার্ট, সোয়েটার। ফুলপ্যান্ট যে মানুষ কোনদিনই পরেনি কিভাবে পরবে সেই নিয়ে তার সে-কি সংকোচ। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে পরানো হয়েছিল সেই প্যান্ট। বরযাত্রী গিয়ে বেজায় খুশি সে, তবু ফুলপ্যান্ট পরার লজ্জা কাটে না । পরদিন বৌ এলে একে একে সকলের সাথে মা যখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁকে দেখিয়ে তূর্ণাকে বলেছিলেন, 'এ হল আমার সোনার লোকাল গার্জেন। একে ছাড়া সোনার চলে না। ছোটো থেকে ওর কোলেপিঠেই যে ও মানুষ। ছোটবেলায় শুক্রা-ভাইয়া,শুক্রা ভাইয়া বলতে অজ্ঞান ছিল। ও আমাদের নীলপাহাড়ির কোয়ার্টারের মালি বৌমা। মালি নামেই,ওকে আমাদের ঘরের লোক বলেই ভেবো।' তূর্ণা হাতজোড় করে নমস্কার করেছিল তাঁকে। বৌ দেখে অমায়িক হেসে সে বলেছিল, ' বহুরিয়া দেখেক মে বহুত সুন্দর আহে মাঈজি...সোনা-লে ঠিক জুড়লক (সোনার সাথে সঠিক জুড়ি হয়েছে)।
- 'ইতনা দূর পায়দল আলে ভাইয়া...আওয়া ভিত্রে আয়কে বৈঠা।(এতদূর হেঁটে এলে ভাইয়া, এসো ভেতরে বসো) সুবর্ণ ঘরের সব দরজা জানালা খুলে দেয়। শুক্রা মাহালি লাঠি ঠুকে ঠুকে ভেতরে এসে বসে। চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে ,'-এক ছিন বৈঠা। মোয় আওথ।' একটু বসতে বলে সুবর্ণ বাথরুমে যায়। খানিক বাদে দু-কাপ চা করে এনে একটা কাপ শুক্রাকে ধরিয়ে দিয়ে সামনে বসে।
' তোর তবিয়ত তো বহুত ঘাইট যাহে ভাইয়া...বিমারি ধইরে কি-কা? ফাগু তো কোনও নি বাতালক'!!(শরীর তো খুব ভেঙে গেছে। অসুখ হয়েছে নাকি? ফাগু তো কিছু বলেনি )' । শুক্রা অবসর নেয়ার পর ওর ছেলে ফাগুকে মালির কাজে বহাল করেছিল সুবর্ণ। ছেলেটা কাজকর্ম করে ভাল। কিন্তু নেশা করে মাসে চার পাঁচ দিন কামাই করে বসে থাকে। তখন নিজেকেই সব করে নিতে হয়। কষ্ট হলেও শুক্রা-ভাইয়ার ছেলে বলে ওকে ছাড়ায় নি এতদিন।
-' বুড়হায় গেলঁ বেটা, ইখন বাগরা-বাটে যায়েক কর টাইম পুইগ গেলাক...(বুড়ো হয়ে গেছি। এখন ওপারে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে..) বলে ম্লান হেসে কাঁপাকাঁপা হাতে চায়ের কাপটা তুলে মুখে দেয়। দু'হাতে কাপটা ধরে একমনে শুক্রা চা খায়, সুবর্ণ তাকে দেখতে থাকে। এই সেই মানুষটা যাঁর কোলে চাপলে কান্না থেমে যেত। যে মানুষটা তাকে গাছ চিনিয়েছে,লতাপাতার গুণাগুণ শিখিয়েছে,পাখি চিনিয়েছে,বাঁশের কঞ্চি কেটে তিরধনুক বানিয়ে দিয়েছে, হাট থেকে গুলতি কিনে দিয়েছে, তলব(বেতন) এর দিন গুদরি হাট থেকে নেশা করে ফেরার পথে কাগজে মুড়ে চুপিচুপি হাতে তেলেভাজা গুঁজে দিয়ে বলেছে 'লে বেটা, খাজা লে, মাঈজিকে নি বাতাবে...। '
চায়ের কাপ রেখে শুক্রা জিজ্ঞেস করে,'বাগান কহিয়া খোলি রে বেটা..মালিকমন সে বাত হোলাক?'চোখের দৃষ্টিতে বৃদ্ধের অসহায়তা ফুটে ওঠে।
বাগান কবে খুলবে, এই প্রশ্নের উত্তর যে সুবর্ণ নিজেও জানে না। পঁয়তাল্লিশ দিন পেরিয়ে গেল। দুটো দ্বি- পাক্ষিক, একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকেও কোনও সমাধান সূত্র বেরোলো না। পুজো চলে গেল। বোনাস হল না। কবে খুলবে তার কোনও আশার আলোও দেখা যাচ্ছে না। কী শোনাবে সে এই বৃদ্ধ মানুষটাকে। সান্ত্বনা দেওয়ার মত সুবর্ণকে বলতে হয়,'জলদিএ খোলি। চিন্তা না কর। '
-' তয় ঘর নি গেলে? '(তুই বাড়ি যাসনি)
বাড়িতে এরমধ্যে একবার গিয়েছিল বটে সুবর্ণ। কিন্তু বেশিদিন থাকেনি। বাগানে প্রায়দিন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মিটিং চলছে । সেই মিটিং এ থাকতে হয়। সুমন্ত স্টাফদের বলেছে বাগান ছেড়ে না যেতে। এর মধ্যে সবাই মিলে সরকারি দপ্তর অভিযান,পথ অবরোধ এ সমস্ত পরিকল্পনা আছে। সকলে মিলে উঠে পড়ে লেগেছে, যে করেই হোক বাগান খুলতে হবে। এ মাসের বেতন হয়নি। বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলছে। বাড়ি গিয়ে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই। তূর্ণা রোজ রাতে ফোন করে জানতে চায়, কী হলো। তাকেও কোনও আশার কথা শোনাতে পারেনি সুবর্ণ। ও রোজ বাড়ি চলে যেতে বলে পীড়াপীড়ি করে। একা কোয়ার্টারে কর্মহীন পড়ে থাকাটা ওর উদ্বেগ বাড়ায়। বাগান বন্ধ হওয়ার পর থেকে ফাগুও আসে না। রান্নাবান্না করার কেউ নেই। একা ঘরে নানান চিন্তা তাড়া করে। টেনশন বাড়তে পারে। এমনিতেই ব্লাড-প্রেশার একটু হাই থাকে সুবর্ণর। তূর্ণার চিন্তা সেখানেই। তাছাড়া এমনিতেই সুবর্ণ কিছুটা ভুলোমনা, আত্মমগ্ন চরিত্রের মানুষ। একা ঘরে লিখতে কিংবা পড়তে বসলে খাওয়া দাওয়াও ভুলে যাবে। ওর চিন্তা সেখানেও। কিন্তু বাড়ি ফিরে গেলে যে অস্বস্তিটা আরো বাড়ে। পরিবারের মাঝে থেকে কর্মহীন বসে থাকার যে কষ্ট তা ভীষণভাবে আড়ষ্ট করে তোলে। তূর্ণাকে সেসব বলা যায় না। তাই তাকে নানান স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে নীলপাহাড়ীর শূন্য কোয়ার্টারে পড়ে থেকে বাগান খোলার অপেক্ষা করে সুবর্ণ।
-'তোর সাঙেঁ এগো বাত হৈক বাবু( তোর সঙ্গে একটা কথা আছে বাবু)। বলে একটু দম নেয় শুক্রা,' ও-হে কারনসে আয় রহলো( সেইজন্যই এসেছিলাম)।'
-' বাতা' (বল)। সুবর্ণ ভাবে কী কথা শোনাতে এতদূর কষ্ট করে হেঁটে এসেছে মানুষটা কে জানে।
ধীরেসুস্থে দম নিতে নিতে শুক্রা যা বলে তা হল এই যে ফাগু হঠাৎ কেরালা চলে গেছে! লাইন(বস্তি) থেকে আরো অনেকে গেছে। তাদের সঙ্গে। সেখানে নাকি গেলেই কাজ জুটে যায়। মাইনেও বেশ ভাল। কবে ফিরবে কোনও ঠিক নেই। এদিকে দুদিন আগে ছেলের-বৌও ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। বলেও যায়নি কবে ফিরবে। ঘরে একটুও চাল নেই। পয়সাকড়িও নেই। তাই আতান্তরে পড়েছে বৃদ্ধ। হাঁটাচলা করতে পারে না। হাঁটলে শ্বাসকষ্ট হয়। তবু উপায়ান্তর না দেখে এতটা পথ হেঁটে সুবর্ণর কাছে এসেছে। সব শুনে সুবর্ণ একটু ভেবে নিয়ে রায় দেয়,
-'তোয় হিনে মোর সাঙে রই যা ভাইয়া। মোরএ সাঙে খাবে। '(তুমি এখানে আমার সাথে থাকো। আমার সাথে খেয়ো) '
কথাটা বলেই সুবর্ণর মনে হয় শুক্রা তাতে রাজি হবে না। ভীষণ আত্মসম্মান ওঁর। একবার কোনও কারণে নেশা করে কদিন কাজে না এলে সুধাময় তার হাজিরা কেটে দেয়। তারপর একদিন কাজে এলে তাঁকে বকাবকি করেন ভীষণ। যেজন্য টানা একমাস কথা বলেনি সে বাড়ির কারো সাথে। এমনকি যে কদিন 'নাগা' মানে কামাই করেছিল রোববার ছুটির দিনে কাজ করে তা পুষিয়ে দিয়ে কাজ ছেড়ে দিতে চেয়েছিল সে। মা তখন অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মত পরিবর্তন করিয়েছিলেন তাঁর।
যথারীতি শুক্রা রাজি হয় না। সুবর্ণর কাছে শুধুমাত্র চাল কিনবে বলে সামান্য কিছু টাকা চায়। ছেলে ফিরলেই সেই টাকা ফিরিয়ে দেবে বলে অঙ্গিকার করে। চাল কিনে সে দু'মুঠো ফুটিয়ে খাবে। ঘরে কাঠ আছে। সামান্য তেল-নুন আছে। জঙ্গলে কচুশাক,বাড়ির সবজি খেতে শিমলকন্দা(একরকম কন্দ) আছে। তা দিয়ে ক'টা দিন দিব্যি চলে যাবে এই তার বিশ্বাস। নগদ টাকা সুবর্ণর হাতেও বিশেষ নেই। তাছাড়া চাল কিনে দিলেই কি শুধু হবে। মানুষটাকে রোগে ধরেছে তা বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে। চিকিৎসাও কিছু যে হচ্ছে না সেটাও স্পষ্ট। হাত-পা গুলো বেশ ফোলা। রক্তশূন্যতার লক্ষণ। বাগানের হাসপাতালে পাশ করা কোনও ডাক্তার নেই আজ অনেক বছর হল। আর.এম.পি সার্টিফিকেটধারি ডাক্তারই এখন বেশীরভাগ চা-বাগানে। পর্যাপ্ত ওষুধ এমনিতেই মেলে না। আর এখন বন্ধ বাগানের জন্য মালিক কোনও ওষুধও দেবে না। চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে ব্লক হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্সের তেলের জন্য চিঠিপত্র লেখালেখি করার পর বিডিও সাহেব সেটা অন্তত বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। যদিও জরুরি পরিষেবাগুলি এখনও চলছে। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে! সরকারি রেশন যেদিন দেয়া হবে সেদিন না হয় বলে কয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু চালের সাথে চিকিৎসাও যে প্রয়োজন লোকটার।
সুবর্ণ তাঁকে সব বুঝিয়ে বলে। সেদিনকার মত তাকে তার কোয়ার্টারেই থাকতে বলে রাজি করায়। পরদিন ব্লক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাবে বলে ফোন করে বাগানের ডাক্তারবাবুকে সব জানায়। অ্যাম্বুলেন্সের কথা বলতেই তিনি বলেন, ' রক্তাল্পতা, বুঝলেন না... রক্তাল্পতা...সিভিয়ার অ্যানিমিক। এরা জীবনভর দারু খাবে... এদিকে খাওয়া নেই পেটে...। হবে না...! আপনি আর কতটুকু কী করবেন। ঠিক আছে। নিয়ে যান। যদি বাঁচে...। '
' কেন আপনার কী মনে হয়... বাঁচবে না... ' একটু যেন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে সুবর্ণ।
-' না, বাঁচবে না তা বলছি না। বাঁচলে বাঁচতেও পারে। তবে কি, বয়স হয়েছে তো...হাত-পা ফুলেছে। দ্যাখেন কি হয়..! ' সুবর্ণ আর কথা বাড়ায় না। ফোন রেখে দেয়।
সেদিন দুপুরে উঠোনে ইঁট পেতে উনুন ধরায় শুক্রা। কলাপাতা কেটে আনে। দু'জনে মিলে ডিমের ঝোল আর ভাত রান্না করে। ভাত রেঁধে ঝাঁকড়া তেজপাতা গাছের তলায়, শীতের মিষ্টি রোদে পিঁড়ি পেতে কলাপাতায় ভাত বাড়ে শুক্রা। চান সেরে সুবর্ণ খেতে বসে। খেতে খেতে দুজনার কথা হয়। নানান কথা। তূর্যর কথা শুনে চোখ দুটো চকচক করে। কথাপ্রসঙ্গে ও সুবর্ণর ছোটবেলার কথায় ফিরে যায়। সেইসঙ্গে তূর্যকে একবার দেখার ইচ্ছেটাও প্রকাশ করে । সুধাময়ের কথা শুনে আপশোষ স্বর্গত মাঈজির কথা বলতে বলতে ওর চোখ ছলছল করে ওঠে। ছেলে-বৌ এর সংসারে নিজে যে ভাল নেই সে কথাও অকপটে বলতে ছাড়ে না। খেতে খেতে সুবর্ণর মনে পড়ে যায় মা কখনও কখনও ওকে দুপুরে খেয়ে যেতে বলত। বৌ মারা যাওয়ার পর একমাত্র ছেলেকে নিয়েই ছিল শুক্রার সংসার । বাড়ি ফিরে রান্না খাওয়া সেরে বিকেলে ফের কাজে আসত হত তাকে। মা প্রায়ই তাই ওকে খাইয়ে ছেলের জন্যও দিয়ে দিত। খেতে দিলে নিজের সানকিটা এনে ও ভাত নিত। পাশে রাইশাক,তরকারি, কখনো একটু মাছ। একটু নুন লঙ্কা চেয়ে নিয়ে ও বসে পড়ত পাকঘর(রান্না ঘর) সংলগ্ন কলতলার মেঝেতে। সুবর্ণ উল্টো দিকে বসে ওর খাওয়া দেখতে দেখতে মার কাছে বায়না ধরত,তাকেও ওরকম থালায় ভাত বেড়ে দিতে হবে। ভাইয়ার মত উবু হয়ে বসে, হাঁটুর ওপর বাঁ হাত ছড়িয়ে ও শাক দিয়ে ভাত খাবে। বায়নায় অতিষ্ঠ হয়ে মা একদিন সত্যি সত্যি ভাত বেড়ে দিলেন। চোখ মুছতে মুছতে হাসিমুখে ভাইয়ার সঙ্গে বসে সেদিন ভাত খেয়েছিল সুবর্ণ। আজ কতদিন বাদে আবার সেই দিনটাই যেন ফিরে এল। সেদিন সুবর্ণ কেঁদেছিল এই মানুষটার সাথে খাবে বলে। আজ চোখ ভিজে ওঠল তাঁকে পরম যত্নে সানন্দে খেতে দেখে।
সেদিন রাতে ডাইনিং রুমে ক্যাম্প-কট টা ফেলে বিছানা পেতে শুক্রাকে শুতে দিয়েছিল সুবর্ণ। ভোররাতে হঠাৎ গোঙানোর শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে ছুটে এসে দেখে মানুষটা কাঁপছে। পাতলা চাদরে হয়ত শীত মানছে না ভেবে কম্বলটা বের করে গায়ে দিতে গিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষটাকে জাগিয়ে ওষুধ দিতে ইচ্ছে করল না। সকাল হতেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে শুক্রা কে ব্লক হাসপাতালে নিয়ে যায় সুবর্ণ। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন নিউমোনিয়া। তাছাড়া রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও ভীষণ কম। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় শুক্রা কে। তিনদিন ভর্তি ছিল সে হাসপাতালে। প্রতিদিন তাকে দেখতে গেছে সুবর্ণ। জ্বর বাড়ছে, কমছে। জ্বরের ঘোরে নানান অসংলগ্ন বকছে। আচ্ছন্নের মত পড়ে ছিল মানুষটা। তিনদিনের মাথায় ওঁর মৃত্যু হয় । বন্ধ নীলপাহাড়ি চা বাগানে প্রথম মৃত্যু। কাগজে সেই মৃত্যুকে অনাহারে মৃত্যুর তকমা দিয়ে বেশ গুরুত্ব সহ ছাপা হয়। আর বাঁশলাইনের হিন্দুদের মুর্দা-গাড়ায়(কবরস্থান) লাইনের আরো মানুষ জনকে সঙ্গে নিয়ে শুক্রা ভাইয়ার কবরে মাটি দিয়ে সন্ধে নাগাদ সুবর্ণ ঘরে ফেরে। অন্ধকারে শূন্য ঘরের দরজাটা খুলতে গিয়ে চোখে পড়ে বারান্দার এককোনে বাঁশের লাঠিটার ওপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। শুক্রা-ভাইয়ার ফেলে যাওয়া স্মৃতি চিহ্ণ। প্রয়োজন ফুরিয়েছে ওটার। চলে গেলে মানুষের জাগতিক কোনও কিছুরই আর প্রয়োজন পড়ে না। তবে মৃত মানুষকেও জগতের কখনও কখনও খুব বেশী প্রয়োজন পড়ে। প্রয়োজন পড়ে তার নাম ধাম, আইডেন্টিটি, মৃত্যুর কারণ। বেঁচে থাকতে সে যে এ জগতেরই জীব কেউ তা জানত না। অথচ মৃত্যুর পর সহসা সে পরিচিতি লাভ করে। আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠিত হয় যেন তাঁর।
জোৎস্নায় ভিজে যাওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুবর্ণর মনে পড়ে যায় আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। মা লক্ষী আজ স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন এই বাংলার ঘরে ঘরে। সুখ-সমৃদ্ধি কামনায় ঘরে ঘরে পূজিতা হবেন দেবী। শস্যপূর্ণা বসুন্ধরার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর আশীর্বাদে শস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে মাটি। শুধু দুটি পাতা একটি কুঁড়ির এই শস্যক্ষেত রয়ে যাবে দেবীর অগোচরে। ঘরে ঘরে শূন্য ভাঁড়ারের মাঝে শুয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তায় রাত জাগবে হতভাগ্য কয়েক হাজার মানুষ। কোজাগরীর রাত।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴