সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
25-August,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 551

কলিচুন/শুক্লা রায়

কলিচুন
শুক্লা রায়


বেশ করে দই-চিঁড়ে মেখে খেয়ে মনোজের মা  ক্ষীরোবালা একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। বরাবরই দুধ, দই তার প্রিয়। এখন তবু নিজেরই একটা গাই দোয়াচ্ছে। তা হয়, নাই করেও সকালে দেড় কেজি, বিকালে আধা কেজি মতো। বাচ্চায়-কাচ্চায়, চা-পানি খেয়েও বৌমা একটু করে দই পাতে। তাই দিয়েই সকালের খাওয়াটা হয় সবার। গামছাবান্ধা দই না হলেও বড্ড সুন্দর দইটা। এখন একটু পান মুখে দিতে হবে। খাওয়ার পরে পানটাই হল আসল জিনিস। নইলে আর বেঁচে থেকে কী সুখ! পানে, চুনে বেশ করে নিয়ে তাতে একমুঠো সুপারী ফেলে, এক চিমটি গুন্ডি দিয়ে সবে মুখে ঢুকাবে, কে না কে একটা মেয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ করে চিনতেই পারল না। মেয়েটাও মুখে কিছু বলছে না। আঁটোসাঁটো কাপড়ে ছিপছিপে রোগা শরীর। গায়ের রঙটা শ্যামলার দিকেই। মুখখানি বেশ কোমল, একটা শ্রী রয়েছে, তার মধ্যে কেমন একটা দুষ্টুমীভরা হাসি। হাতের পান হাতেই থাকল। চোখটা সরু করে মেয়েটার দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে ধীরে পানটা মুখে চালান করে দিয়ে এবার একটু হাসল। ওকে ওভাবে তাকাতে দেখে মনোজের বাবা হুঁকাটা বেড়ার গায়ে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে বলে, "চিনো নাই? ও হল বিনো।" 
চিনেছে ঠিকই এবার। তাড়াতাড়ি পিঁড়ি একটা পেতে দিয়ে বলে "বস মা, বস। তোর মা কোথায়?"
বলতে বলতেই অবশ্য ওর মা মাথায় একটা বড় ডোগা নিয়ে হেলে দুলে উঠোনে এসে দাঁড়াল। সাবধানে ডোগাটা নামিয়ে রাখল। তারপর বলল, "দাও দাও। তোমাদের ডোগাটা দাও। চুনটা দিই আগে।"
মনোজের মা ক্ষীরোবালা ঘরে গিয়ে কালো একটা ডোগা নিয়ে আসে। মুখটায় তেলকালো রঙের নারকেলের মালা বসানো। বিনোর মা এবার বাঁশের তৈরি একটা হাতা দিয়ে সাবধানে চুন ঢেলে দেয়।
এরা হল যুগী সম্প্রদায়। বংশানুক্রমে ঝিনুক পুড়িয়ে চুন তৈরি করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে। স্থানীয় ভাষায় বলে কলিচুন। কেউ নগদে পয়সা দেয়, কেউ ধান অথবা চাল দেয়। যে যা দেয় সেটাই দাম। বেশি কিছু জোরাজুরি কর চায়ও না কখনো।
ক্ষীরোবালা এবার বিনোর শূন্য সিঁথির দিকে লক্ষ্য করে নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপর বলেন, "সেই ছোটবেলায় দেখেছি। বড় হয়ে আর একদিনও দেখলাম না। তা এখন কী এখানেই থাকিস, তোর মায়ের কাছে?" বিনোর মা ও বিধবা। কষ্ট করে ছেলে-মেয়ে দুটোকে মানুষ করেছে। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে কী হল! সেই ঘাড়ে এসে পড়ল। বিনো হেসে মাথা ঝাঁকায়। ক্ষীরোবালা এবার বৌমাকে চেঁচিয়ে চা করতে বলতে গিয়ে দেখে বৌমাও এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে। ওর পেছনেই। শাশুড়ি মায়ের ঘাড় ফিরিয়ে তাকানো দেখেই ও বুঝে গেছে। হাসি মুখে বলে, "এই তো বসাই চা। গোয়াল ঘর থেকে পাটকাঠি নিয়ে আসি।" সবার কৌতুহল, এত অল্প বয়সে বিধবা কেন মেয়েটা। ক্ষীরোবালা শুনেছে কিছু কিছু। কিন্তু আসলে অন্যের দুঃখের কথা বারবার শুনতে ভালোই লাগে। আহারে! 
সেদিন ছিল প্রচন্ড বৃষ্টি। সারাদিন মানুষগুলো ঘরে। মাটির ঘর। বের হওয়ার উপায় নেই দেখে ওখানেই গল্পগুজব। আবার খেয়ে-টেয়ে সবাই একটা করে ঘুম দিয়ে উঠেছে। এরপরে রাতে কী আর ঘুম আসে? বিনোর বর রতন নাকি কেবলি উসখুস করছে। এদিকে বিনোর তখন সদ্য মেয়ে হয়েছে। আঁতুর আলাদা। বিনো কিছুই জানে না। রাতে হঠাৎ রতনের চিৎকার। শুয়ে পড়েছে বলে কূপী টুপী সব নেভানো। ওই অন্ধকারেই রতন চিৎকার করছে, "পোকায় কাটল গো, আমারে পোকায় কাটলো গো।"  ওর শাশুড়ি তাড়াতাড়ি করে কুপী জ্বালিয়ে দেখে ডান পা চেপে ধরে রতন চিৎকার করছে। বাইরে এদিকে এই বৃষ্টি কী সেই বৃষ্টি। পোকার আর কী দোষ! বাইরে সবখানে জল দেখে সাপ এসে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু রতন কী আর তা জানে। অজান্তে পা নড়াচড়া করতে গিয়ে লেগে গেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে কামড়। সেই রাতটাই বিনোর জীবনে কাল রাত। দৌড়ে ভ্যানওলার বাড়ি গিয়ে ভ্যানওলাকে ডেকে তুলে যখন রওনা দিল ততক্ষণে প্রায় দু ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। পায়ে পর পর দু জায়গায় শক্ত বাঁধন দিয়েও রতনের ঝিমুনি আটকানো যাচ্ছে না। বিনো দুধের শিশু বুকে চেপে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ভয়ে ভাবনায় কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞানও হয়ে যায়। ঘরে শুধু তার শাশুড়ি। তিনি আবার আঁতুরে ঢুকতে পারবেন না, ছেলের মঙ্গলকামনায় ঠাকুর ঘরে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন। শেষে পাশের বাড়ির একজন বয়স্কা মহিলাকে তিনিই ডেকে এনে মাথায় জল দিয়ে বিনোর জ্ঞান ফেরায়। এত কিছুর পরেও কিন্তু রাতটাও ঠিকমতো কাটেনি। হাসপাতালের ভেতর ঢুকতে ঢুকতেই রতন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ডাক্তার বার বার জানতে চাইছিল কী সাপে কেটেছে। সে অন্ধকারে কী বোঝা যায়! তবু রতনকে দেখেই সবাই টের পেয়েছে, এ হল জাত সাপের কাজ। রতনের বাপ নেই। ওর পরেই ছোট ভাই একটা। বর্ষা পেরোলেই ভাইটার বিয়ে দেবে দেবে কথা চলছে। দুই এক জায়গায় মেয়েও দেখে এসেছে রতন। প্রাইভেটে অবশ্য। ভাইও জানে না। তো সেই ভাই আর পাড়ার আর দুটো ছেলে মিলে চলল রতনের সঙ্গে। সমস্তটা পথ ওরা নানান কথা বলে রতনকে জাগিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হল না। রতন ক্রমশ নেতিয়ে পড়তে পড়তে হাসপাতালে ঢুকে বাঁধন খুলে চিকিৎসা শুরু করতে না করতেই শরীর ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শেষ। কথা শেষ হলেও বিনোর চোখের কোণে দু ফোঁটা জল চিক চিক করে। "মানুষটা বড় ভালো ছিল।"
এবার চায়ের কাপটা হাতে তুলতে তুলতে বিনোর মা বলে, "তারপর ওই তো! সব কাজ শেষ করে বাচ্চা-কাচ্চাসুদ্ধ ওর দেওর এসে রেখে গেল। আমি ভাবলাম আসলো যখন, তাড়া কিসের! দুদিন থাকবে, যাবে। দেখি আর নিতে আসে না। একমাস পরে নিয়ে গেলাম, বাড়িতেই ঢুকতে দিল না দিদি। আমি মরে গেলে কী হবে মেয়েটার? ভাই কী আর দেখে?"
সবাই এবার বিনোর দিকে তাকায়। শ্যামলার মধ্যে মিষ্টি গড়ন। এই মেয়েটার স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকার কথা ছিল। একেই বলে নিয়তি। গল্পের গন্ধ পেয়ে উঠোনে বেশ ক'জন জমে গেছে। কেউ একজন বলে, "ঢুকতে দিল না আর তুই চলে এলি? জোর করে থাকা উচিৎ ছিল।" কথাটা শুনে বিনোর চোখদুটো হঠাৎ যেন জ্বলে ওঠে বাঘিনীর মতো। পরক্ষণেই ঠান্ডা হয়ে বলে, "ওরা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে গো। পাড়ার সবাই তো ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছিল সেদিনও। আমার মেয়েটা অপয়া। ওর জন্ম হল আর ওর বাপটা মরল।"

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri