আনন্দপুর চা-বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
আনন্দপুর চা-বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^
সরস্বতীপুর চা বাগিচা থেকে রাগবি দুনিয়ার খোঁজখবর নিয়ে একটা অদ্ভূত ভালোলাগার আবেশ নিয়ে রওনা দিলাম আনন্দপুর চা-বাগিচার দিকে। অনেক দেরী করে ফেলেছি। আজকের আনন্দপুর বাগিচা সার্ভের কাজ অসমাপ্ত রাখলে অসম্ভব চাপে পড়তে হবে। সরস্বতীপুর চা বাগান থেকে বের হবার পথে রাগবী কোচ রোশনকে অভিনন্দন
জানিয়ে মেগা পর্যটন হাব ভোরের আলোকে সঙ্গী করে ক্যানেলের পাশ দিয়ে ক্যানাল রোড ধরে রওনা দিলাম আনন্দপুরের দিকে। আনন্দপুর চা-বাগনকে ঘিরে যে বাগিচাগুলি রয়েছে সেগুলি হল কৈলাসপুর, যোগেশচন্দ্র, নেপুচাপুর, নেওড়ানদী, ডামডিম, কুমলাই চা-বাগিচাগুলি। বাগিচার ম্যানেজারকে গিয়ে পরিচয় দিতে স্বাগত জানালেন। ডিবিআইটিএ থেকে আগেই জানানো ছিল বাগানে আসব কিছু তথ্য নিতে। মাল মহকুমার আনন্দপুর চা-বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী নিউ চামটা টি কোম্পানি। কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরের নাম শারদ বাজোরিয়া, পরিচালকবর্গ নীরজ কুমার কুনঝুনওয়ালা, গৌরী বাজোরিয়া, ধনরাজ বৈদ। শারদ বাজোরিয়া ম্যানেজিং ডিরেক্টর। অন্যান্যরা ডিরেক্টর। বাগানের ব্যাপ্তি ১৫০০ একর। বছরে কোম্পানী প্রায় এক লক্ষ কেজি উন্নতমানের তৈরি চা উৎপাদন করে। উৎপাদিত চায়ের প্রকৃতি অনুযায়ী এই বাগানে ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত চা উৎকৃষ্ট মানের এবং আনন্দপুর বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকেও উন্নতমানের বাগান। আনন্দপুরের যে চারটে ব্র্যান্ড নামে চা মার্কেটিং হয় সেগুলি হল আনন্দপুর রয়াল, সুপ্রিম,এস গোল্ড এবং আনন্দপুর এস। বাগানে বিভিন্ন ধরনের মূল্যাবান গাছ এবং বিভিন্ন ভেষজ এবং মশলার গাছ আছে। আনন্দপুর চা বাগিচার নিজস্ব ফ্যাকটরিতে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ছোট চা বাগিচার মালিকেরা চাদের কাঁচা চা পাতা সরবরাহ করে এবং আনন্দপুর চা বাগিচা তাদের নিজেদের ফ্যাক্টরিতে বাইরে থেকে আসা এই কাঁচা চা পাতা প্রসেস করে আরো এক লক্ষ কেজি তৈরি চা উৎপাদন করে। বাগিচা সার্ভে করতে গিয়ে এবারে কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। ক্যানেল রোড ধরে আনন্দপুর চা বাগিচা ১৫ কিমি, ৪০ মিনিট সময় লাগে। ক্যানাল রোড থেকে আপালচাঁদ অরণ্যের ছায়াঘেরা পথ। কৈলাশপুর চা বাগিচার মোড় ছাড়িয়ে আনন্দপুর চা বাগিচার বাসা লাইনের মুখে একটা ছোটো মাঠে ভিড় এবং হৈ হৈ শুনে খুব কৌতূহল হল। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম মোরগ লড়াই হবে। কোনদিন মোরগ লড়াই দেখিনি। অথচ শুরু হতে তখনো অনেক দেরী। তাই মন খারাপের অনুভূতি নিয়ে চলে আসতে হল। কিন্তু বাগিচাতে জোয়েলের কাছে পেলাম এক অদ্ভূত তথ্য। জোয়েল মূর্মূ। গুদামবাবু্র ছেলে। ম্যানেজারের অনুমতি নিয়ে জোয়েলের সঙ্গেই বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর বাগিচার গল্প শুনছিলাম। শুনলাম মোরগ লড়াইয়ের পিছনের অকথিত কাহিনী। শীতের মরশুম পড়তেই চা বাগিচা সংলগ্ন হাটবাজারগুলিতে এবং ডুয়ার্সের চা বাগান এলাকায় নিয়মিত চলে মোরগ লড়াই। লড়াইয়ের আকর্ষণ বাড়াতে মোরগগুলির নাম রাখা হয় হিন্দি সিনেমার নায়ক ও খলনায়কদের নামে। আর মোরগ লড়াইয়ের নামে এই খেলাতে ধরা হয় হাজার হাজার টাকা বাজি। জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারের বিভিন্ন হাটবাজার সহ চা বাগান এলাকাগুলিতে এখন মোরগ লড়াইয়ের নামে জুয়া খেলার আসর রমরমিয়ে চলছে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মানুষের মদতে গোটা ডুয়ার্সে মোরগ লড়াইয়ের আড়ালে চলে হাজার হাজার টাকার বাজি।
জোয়েলের কাছ থেকে জানলাম এই লড়াইয়ের জন্য একেবারে শক্তপোক্ত লাল ঝুঁটিওয়ালা দুটি মোরগ আনা হয়। খেলার শুরুতেই কে কোন মোরগের হয়ে বাজি ধরবে তা ঠিক করা হয়। তারপর মোরগগুলিকে সামনাসামনি ছেড়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় লড়াই। দুই মোরগের দুই মালিক দর্শকদের থেকে টাকা তুলতে থাকে। লড়াই শেষে একটি মোরগ হেরে যাওয়ার আগেই বাজির টাকা তুলে নেয় মোরগের মালিক। তার পর যে মোরগ জেতে তার জন্য বাজি ধরা দর্শকদের টাকা ফেরত দেয় মালিক। তবে এই খেলায় মোরগের মালিকরা কারসাজি করে থাকে বলেও নাকি অভিযোগ ওঠে। জোয়েলের মতে, যে মোরগের জন্য বেশি মানুষ বাজি ধরেন, সেই মোরগটিই হেরে যায়। এতে দর্শকদের যত না টাকা ফেরত দিতে হয় তার তুলনায় বেশি টাকা উঠে আসে। একদিকে নায়কের নামে এক মোরগের নামকরণ, অন্যদিকে হিন্দী ফিল্মের কোন এক জনপ্রিয় ভিলেনের নামে অপর মোরগ লড়াইতে নামে। চলে মুখোমুখি লড়াই। চলে হাততালি আর সিটি। লড়াই শেষে নায়ক বা ভিলেন যেই জিতুক না কেন তাকে কোলে তুলে নিয়ে চক্কর খান এক যুবক এবং তার হাতে থাকা ব্যাগে উপস্থিত জনতা তুলে দেয় টাকা। লড়াইয়ে হেরে যাওয়া মোরগকেও আবার জিতে যাওয়া মোরগের মালিকের হাতে তুলে দিতে হয়। এমন ঘটনা শুনে মনে হতেই পারে একটি প্রত্যন্ত চা বাগান এলাকাতে হিন্দি সিনেমার শুটিং হচ্ছে। তবে এমনটা ভাবলে কিন্তু ভুল।
ফেরার পথে দেখলাম ভিড় জমে গেছে মোরগ লড়াইয়ের ওখানে। নামলাম। দেখলাম আমার চেহারা ছবি দেখে অনেকগুলো মুখ বিরক্ত হচ্ছে। মোরগগুলোকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে মালিকেরা সেটাও চোখে পড়ল। কোন ভনিতা না করে মোরগ মালিকদের গিয়ে জানালাম আমি পর্যটক এবং লেখক। ঘুরতে এসেছি চা বাগিচা অঞ্চলে। ছবি তুলব এবং মোরগ লড়াই দেখব। ছবি তোলার কথা শুনে তারা দেখলাম রীতিমত ভয় পেয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই নানা টালবাহানা করে দেরী করতে লাগল। বুঝলাম আমি না গেলে ওরা মোরগ লড়াই শুরু করবে না। এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম প্রতি হাটেই মোরগ লড়াই বসে। যারা হাটে কেনাকাটা করতে আসে তারাই মোরগ লড়াই দেখে বাজি ধরে। বাজি ধরে অনেকে বাজার করার টাকা হেরে যায়। তার পরে খালি হাতে বাড়ি ফেরায় অশান্তি হয়। কিন্তু তাও প্রশাসন সব জেনেও এই জুয়ার আসর বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দেখলাম শীতের পড়ন্ত বিকেলে জুয়ার আসরে ভিড় বাড়ছে। সেই আসরে একদিকে যেমন চা বাগানের শ্রমিকরা বাজি ধরছে, তেমনই ভিড় জমাচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা। মোরগ লড়াই দেখে বড়োদের পাশাপাশি ছোটোরাও বাজি ধরছে। অনেকে নেশা করে এসেও মোরগ লড়াইয়ে হাজার হাজার টাকা বাজি ধরছে। তবে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের কাছ থেকে শুনলাম শ্রমিকদের সচেতনতার কাজও চলছে। জুয়ার আসরের এই প্রবণতায় উদ্বেগ বেড়েছে এলাকায়। শুধু জুয়া নয়, জুয়ার আসরকে কেন্দ্র করে ওই দুই এলাকায় বাড়ছে মদের ঠেক। সেখানে গিয়ে পড়ুয়ারা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব দেখে এলাকার শ্রমিক অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। জুয়া ও মদের আড্ডা বন্ধ করতে পুলিশ কেন কড়া পদক্ষেপ করছে না সেই বিষয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ওই দুই এলাকায়। চা বাগান এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে মোরগ লড়াইয়ের চল দীর্ঘদিনের। আগে তা শ্রমিকদের বিনোদনের অঙ্গ হিসাবে গণ্য করা হত। সময় পালটে এখন মোরগ লড়াই জুয়া খেলার অংশ।
লেখা যেহেতু বাগান সমীক্ষা নিয়ে তাই শ্রম অফিস থেকে পাওয়া এবং বাগিচা থেকে আপডেট নেওয়া বাগিচা সমীক্ষার সামান্য কিছু পরিসংখ্যান তো দিতেই হয়। ১৮৮৯ সালে কোম্পানির জন্মের হিসাব ধরলে প্রায় ১১৯ বছরের পুরনো বাগানটির পরিচালনগত পরামর্শদাতা ডিবিআইটিএ। বর্তমান পরিচালকবর্গ ১৯৯৬ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ১০ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন অনেকগুলি। এগুলি হল পি.টি.ডব্লউ,ইউ, সি.বি.এম.ইউ, টি.টি.পি.ডব্লউইউ, ডব্লউ.ই.বি.সি.এম.এস, জে.সি.বি.ডব্লউ.ইউ ইত্যাদি। তবে ইউনিয়নগুলি নামেই আছে। শাসকদলের প্রাধান্য বেশি। আর যেহেতু মালবাজার লালঝান্ডার জায়গা, ট্রেড ইউনিয়নের শক্ত ঘাঁটি, তাই জয়েন্ট ফোরামের প্রাধান্য। আনন্দপুর চা-বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৬৩১.৭ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৩৯৫.৪৫ হেক্টর। উৎপাদনযোগ্য এবং ড্রেন ও সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ১৭৬০ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। চা-বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৫৫ জন, করণিক ৬ জন, ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ৪ জন, কম্পিউটার অপারেটর ২ জন, সর্বমোট সাব স্টাফ ৫৫ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৪৯১ জন। মোট শ্রমিক পরিবার ৭৫২টি। আনন্দপুর চা-বাগানে আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটারসহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ২৮৫টি। অন্যান্য বাড়ির সংখ্যা ৪৬৭। বাগানে শতকরা ৭৭ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। আনন্দপুর চা-বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা ৩০-৩৫ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য তৈরি চা ৭-৮ লাখ কেজি। তবে শুরুতে যে পরিসংখ্যান দিয়েছিলাম সেটা নিলামে পাঠানো ব্রান্ডেড চা যা চারটি ব্র্যান্ড নামে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম পায়।
কৈলাশপুর চা বাগিচার লেখাতে প্রখ্যাত চা গবেষক রামঅবতার শর্মাজীর কাছ থেকে বাগিচার স্বাস্থ্যনীতি সংক্রান্ত কিছু মূল্যাবান তথ্য পেলাম যেগুলি উল্লেখ না করলেই নয়। প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টে কোথাও বলা নেই চা বাগিচাতে যেসব ডাক্তার তাদের ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হবে বা তার প্রয়োজন আছে। বাগিচাতে খুব সাধারণ রোগের চিকিৎসা করা হয় যেগুলি ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকেরাও করতে পারেন। অধিকাংশ চা বাগিচাগুলিতে প্রশিক্ষিত কমপাউন্ডার রয়েছে যাদের ওয়েস্ট বেঙ্গল ফার্মাসি কাউন্সিলের অনুমোদন আছে এবং তারা প্রায় সকলেই ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্ট। স্বাস্থ্য সমীক্ষা করতে গিয়ে আনন্দপুর চা-বাগিচার হাসপাতালে দেখলাম আলাদাভাবে পুরুষ/মহিলা আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা না থাকলাও মেটারনিটি ওয়ার্ড আছে। হাসপাতালে মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৮টি, ফিমেল ওয়ার্ড ৩টি। অপারেশন থিয়েটার চোখে পড়ল না। বাগিচায় দেখলাম অ্যাম্বুলেন্স আছে। শুনলাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। বাগিচায় ডাক্তারবাবু আবাসিক ভিত্তিতে বাগিচায় নিযুক্ত। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ২ জন, কম্পাউন্ডার এক জন, স্বাস্থ্য সহযোগী একজন। বাগিচায় সাধারণ রোগের মোটামুটি সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। আনন্দপুর চা-বাগিচায় ২০১২ সালের নভেম্বর মাস থেকে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই শুনলাম। বাগিচার একটিমাত্র ক্রেশে ৩ জন অ্যাটেনডেন্ট আছে। ক্রেশগুলিতে শৌচাগার, পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা, দুধ বিস্কুটের ব্যবস্থা আছে। দুধের গুণগত মান ভাল নয় বলে শ্রমিকদেরই অভিযোগ। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় অনেক দূরে। শ্রমিক সন্তানদের বাসে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা আছে। তবে বাসের সংখ্যা একটিমাত্রই। অন্য যানবাহনের ব্যবস্থাও নেই। বাগানে খেলার মাঠ আছে। আনন্দপুর চা-বাগানে প্রভিডেন্ড ফান্ড বকেয়া থাকে না। গড়ে ৫০ লাখ টাকা প্রভিডেন্ড ফান্ডে জমা পড়ে বছরে। শ্রমিকদের মজুরি চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। রেশনও বকেয়া পড়ে থাকে না। তবে বেশ কিছু শ্রমিকের গ্র্যাচুইটি বকেয়া রাখার তথ্য পাওয়া গেছে বাগানের শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে।
খুব ভালো লাগল একথা শুনে যে করোনাকালের সময় থেকে আনন্দপুর চা বাগানের ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মাস্ক না পড়লে দৈনিক পাতা তোলার মজুরি মিলবে না। চা পাতা তোলার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, চা কারখানাতেও এই বিধি লাগু থাকবে। করোনা মোকাবিলায় এই কড়া পদক্ষেপ নিয়েছিল বাগান কর্তৃপক্ষ। তাই চা বাগানে মাস্ক 'মাস্ট' ছিল। এই প্রবণতা এখনো চোখে পড়ল কারখানার ভিতরে ও বাইরে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে চা বলয়ে কড়া ফতোয়া জারি করেছিল আনন্দপুর। চা পাতা তোলার সময় মানতে হবে দূরত্ববিধি। ব্যাবহার করতে হবে স্যানিটাইজার। এই সমস্ত না মেনে দিনভর চা বাগানে কাজ করলেও মিলবে না হাজিরা। বাগান কর্তৃপক্ষের জারি করা ফতোয়া মানতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছে বাগানের শ্রমিকরা এবং তার সুফল ফলেছে হাতে হাতে। তবে একথা ঠিক সবুজের চা বলয়ে এখন মাস্কের ছড়াছড়ি। জেলার চা বাগান মহল্লায় এখন ঘুরলেই দেখা যাবে চা বলয়ের মুখ ঢেকেছে মাস্কের আড়ালে। আলিপুরদুয়ার জেলায় ৬৭ টি চা বাগান রয়েছে। প্রায় সবগুলো চা বাগানের শ্রমিকদের কাজের সময় করোনা বিধি মানার নির্দেশ দিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র বাগানে চা পাতা তোলার সময়ই নয়, করোনা বিধি মানতে হবে ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময়, কিংবা চা প্যাকেজিং করার সময়তেও। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে কোনও বাগানেই ঢুকতে দেওয়া হয় নি বহিরাগতদের। এমনকী শহুরে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয় নি চা বাগানের চৌহদ্দির মধ্যে। সংক্রমণের জেরে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বাগানের শ্রমিক সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে করোনার প্রথম ঢেউ আটকাতে পেরেছিল ডুয়ার্সের চা বলয়। শহরের তুলনায় এই চা বলয়ে করোনা সংক্রমণ তার প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে দেশে। দেশের প্রায় সব কয়টি রাজ্যে একপ্রকার মহামারী সন্ত্রাস জারী রেখেছিল করোনা সংক্রমণ। এত কিছুর পরেও চা বাগানে করোনা সংক্রমণের হার একেবারেই ছিল নিম্নমুখী। করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউ থেকেও চা বাগানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল বাগান কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ডিবিআইটিএ, আইটিপিএ, টাই প্রত্যেকটি চা সংগঠন। সকলকে জানাই স্যালুট।
ফেরার সময় দেখলাম চারটে হাতি নিয়ে গজলডোবায় পিলখানা চালু করার প্রস্তুতি চূড়ান্ত। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পিলখানা চালু করার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতির অপেক্ষায় রয়েছে রাজ্যের পর্যটন দপ্তর। পিলখানা ছাড়াও জলাভূমি এবং পরিযায়ী পাখিদের কথা মাথায় রেখে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানতে পারলাম। স্থানীয় মাঝিদের কাছ থেকে জানলাম এর মধ্যে গজলডোবায় লেজার শো চালু করার প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। পরিবর্তে নতুন করে পরিবেশ বান্ধব আলোর বন্দোবস্ত করা হবে। এর বাইরে গজলডোবায় মাইকের ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। ৩৭ একর জমির ওপর প্রস্তাবিত গলফ কোর্স এলাকায় আলাদা করে পাঁচ একর জমির ওপর বার্ড জোন তৈরি করা হবে। এছাড়াও ১১ একর জমির ওপর ইকো পার্ক, বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্য কিডস জোন, সান্ধ্য আমোদপ্র্মোদের জন্য অ্যাক্টিভিটি সেন্টার, ওয়াক ট্রেইল নির্মাণ এবং মাল্টিজিম চালুর সিদ্ধান্ত হতে চলেছে। অন্যদিকে পরিকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে ভোরের আলা প্রকল্পে বিনিয়াগকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে কলকাতা, মুম্বই ও দিল্লি শহরে বৈঠক করার প্রস্তুতি চলছে। ইতিমধ্যেই এখানে একটি স্টার ক্যাটিগরির হোটেল চালু করেছেন একজন বিনিয়োগকারী। পাশাপাশি ভোরের আলার পরিকাঠামোর মধ্যেই এখানে লগ হাট, কটেজ ও ভূ-ঘর তৈরির কাজও চলছে। এলাকায় নতুন করে থানা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির জন্য জায়গাও চিহ্নিত করা হয়েছে। শুনলাম গজলডোবায় সড়ক নির্মাণের জন্য যে ১৪ টি পরিবারকে অন্যত্র সরে যেতে হবে তার মধ্যে ৯টি পরিবার সরকারি ক্ষতিপূরণ নিয়ে ইতিমধ্যে সরে গিয়েছে। ৫টি পরিবার এখনও জমি খালি করেনি। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেবার চেষ্টা চলছে। সূর্যাস্তের মোহময়ী রূপমাধুরীর শোভা উপভোগ করে শীতের বাগিচা সফর শেষে এবার ঘরে ফেরার পালা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴