অন্তহীন আকাশের নীচে-/১১
অন্তহীন আকাশের নীচে
দেবপ্রিয়া সরকার
পর্ব ১১
--------------------------------
আজ চৈত্র সংক্রান্তি। সকাল থেকে প্রতিটা বাড়িতে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের তোড়জোড় চলছে।
ঊষারানীকে স্নান করানো, খাওয়ানো শেষ করে দুপুরবেলা বকুল বাড়ি এসেছে। আজ বাদে কাল ঊষারানীর
জন্মদিন। বাড়ি ভর্তি লোকজন। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। জয়শীলার কাছে একবেলার ছুটি চাইতেই সে
করুণ সুরে বলল, আর দু’তিনটে দিন একটু সামলে দে বকুল। দেখতেই তো পাচ্ছিস অবস্থা। আমি একা মানুষ
ক’দিক দেখবো বল?
অনেক কাকুতিমিনতি করে বকুল কয়েকঘন্টার ছুটি ম্যানেজ করেছে। আজকের দিনে বিশেষ কিছু নিরামিষ পদ সে
রান্না করে। তার মধ্যে অন্যতম হল আমডাল। সকালে বেশ কিছু রান্নাবান্না সেরে গেলেও ডালটা এখনও বাকি
আছে। ঘরে ঢুকেই দেখল পাখি হাতে একটা খোলা বই নিয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।
সে ব্যস্ত হয়ে বলল, পাখি মা চটপট যা তো গাছ থেকে দুটো কাঁচা আম পেড়ে নিয়ে আয়। আমি তাড়াতাড়ি ডালটা
বসিয়ে দিই। ওটা হয়ে গেলে খেতে দেব তোকে।
মায়ের হুকুম শুনে কোনও রকমে অনিচ্ছুক শরীরটাকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল পাখি। বাড়ির পাশের
আমগাছটা তার ঠাকুরদার লাগানো। প্রত্যেক বছরই প্রচুর ফল হয়। কিন্তু গিজেগিজে পোকার কারণে কেউ
খেতে পারে না। কাঁচা অবস্থায় কেটে চাটনি, আচার বানিয়ে নয়তো ডালে দিয়ে খাওয়া হয়। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে
একটার পর একটা আম লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ল সে। কিন্তু কোনওটাই সঠিক নিশানায় লাগল না। হতাশ হয়ে
মাটিতে বসে পড়ল পাখি। একটু দূরের পলাশ গাছটায় ঝেঁপে ফুল ফুটেছে এবারে। ওটার নীচু ডালে বসে একটা
কোকিল ডেকে চলেছে অনবরত। আগুন রঙে রেঙে ওঠা পলাশ গাছের দিকে চোখ চলে গেল পাখির। কালো কুচকুচে
কোকিলটার গলায় মনখারাপিয়া সুর শুনে তার ভীষণ কান্না পেল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল আচমকা।
কাল থেকে পাখির মনখারাপ। কফিশপে ইন্দ্রায়ুধ স্বয়ংদ্যুতির সঙ্গে অজস্র কথা বলল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
জিজ্ঞেস করল তার পরিবার, পড়াশোনা, ইউটিউব চ্যানেল, কেরিয়ার সম্পর্কে। অথচ পাখির সঙ্গে সামান্য
দু’একটা বাক্যবিনিময় ছাড়া কিছুই করল না। তার সমস্ত আকর্ষণ ছিল স্বয়ংদ্যুতিকে ঘিরে। পাখির সঙ্গে
ইন্দ্রায়ুধের জানাশোনা প্রায় তিন বছর ধরে। অপরদিকে স্বয়ংদ্যুতির সঙ্গে কালই তার প্রথম আলাপ! কোচিং
ক্লাসে ইন্দ্রায়ুধ সবসময় পাখিকে গুরুত্ব দেয়। আলাদা করে তাকে ডেকে নিয়ে কথা বলে। কিন্তু কাল পাখির
উপস্থিতিকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেল ইন্দ্রায়ুধ! বিষয়টা ভাবলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে আসছে
পাখির। নিজের অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা।
-কী হল রে? আম পাড়তে গিয়ে তুইও কি আম হয়ে গেলি নাকি?
ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা বকুলের চিৎকার কানে যেতেই চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল পাখি। বহু কষ্টে দু’খানা
আম পেড়ে ঘরে ফিরে গেল। অন্যদিন দুপুরে খাবার সময় বকুল বাড়িতে থাকে না। একলা ভাত বেড়ে পাখির খাবার
অভ্যেস বহুদিনের। কিন্তু আজ মা বাড়ি এসে পরিপাটি করে তার পছন্দের পদগুলো থালায় সাজিয়ে পরিবেশন
করলেও পাখির কিছুই খেতে মন চাইলনা। কোনও রকমে সামান্য নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ল তাড়াতাড়ি। বকুলের
বকুনিতেও কাজ হল না বিশেষ।
পাখির একেবারে ইচ্ছে করছে না আজকে আর কোচিংক্লাসে যেতে। ইন্দ্রায়ুধের কথা মনে পড়লেই বুকের
ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। মক টেস্ট দিতে যাবার জন্যে বকুল তাকে ঠেলেঠুলে তৈরি হতে পাঠাল ঠিকই কিন্তু
পাখির বিষণ্ণ চেহারা তার নজর এড়াল না। তার সামনে গিয়ে বকুল বলল, অন্য দিন তো লাফাতে লাফাতে
কোচিংয়ে যাস, হাজার বারণ করলেও শুনিস না। আজকে কী হয়েছে তোর? এরকম মুখ কালো করে ঘুরছিস কেন?
পাখি কয়েক মুহুর্ত মায়ের দিকে নীরবে চেয়ে থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মেয়ের হাবভাব আজকাল খুব একটা
সুবিধের ঠেকছে না বকুলের। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল পাখির চলে যাওয়া তারপর মন দিল নিজের
কাজে।
কোচিং সেন্টারে ঢুকতে গিয়ে একবার থমকাল পাখি। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ইন্দ্রায়ুধের গলা। পাখি
ভেবেছিল আজ হয়তো সে আসবে না, দেখা করতে যাবে টুপুরদির সঙ্গে। কিন্তু ইন্দ্রায়ুধ এসেছে দেখে স্বস্তি
পেল পাখি। ঘরে ঢুকে দেখল ইন্দ্রায়ুধ চেয়ারে বসে বাকি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মক টেস্ট নিয়ে কথা বলছে।
পাখিকে ঢুকতে দেখেই সে বলে উঠল, এই তো পাখি। এতো দেরি হল যে? আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা
করছিলাম। চলো চলো শিগগিরই বসে পড়ো, টেস্ট শুরু হবে এখুনি।
পাখি কয়েক মুহূর্তের জন্য চেয়ে থাকল ইন্দ্রায়ুধের দিকে। সমুদ্র-সবুজ রঙের শার্ট আর কালো ট্রাউজারে
অসম্ভব আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে তাকে। পাখি দ্রুত নিজের জায়গায় গিয়ে খাতা-কলম বের করে বসল। ইন্দ্রায়ুধ
একে একে প্রশ্নপত্র বিলি করে, জরুরি যা কিছু নির্দেশ সব দিয়ে পাখির সামনে এসে দাঁড়াল। পাখির
হৃৎপিণ্ডটা এতো দ্রুত লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে জোরে জোরে। একটা পুরনো বই তার
সামনে বাড়িয়ে দিয়ে ইন্দ্রায়ুধ বলল, তুমি সেদিন সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার নিয়ে কয়েকটা পয়েন্ট জানতে
চাইছিলে। এই বইটা নাও। এখানে সবকটা পয়েন্ট নিয়ে ডিটেইলসে আলোচনা করা আছে। কপি করে আমাকে বইটা
ফেরত দিয়ে দিও।
পাখি হাসিমুখে বইটা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। ইন্দ্রায়ুধ ফিরে যেতে গিয়েও কিছু একটা মনে পড়ায় হঠাৎই
দাঁড়িয়ে পড়ল। পাখির দিকে মুখ ফিরিয়ে আলতো হেসে বলল, এই বইটা অনেকদিনের পুরনো। আজকাল আউট অফ
মার্কেট। তাই যত্নে রেখো বইটাকে। অযথা রঙবেরঙের ছবি এঁকে নোংরা করো না, কেমন?
পাখি হতভম্বের মতো চেয়ে থাকল ইন্দ্রায়ুধের দিকে। কিছুদিন আগে ইন্দ্রায়ুধের দেওয়া নোটসের খাতার ফাঁকা
পৃষ্ঠায় একটা টকটকে লাল গোলাপ এঁকে দিয়েছিল পাখি। ভেবেছিল ইন্দ্রায়ুধের ভাল লাগবে। কিন্ত তার
প্রতিক্রিয়া শুনে আহত হল পাখি। তার চারপাশের পৃথিবীটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে একটু করে। যে সব ঘটনা
ঘটছে সেগুলোকে কোনওভাবেই সে মেনে নিতে পারছে না। পরীক্ষা শুরুর পাঁচ-দশ মিনিট পর সৌরিশ ঘরে ঢুকে
বলল, আরে ইন্দ্র তোর কোথায় যেন যাবার কথা ছিল না? চলে যা, আমি থাকছি এখানে।
পরীক্ষার ভার সৌরিশের হাতে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল ইন্দ্রায়ুধ। তার বাইকের শব্দ মেঘের গুম গুম ধ্বনির
মতো বেজে চলল পাখির কানে। হাতে ধরা প্রশ্নপত্রের কালো কালো অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে থাকল। বুকের
ভেতর জমাট বেঁধে থাকা কষ্টটা পাক খেতে থাকল সজোরে। বড় বড় জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামল পাখির গাল বেয়ে।
প্রশ্নপত্রের জায়গায় তার সামনে ভেসে উঠল ইন্দ্রায়ুধ আর স্বয়ংদ্যুতির হাসি মুখ। তার পায়ের নীচের মাটিটা
আচমকা দুলে উঠল। ঝাপসা হতে হতে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল অক্ষরগুলো। ঝুপ করে নিকষ কালো অন্ধকার
নেমে এল পাখির দু’চোখ জুড়ে। তার পাশে বসে একমনে প্রশ্নের উত্তর লিখছিল অর্পিতা। সে চমকে উঠে বলল,
পাখি! কী হল তোর? এই পাখি, কী হল? শরীর খারাপ লাগছে?
অর্পিতার আর্তনাদ শুনে ছুটে এল সৌরিশ। জল এনে ছিটিয়ে দিল পাখির চোখে মুখে। চেঁচামিচি শুনে অফিস ঘর
থেকে দৌড়ে এসেছে তপন আর ইকবালও। ছাত্রছাত্রীরা ভিড় জমিয়েছে পাখিকে ঘিরে। তার মাথা নিজের কোলে
তুলে নিয়ে ক্রমাগত খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস করছে অর্পিতা। পাখির নিস্তেজ শরীরটা এলিয়ে পড়ে আছে
কাঠের বেঞ্চে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴