এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী
এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা
গৌতম চক্রবর্তী
প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে উত্তরবঙ্গে, বিশেষত জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স এবং দার্জিলিং জেলার পার্বত্য অঞ্চল ও ম্যালেরিয়া প্রবণ অস্বাস্থ্যকর তরাই অঞ্চলে চা-বাগিচার সূত্রপাত হয় সাগরপার থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ চাকরদের দ্বারা। সকল শ্বেতাঙ্গ চা-কর, ম্যানেজাররাই যে আর্থিক লাভের জন্যে একের পর এক নানা চা-বাগান গড়ে তুলেছিলেন তা সত্য নয়। ডুয়ার্স ব্র্যাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন, বিন্নাগুড়ি বা পূর্বতন ডুয়ার্স প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের জলপাইগুড়ির নানা রিপোর্ট ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ চা-করদের সাথে বাগানের শ্রমিক কর্মচারীদের যে একটা পারস্পরিক মেলামেশার সম্পর্ক ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাছাড়াও স্বনামধন্য চাকর বীরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ রচিত ‘দি ডেভেলপমেন্ট অফ দি টি ইন্ডিয়া ইন জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্ট (১৮৬৯-১৯৪৭’, ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পঞ্চাশ এবং পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সংখ্যা, গোপালপুর টি কোম্পানির ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সংখ্যা, স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. রণজিৎ দাশগুপ্ত রচিত আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘ইকোনমিক, সোসাইটি, অ্যান্ড পলিটিক্স অফ এ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট; জলপাইগুড়ি ১৮৬৯-১৯৪৭’ গ্রন্থ, কোচবিহার আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, পরবর্তী জীবনে কলকাতার স্বনামধন্য প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক প্রয়াত ড. শিবশঙ্কর মুখার্জীর গবেষণাধর্মী কাজ ‘এমার্জেন্স অফ দি বেঙ্গলী এন্টারপ্রেনিওরশিপ ইন টি প্ল্যান্টেশনস ইন জলপাইগুড়ি ডুয়ার্স ১৮৭৯-১৯৩৩’ থেকে বেশকিছু তথ্যসূত্র সংগ্রহ করে আজকের লেখার অবতারনা। তবে খেলাধুলা বিষয়ক তথ্য সংগ্রহে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই গবেষক তথা অধ্যাপক সুপম বিশ্বাস এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আনন্দগোপাল ঘোষকে।
ইংরেজদের সঙ্গে বেশ কিছু পূর্ববঙ্গ বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী বাঙালিরাও চা-বাগান গড়ে তুলেছিলেন। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী, মোক্তার, জমিদার, কাঠ-ব্যাবসায়ী, শ্রমিক সরবরাহকারী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং চা-বাগানের কর্মচারী। পরিচালনাগত ফারাক বেশ বোঝা যেত বাঙালি মালিকানাধীন চা-বাগান এবং ইউরোপীয় চা-বাগানের মধ্যে। ব্রিটিশ শাসনাধীন যুগে ইউরোপীয় চা-করদের প্রচন্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও কীভাবে অভিবাসী বাঙালি উদ্যোগপতিরা একের পর এক বহু চা-বাগিচা গড়ে তুলেছিলেন সেই রোমহর্ষক কাহিনী অন্য সময় বলা যাবে। গ্রেট ব্রিটেনের শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় ছিলই। চা-বাগানে এবং আঞ্চলিক ব্যবসা কেন্দ্রে মাড়োয়ারি বানিয়াদের দাপট ছিল সবচেয়ে বেশি। আজও এই প্রভাব অক্ষুন্নই রয়েছে। কারণ বর্তমানে অধিকাংশ চা-বাগানের মালিকানাই রয়েছে পশ্চিম ভারত থেকে আগত এই বানিয়াদের হাতে। চা বলয়ে গুজরাটি ব্যবসায়ীও আছে। উত্তরবঙ্গে, বিশেষত জলপাইগুড়ি ডুয়ার্স, দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এবং তরাই এলাকায় প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে ব্যবসা, ঠিকাদারি বা বিভিন্ন কর্মসূত্রে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ থেকে নানান ভাষাভাষী মানুষ চা-বাগান অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে বিংশ শতাব্দীর চারের দশকে চা-বাগানগুলি ছিল যোগাযোগহীন জঙ্গলের মধ্যে এক-একটি ক্ষুদ্র জনপদের মতো। যাতায়াতের কোনও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা তখন ছিল না। বন্যপ্রাণীর দাপটে জীবন প্রতি মুহূর্তে বিপন্ন। অন্ধকার নির্জন বনপথে পায়ে হাঁটাই ছিল একমাত্র উপায়। উত্তরবঙ্গে চা-বাগান পত্তনের সূত্রে শ্রমিক ছাড়াও সমতল বঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে জীবিকার অন্বেষণে মাইনর পাশ বাঙালি মানুষেরা এসে ভিড় জমাত। এদের মধ্যে অনেকে ছিলেন তথাকথিত ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত। চা-বলয়ে এরা ‘বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাবু শব্দটি ছিল ইউরোপীয় সাহেবদের দেওয়া। বাগানবাবু, কেরানিবাবু, গুদামবাবু, ডাক্তারবাবু, রেশনবাবু, ফিটারবাবু, পাতিবাবু, ওজনবাবু, গানবাবু, মাস্টারবাবু, প্রভিডেন্টবাবু প্রভৃতি।
বাঙালি মালিকানাধীন চা-বাগানে ম্যানেজার পদে সাধারণত বাঙালিরাই নিযুক্ত হতেন। ডিরেক্টরদের কারও কোনও আত্মীয় বা পেয়ারের লোক না হলে দেশি বাগানের বাবুদের চাকরির উন্নতি বা অবনতি নির্ভর করত ম্যানেজারের ওপর। সাহেব বাগানে বড়বাবুর মতামতের উপর সবকিছু নির্ভর করত। কারণ বড়বাবু ছিলেন ম্যানেজারের খুবই কাছের লোক। অবাঞ্ছিত বাবুদের বেলায় ২৪ ঘন্টার নোটিশই যথেষ্ট ছিল। চা-বাগানের ক্লান্তিকর, একঘেয়ে জীবনযাত্রায় চা-বাগানের কর্মচারীরা বিনোদনের জন্য সবরকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। ফুটবল খেলা এবং নাট্যচর্চার মূল উদ্যোগ আসত বাগানের বাঙালিবাবুদের কাছ থেকেই। তবে বাঙালি মালিকানাধীন চা-বাগানে এই ক্ষেত্রে উদ্যোগ বা সহায়তা দুটোই আসত মূলত মালিকপক্ষের থেকে। প্রশ্ন হল, সাগরপার থেকে যে সকল শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসেছিলেন চা-বাগান পত্তনে তারা কেন তাদের বাগানে ব্যবসার পাশাপাশি এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছিলেন অথবা বাগিচার আমজনতার প্রিয় খেলা ফুটবল টুর্নামেন্টে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন? ডুয়ার্স-তরাইয়ের বিভিন্ন নামীদামি প্রাক্তন ফুটবল প্লেয়ারদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম ফুটবল খেলা প্রসঙ্গে ইংরেজ সাহেবদের বদান্যতার কথা। সরকারি নথিপত্র ঘাটতে গিয়ে জেনেছিলাম সাহেবরা প্রথমাবস্থায় ডুয়ার্স অঞ্চলের কোনও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই বলে উল্লেখ করেছিলেন। পরে এই প্রত্যন্ত অঞ্চল চা-চাষের উপযোগী বলে বিবেচিত হওয়ায় তারা এই অঞ্চলকে প্রাধান্য দেয়। এখানেও তাদের নিজ স্বার্থরক্ষার এবং সম্পদবৃদ্ধির মনোভাবই প্রকাশ পায়। কিন্তু ত্রিশ-চল্লিশ দশক থেকে তারা ব্যবসার পাশাপাশি কর্মচারীদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজনে পরিপূরক হয়ে দাঁড়াল। সাহেবরা যারা এদেশে এসেছিলেন লুঠতরাজ করতে, নিজেদের স্বার্থরক্ষা করতে, তারা কেন হঠাৎ সংস্কৃতিমুখী হয়ে পড়েছিলেন এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।
আসলে চা শিল্প গড়ে ওঠার সত্তর-আশি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির একটা মানসিক বোধ অত্যন্ত ধীরগতিতে দানা বেঁধে উঠছিল সেটা ইউরোপীয় চা-কররা বুঝতে পারছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক মহামন্দা বিভিন্ন ইংরেজ টি-কোম্পানির প্রশাসনিক ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিক্ষিপ্তভাবে হলেও কোথাও কোথাও শ্রমিক অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। এই সুযোগে চা-শিল্পের শ্রমিক কর্মচারীরা নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য বা সঙ্গত প্রতিবাদের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সুতরাং একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী চলা আর্থিক মহানন্দার চাপ, আর অন্যদিকে শ্রমিক অসন্তোষ বিভিন্ন সাহেব বাগানকে শ্রমিকদের মন জয় করবার জন্য কিছু একটা করতে তাড়িত করছিল যাতে করে প্রতিবাদী চেতনা গর্জে না ওঠে। তারই অঙ্গ হিসেবে নাট্যচর্চার পাশাপাশি ফুটবল খেলাকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। এর দ্বারা চা-বাগানে এক যথাযথ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠবে, শ্রমিক কর্মচারীরা বিনোদনে ডুবে থাকলে অন্যান্য প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে বিলম্ব হবে। তবে রাজনৈতিক কারণেই যে শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা তাদের বাগানে ফুটবল খেলাকে বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে দেখেছিলেন তা নয়। ইংরেজ চা-করদের মধ্যে অনেকেই শৈশবকালে নিজ দেশে নামী ফুটবলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে জীবিকার টানে পরিবার পরিজন ছেড়ে এই প্রত্যন্ত চা-বলয়ে পড়ে থাকলেও ফুটবলের প্রতি টান আগের মতোই বজায় ছিল। এই আবেগ থেকেই তাদের হাত ধরে শুরু হয় বিভিন্ন বাগানের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতা। ঔপনিবেশিক পর্বে বাগানের ডিরেক্টর, ম্যানেজার, কর্মচারীদের ফুটবল খেলার প্রতি যে টান ছিল, বর্তমান দিনের নিরিখে তা কখনও ভাবাই যায় না। কারণ বর্তমানে অবাঙ্গালি মালিকানায় চা-বাগানের এই সব প্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
খেলাধুলার মধ্যে ফুটবল খেলাই ছিল মুখ্য। খেলার দিন আশেপাশের চা-বাগানে ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার এবং বাগানের অন্যান্য কর্মচারী, অগণিত শ্রমিকের উপস্থিতিতে ফুটবল মাঠ সরগরম হয়ে উঠত। এই ধরনের খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সাহেবদের প্রধান সহযোগী ছিলেন বাগানের বিভিন্ন কর্মচারীরা, যাদের মধ্যে বাঙালিবাবুদের সংখ্যাই ছিল বেশী। এরা বাগানে আসার পূর্বেই ইউরোপীয় জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিতি ছিলেন। ফলে দ্রুত তারা ইংরেজ মালিকদের কাছে পরিচিত লোক হয়ে উঠেছিলেন। মালিক, ম্যানেজার ও শ্রমিকদের মাঝে ছিল এদের অবস্থান। মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতার জন্য এরা সাহেবদের কাছে পৌঁছতে না পারলেও শ্রমিকদের কাছে নিজেদের সাহেবের লোক বলে পরিচয় দিতেন। চা-শিল্প প্রতিষ্ঠা, তাকে ধরে রাখা ও লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করার পেছনে এই বাবু সম্প্রদায়ের অবদান ছিল অপরিসীম। বাগরাকোট বাগানের মি.ব্রাউন এবং সাইলি বাগানের মিঃ স্মিথ ছিলেন ভালো খেলোয়াড়। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট নিউ গ্লেঙ্কো চা-বাগানে ইউরোপীয় বনাম ভারতীয় একাদশের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলা হত। এই চা-বাগানেই বিখ্যাত ফুটবলার সামাদের পুত্র সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজে যোগ দেন। তিনি ভারতীয় বলে ইউরোপীয় দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ভারতীয় একাদশের হয়ে খেলেন। এরপর ইউরোপীয় ম্যানেজার একাদশের নাম পাল্টে রাখা হয় ‘প্ল্যান্টার্স ইলেভেন’। মেটেলি চা-বাগানে ইউরোপীয় ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজাররা সবাই খালি পায়ে ফুটবল খেলতেন। জয়ন্তী বাগানের মি. ব্রাউন, মি.ডবলু এবং সামসিং-এর মিঃ ওয়ার্ড, নাংডালা বাগানের ম্যানেজার এফ.এম.কার ফুটবল খেলায় যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। দলসিংপাড়া বাগান মাঠে অনুষ্ঠিত ফুটবল টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে প্রতি স্বাধীনতা দিবসের দিন দর্শকদের মনে প্রবল আনন্দ উন্মাদনার সৃষ্টি হত।
এই সমস্ত ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ চলাকালীন মাঠে উপস্থিত থাকতেন বিভিন্ন বাগানের ইউরোপীয়ান ম্যানেজার, চা-সংস্থার সচিব এবং উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক, প্রশাসনিক কর্তারা। কোনও কোনও ম্যাচে আবার মেমসাহেবও উপস্থিত থাকতেন। গোল করতে পারলেই মেম সাহেবের কাছ থেকে প্রশংসা ও উপহার পাওয়া যেত। ১৯২৭ সালে ইংরেজ ও ভারতীয় কর্মচারীদের যৌথ প্রচেষ্টায় শুরু হয় ডি বক্সা ডুয়ার্স ফুটবল টুর্নামেন্ট। তৎকালীন সুপারিনটেন্ডন্ট মি. এরাকার সুদূর ইংলন্ড থেকে রৌপ্যনির্মিত এই শিল্ড নিয়ে আসতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৬৩ সাল থেকে আবার পুনরায় শুরু হয়। বর্তমানে এই প্রতিযোগিতার আর কোনও অস্তিত্বই নেই। এই প্রতিযোগিতায় কালচিনি চা-বাগান মোট চারবার (১৯৬৩-৬৬) চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে চিনচুলা চা-বাগান চ্যাম্পিয়ান হয়। রায়ডাক বাগানের ইংরেজ ম্যানেজার মি.ম্যাকেল তার মেয়ে জানেটের নামে শুরু করেছিলেন এক ফুটবল প্রতিযোগিতা। এই বাগানের অপর ম্যানেজার মি. স্পোয়াস্কি ভালো খেলতেন। জলপাইগুড়ি শহরে ইংরেজ চা-কর সাহেবদের পৃষ্ঠপোষকতাতে গড়ে উঠল ভিক্টোরিয়া ক্লাব, স্টার ক্লাব, ডায়মন্ড জুবিলি ক্লাব। শ্বেতাঙ্গ চা-কর ও পুলিশদের মধ্যে প্রায়ই ফুটবল খেলা হত। ডায়মন্ড জুবিলি ক্লাব ও স্টার ক্লাবের মধ্যে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা চলত। বুট পায়ে সাহেবের দল আর খালি পায়ে ভারতীয় দলের খেলা ছিল এক বাৎসরিক উদ্দীপনার উৎসব। শহরে সাহেবদের দেখে প্রথম বুট পায়ে খেলা শুরু করেন সুরেন চন্দ। সেকালের নামকরা সেন্টার ফরওয়ার্ড। জলপাইগুড়ি শহর প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অনেক বছর কোনও খেলাধূলার চর্চা ছিল না।
তরাই এবং ডুয়ার্সের চা বাগিচাতে সেই সময়ে বাগানে বাগানে আন্তঃ ফুটবল প্রতিযোগিতা ছিল এক এক ঈর্ষনীয় ব্যাপার। প্রতিযোগিতায় বাগান হিসেবে সেরা দল চ্যাম্পিয়ান হওয়ার জন্য সংলগ্ন শহর থেকে নামী দামী ফুটবল খেলোয়াড় নিয়ে আসা হতো। ভালো খেলা দেখাতে পারলেই বাগানে চাকরি নিশ্চিত ছিল। যে বাগানের যেদিন খেলা থাকতো, সেদিন অর্ধদিবস বাগান বন্ধ থাকতো। বাগানের সকলে মিলে চাঁদা তুলে ট্রাকে করে যেতেন খেলা দেখতে। মাঠে অবশ্য মালিকরা যেতেন তাদের নিজস্ব বিলাসবহুল গাড়িতে চেপে। প্রতিযোগিতায় যে বাগান জয়ী হতো সেদিন থেকে তার পরের কয়েকদিন সেই বাগানে চলতো উৎসব। শহর থেকে আসতো দামি ফল, হরেক রকমের মিষ্টি, আর বাগানের পুকুর থেকে তোলা হতো বড় বড় রুই, কাতল। আশেপাশের বাগানের সম্ভ্রান্ত বাঙালিবাবু ও মালিকপক্ষ নিমন্ত্রিত থাকতেন। তবে স্বভাবতই বাগানের শ্রমিকরা এইসব আনন্দ উৎসব থেকে দূরে থাকতেন। ঔপনিবেশিক পর্বে, বিশেষত বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে তরাই-ডুয়ার্সের ইউরোপীয় এবং বাঙালি পরাধীন চা-বাগানগুলির মধ্যে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে এক সৌহার্দের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল যাতে অংশ নিতে দেখা যেত বাগানের ম্যানেজার, শ্রমিক কর্মচারী থেকে শুরু করে শ্বেতাঙ্গ সাহেবদেরও। বিশেষ করে কলকাতার কত খেলোয়াড় বাগানে চাকরি নিয়ে এই প্রান্তীয় জনপদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে পড়েছিল একটু খোঁজ করলেই সে সব বিবরণ পাওয়া যায়। বাঙালি ও ইউরোপীয় চা-করদের উন্নত ফুটবলারদের নিজ বাগান দলে নিয়োগ করার পদ্ধতি যে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এক বিরাট সুযোগ তৈরি করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পরিস্থিতি আজও থাকলে বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলে ভালো জাতের ফুটবল খেলোয়াড়েরা যে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই দুর্দিন তাদের দেখতে হত না।
তথ্যসূত্র :
১. তুষারকান্তি বসু : চা বাগানের সাগরপারের সাহেবরা, উত্তরস্বর, বাংলা পত্রিকা পৃ ১১ ২) Dooars Planters Association (D.P.A) Report, 1928, p.36 ৩) সমীর চক্রবর্তী: চা-বলয়ের সংস্কৃতি, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ.৩, ৫ ৪) সুপম বিশ্বাস : চা বাগানের বাঙালি বাবুদের সাংস্কৃতিক জীবন - সেকাল একাল, পার্বত্য উত্তরবঙ্গ : প্রসঙ্গ দার্জিলিং নামা ১, এন.এল.প্রকাশনী, শিলিগুড়ি, পৃ ১০৩ ৫) অনিল গাঙ্গুলি : ডুয়ার্স প্রাঙ্গণে, গ্রন্থতীর্থ প্রকাশনী, পৃ ৪৬ ৬) Sir P.J. Griffiths: History of the Tea Industry in India -Weidenfeld and Nicolson, P. 647 ৭) শীলা বসু : আমার শিলিগুড়ি, উত্তরবঙ্গ উৎসব স্মরণিকা, ২০১২ ৮) অর্ণব সেন: চায়ের দেশে বিদেশী সাহেব বিবি, আরণ্যক, ২০১২, সম্পাদনা পরিমল দে, পৃ ৯ ৯) মানস দাশগুপ্ত: উত্তরবঙ্গে চা শিল্পে বর্তমান সমস্যা, বইওয়ালা প্রকাশনী, পৃ.৭৯ ১০) কামাক্ষ্যা প্রসাদ চক্রবর্তী : সেকালের জলপাইগুড়ি শহর এবং আমার জীবনের কিছু কথা, সিগমা ইনফর্মেশন টেকনোলজি প্রকাশনী, জলপাইগুড়ি, পৃ ৩৬ ১১) সৌমেন নাগ: কাঞ্চনজঙ্ঘায় অশান্তির আগুন, পি.ডি.এস. প্রকাশনী, ১২) ডামডিম চা-বাগানের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴