আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
১৮৭৬-৭৭ সালে বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে চা-বাগান পত্তনের জন্য ২২টি এলাকা লীজ দেওয়া হয়েছিল চা-করদের। জলপাইগুড়ি জেলার প্রথম চা-বাগানটির পত্তন হয় সদর মহকুমার গজলডোবাতে ১৮৭৬ সালে। সেই যুগে চা-চাষের সূত্রেই শ্রমিক আমদানি করতে হয়েছিল বাইরে থেকে। বন কেটে গড়তে হয়েছিল বসত। ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল নতুন মাটিতে দেশান্তরিত মানুষদের নতুন সমাজ। তবে বৃটিশ অধিকারের আগে থেকেই এখানে সংকর বাঙালী মঙ্গোল নরগোষ্ঠীর কোচ, মেচ, রাভা, গারো, টোটো, ধীমাল, থারু, ভুটিয়া, নেপালী, লেপচা এবং অন্যান্য জনজাতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল। এই তিন বছরে চষে ফেলেছি পাহাড় তরাই এবং ডুয়ার্সের চা বাগিচা। দেখেছি বর্তমানে পাহাড় অঞ্চলের চা-বাগানগুলিতে নেপালী শ্রমিকদেরই প্রাধান্য। নেপালী’ শব্দটি এখানে ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত। নেপালীদের মধ্যে লেপচা, লিম্বু, মগর, তামাং প্রভৃতি জনজাতির মানুষও রয়েছে। লক্ষ্য করেছি এদের মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরাই সংখ্যায় বেশী। সামান্য সংখ্যক খৃষ্টানও আছে। মদেশ’ শব্দটির অর্থ সমতল। মনে হয় মধ্যদেশ থেকেই ‘মদেশিয়া’ কথাটার উৎপত্তি। নেপালী ও পাহাড়িয়া চা-শ্রমিকরা ছোটনাগপুর থেকে আসা কৃষ্ণবর্ণ শ্রমিকদের মদেশিয়া নামে অভিহিত করে থাকেন। সমতলের চা-বাগানগুলিতে নেপালী ও পাহাড়িয়া শ্রমিকের পাশাপাশি আদি দক্ষিণ নরগোষ্ঠীর ওঁরাও, মুণ্ডা, সারিয়া, নাগেশিয়া, সাঁওতাল, অসুর প্রভৃতি পঞ্চাশটিরও বেশী কৌমের মানুষ বংশ পরম্পরায় চা-শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত। কোন কোন চা বাগানে সামান্য সংখ্যায় ভাটিয়া বাঙালী, রাজবংশী বাঙালী ও দাক্ষিণাত্য থেকে আসা পুরুষানুক্রমে কর্মরত চা-শ্রমিক দেখা যায়। তবে ভূমিপুত্রদের আর চোখে পড়ে না। সমাজতাত্ত্বিক বিচারে এদের একাংশ নিজেদের কৌম চরিত্র বিসর্জন দেননি। সেজন্য জনজাতি বা ট্রাইব হিসেবে তপশীলভুক্ত অপরাংশ যারা পূর্ণ জাতি সত্ত্বা ও পূর্ব সংস্কার বিসর্জন দিয়ে হিন্দু সমাজের সঙ্গে মিশে গেছেন তারা কাস্ট বা জাতি হিসেবে তপশীলভুক্ত। যারা ধর্মে খৃষ্টান বা মুসলমান তারা তপশীলভুক্ত নন। ধর্মবিশ্বাস যাই থাকুক না কেন, এরা মূলত সর্বপ্রাণতাবাদী।
চা-বাগানের মানুষজন স্বাধীনতার পূর্ববর্তীকালে ইতস্ততভাবে আধুনিক নাগরিক সমাজের সংস্পর্শে আসে। দেশ স্বাধীনতা লাভের পর তারা গ্রামোন্নয়নের সুফল পেতে শুরু করে। চা-বাগান থেকে যে সাহিত্যিকরা উঠে আসেন তারা শুরু করেন সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে সাহিত্যচর্চা। এই রচনায় পাণ্ডিত সাহিত্যিক উপাদান যত না আছে, তার থেকে বেশি করে আছে তথ্যগত ও চিন্তাগত উপাদান। ঔপনিবেশিক শাসকদের আমলে অত্যাচার ও শোষণের কথা আছে। শ্বেতাঙ্গদের ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রতিশোধের বাসনা, রাজনৈতিক নেতাদের ভণ্ডামির মুখোশ, চা-বাগানের মানুষের দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সুখ, দুঃখ, মদ্যপান, অবৈধ সম্পর্ক, ঘর ভাঙার ইতিহাস—সবই প্রতিফলিত হয়েছে। ছোটগল্পে ধরা পড়েছে চা-বাগানের মানুষের খাদ্যাভ্যাস—চিড়ে ভাজা, মুড়িভাজা, চালভাজা, কচুশাক, জঙ্গলের আলু, মাছ, ভাত, মাংস এবং অবশ্যই হাঁড়িয়া। এই হাঁড়িয়া তাদের ঘরে তৈরি মদ এবং পরম্পরাগত পানীয়। চা-বাগানের মানুষের ঐতিহ্যগত কুটীরশিল্প ও হাতের কাজকে তুলে ধরেছে। চা-বাগানের মানুষের জীবনে উৎসবের ভূমিকা বিরাট। করম পুজো, হোলি, দুর্গাপূজা প্রভৃতি উৎসবে তারা আনন্দে মাতেন। করমপুজো ভাদ্র মাসের উৎসব। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা করম গানের একটা উদাহরণ—
তেলি ঘরে তেলি / দিয়া ঘরে বাতি / হামার শ্বশুর জাওলি / চরণ শোল ও শাকি ধনি ধনি
বিবাহিতা মেয়েদের জীবনে এই করম পূজার চিন্তা আনে পুরনো দিনের স্মৃতি, তারা মনে করে বাপের বাড়ির ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। তারা ভালোবাসে নিজেদের ফুল দিয়ে সাজাতে। করম পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঝিঙে ফুল এবং এই নিয়ে আছে গান—
ঝিঙ্গা ফুল সারি সারি/ গাঁথিছে বনমালি / বধু তু কাহার বাড়ি/ আশবিস তুই আমার বাড়ি। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার দিন চা-বাগানের মানুষ হোলির আনন্দে রং খেলায় অংশ নেয়, গান গায়, নাচে। নিজেদের মধ্যে একতা প্রদর্শনের জন্য কোথাও কোথাও কাঠিনাচ’ অনুষ্ঠিত হয়। সংগৃহীত এইরকম একটি লোকগান “নাচো রে অঞ্জনা / নাচো রে কল্পনা / হাথে তে লাঙি বাজে/ পায়ে তে নূপুর বাজে/ মাথে তে ময়ুরোপঙ্খী / গলে বনো মালা।
লোকগান চা-বাগানের মানুষের জীবনচর্যার প্রতিফলন। চা-পাতা তোলার কঠিন পরিশ্রমসাধ্য কাজটি করেন মহিলারা। তাদের হাতের নৈপুণ্য ও আঙুলের দ্রুততা অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ চা-পাতা তোলার কাজটির সহায়ক। ব্রিটিশদের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়েছিলেন চা বাগানের মহিলারা। এর সঙ্গে ছিল অল্প মজুরীর বিনিময়ে কঠোর পরিশ্রম ও সামাজিক বঞ্চনার ইতিহাস। ব্রিটিশদের এই অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা ধরা আছে চা-বাগানের লোকগানে ও সাহিত্যে। বস্তুত চা-বাগানের মানুষের সমাজ-সংস্কৃতির খোঁজ পেতে হলে মন দিয়ে অনুধাবন করতে হবে এই লোকগানগুলিকে। তে-ভাগা আন্দোলনের তীব্রতা প্রতিদিন যখন বাড়তে থাকে সেই সময়কার অবসম্বাদিত নেতা লাল শুকরা ওরাওঁকে নানা কৌশলে বারবার গ্রেপ্তার করা হত, সেপাই দিয়ে তাকে ভীতি প্রদর্শন করা, এমনকি মারধর করাও হত। তার জেলখানা যাওয়া তো ছিল নিজের বাড়ির মত যাতায়াত। তাই লাল শুকরা ওরাওঁ আক্ষেপ করে গান করতেন, “মালবাজার আনা যানা / মেটেলী থানা / থানা ভিতরে খালি ঘোড়া দানা / হায়-রে খালি ঘোড়া দানা (মালবাজার আসা-যাওয়া, মেটেলী থানা, থানার ভিতরে ছোলা চানা) (তথ্য সংগ্রহ - উত্তরবঙ্গের আদিবাসী চা শ্রমিকের সমাজ ও সংস্কৃতি - নির্বাণ বসু, ‘ডুয়ার্সের চা বাগানে শ্রমিক আন্দোলনের উন্মেষপর্ব, কিরাতভূমি, জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা, ২য় খণ্ড)। এই হৃদয়গ্রাহী লোকগানের মাধ্যমটিতে চা-বাগানের মানুষের উৎসব-অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্ম, সুখ, দুঃখ, বেদনা, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবন সব কিছুই প্রতিফলিত হয়েছে। বস্তুত তাদের জীবনের সঙ্গে এই গান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর এরই সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে নাচের কথাও। নাচ চা-বাগানের মানুষের জীবনের অঙ্গ, তাদের সংস্কৃতির পরিচায়ক। চা-বাগানের মানুষদের লোকগান তাদের চিরায়ত ঐতিহ্য, প্রথা, দেশাচার, লোকাচার, সামাজিক জীবন ইত্যাদির কথাই বলে। আর বলে জীবনযুদ্ধের গল্প, মনের গভীরে সুপ্ত বাসনার কথা। এই মানুষগুলো অবহেলা, বঞ্চনা ও অসাম্যের শিকার হয়েছে, চরম দারিদ্র্যকে নিত্যসঙ্গী করেছে, কিন্তু তাদের সহজাত সারল্য হারায়নি। সুখ-দুঃখের বারোমাস্যা তাদের গানে ফুটে উঠেছে।
চা-বাগানের মানুষের জীবন কখনোই তার পারিপার্শ্বিক ও প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে নয়। ছেলের বাড়ি ও মেয়ের বাড়ির মধ্যে বিয়ের আগে নতুন সামাজিক সম্বন্ধ হয়েছে। একটি বাড়ির লোক অন্য বাড়ির লোককে নিয়ে হাসি-মস্করা করছে। মেয়ের বাড়ির লোকেরা বলছে যে ছেলের বাড়ির লোক তাদের বাড়ি এসেছে পেটপুরে খাওয়ার লোভে। শাশুড়ি উঠেছিল কদম গাছে, পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙেছে। মেয়েকে বলা হচ্ছে ভাঙা হাড়ে সেলাই করে জুড়ে দেওয়ার জন্য
বুখাত দুখাল আইলে সামধী/ চাপলে ডুমুর গাছে হো/ ডুমুর গাছে লে গিরলে সামধী/ আখি-ও ফুটল/ কান-ও ফুটল।
টুটল তো দোলো হাধ হে! আনো ভাই সুই সুতা/ সিয়া সামধী কো দোলো হাধ হো৷ এটা চা-বাগানের মানুষদের ব্যবহৃত ‘সাদরী’ ভাষায় লেখা একটা গান। বিবাহ জীবনের একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। চা-বাগানের মানুষের বিয়ের গান খুব আকর্ষণীয়। এদের বিয়ের নানারকম গান প্রচলিত আছে। বিয়ের পরে মেয়ে যখন বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যায় তখন একটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রাণের কন্যা যাচ্ছে পরের ঘরে, কবে আসবে বাপের বাড়ি বলা যায় না। সেই আবেগ ধরা আছে চা-বাগানের লোকগানে—
দেশছাড়ে রে সুগা/ বিদেশ গেলি / জনমে জনমে/ মা বাপ কে কাঁদাইলি মৃত্যুজনিত শোকের গানের একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। পূর্বপুরুষদের আত্মা ও বার্তা বাহকদের উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে গ্রামপ্রধান ও পুরোহিতকে মৃত্যুর খবর জানানোর জন্য
দুসে দুসে লয়ে আইপে/ কোরাখোন উদুংকেটা/ তালা কুলিরে দোহাকেরা এই/ হাইরে! হাইরে! বাবা বাছারে/ উদুং চালাওনাই।
দুসে দুসে মানে গ্রামবাসী। এই গানের অর্থ হচ্ছে—মানুষকে জানাও এবং দশজনের দল নিয়ে আসতে বল। মৃতদেহ খাটের ওপর রাখা এবং তিনরাস্তার সংযোগস্থলে দেহটি রাখো। আমাদের বাঁচাও, সাহায্য করো। আমরা জানি না সে কখন মারা গেছে। আর একটা গানে বলা হচ্ছে,
কায় কাটিলো ঝাড়ের বাঁশ/ কায় পাকাইলো দড়ি/ চারজনেতে কান্দে লইয়া/ বলছে হরি হরি
অর্থাৎ একজন গ্রামবাসীর মৃত্যুর পর তারা জড়ো হয়ে বাঁশ কেটে চারপাই তৈরি করে মৃতদেহের জন্যে, দড়ি এনে শবটিকে বাঁধে, তারপর চারজন লোক হরি হরি বলতে বলতে দাহ করতে নিয়ে যায়। এই গানে তাদের সামাজিক প্রথার সঙ্গে সঙ্গে একতাও ফুটে উঠেছে।
চা বাগিচাতে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত চা-শ্রমিকের মধ্যে মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, ইন্দ্রজাল, মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাক, জরিবুটি, ভুতপ্রেতে বিশ্বাস, জন্মঘটিত সংস্কার, বিবাহ, পারলৌকিক ক্রিয়া, চাষবাস, অসুখ-বিসুখ ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই মন্ত্র ও জাদুশক্তির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বিবাহের রীতি নীতি ও স্ত্রী-আচার এর সাদৃশ্য, অন্ত্যেষ্টি পর্বে সংকেতধর্মী ক্রিয়াকলাপ ও প্রতীকধর্মী উপকরণ ব্যবহার, ভাত ও ভাত পচাই মদে আসক্তি, ক্ষেত্র বিশেষে রক্ষনশীলতা, সরল স্বভাব প্রায় প্রতিটি আদিবাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পরিশ্রমী ও উদ্যমী নারী এবং অপেক্ষাকৃত আয়েসী পুরুষ, নারীর অধিকতর স্বাধীনতা ও মর্যাদা, নাচ গানের স্বাভাবিক প্রবনতা ও নারীপুরুষের একত্রে যৌথ নৃত্যগীতে অংশ গ্রহণ, অল্পে সন্তষ্টি, পরিবার প্রথার অনুসরণ, জাতপাত, ছোটোবড়োর বিচার, ব্যক্তির দায়কে সামাজিক দায় হিসাবে বরণ করার মানসিকতা, বিবাহ সংক্রান্ত ও যৌন বিধি নিষেধ ইত্যাদি প্রায় সব আদিবাসী সমাজের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ধর্ম বিষয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ও অ্যানিমিষ্টদের কোন গোড়ামি নেই। ধর্ম বিদ্বেষ নেই। সমাজতাত্ত্বিক বিচারে জনজাতি বা ট্রাইবদের একাংশ নিজেদের কৌম চরিত্র বিসর্জন দেয়নি। সেজন্য জনজাতি বা ট্রাইব হিসেবে তপশীলভুক্ত অপর অংশ যারা পূর্ণ জাতিসত্তা ও পূর্ব সংস্কার বিসর্জন দিয়ে হিন্দু সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে তারা কাস্ট বা জাতি হিসেবে তপশীলভুক্ত। যারা ধর্মে খৃষ্টান বা মুসলমান তারা তপশীলভুক্ত নন। ধর্মবিশ্বাস যাই থাকুক না কেন, এরা মূলত সর্বপ্রাণতাবাদী। এরা আর্যভাষা, অস্ট্রিক গোষ্ঠির মুণ্ডারি শাখার ভাষা সমূহ ও দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠির কুরুখ ভাষা ব্যাবহার করে। যেসব কৌম নিজস্ব গোষ্ঠির ভাষা পরিত্যাগ করেছে সাদরী তাদের কাছে মাতৃভাষা। যাদের নিজস্ব গোষ্ঠির ভাষা বজায় আছে, সাদরী তাদের কাছে দ্বিতীয় মাতৃভাষা। আচরণতত্বের বিচারে এদের মধ্যে কৌম-চেতনা, কৌম স্বভাব ও কৌম-সংস্কার প্রবলভাবে বিদ্যমান। কৃষি ও অরণ্যের আকর্ষণ এদের রক্তের গভীরে। দেশান্তরিত হওয়ার প্রবণতা স্বভাবজ নয়। জীবিকা ও নতুন জীবিকা অন্বেষণের বাধ্যতামূলক তাগিদে নেপালীদের মতোই এরাও দেশান্তরিত হয়েছেন।
চা-বাগানে একটা সামাজিক স্তরবিন্যাস আছে। সবচেয়ে ওপরের ধাপে আছে বাগানের মালিক, তার নীচে সাহেব অর্থাৎ বিভিন্ন স্তরের ম্যানেজারবৃন্দ। তার তলায় বাবু (কেরানিকুল), তারপর সর্দার (তদারককারী), এবং সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করছে শ্রমিক। এই স্তরবিন্যাস সাহিত্যের পাতায় পাতায় বারবার চলে এসেছে। গল্প-উপন্যাস-কবিতায় চা-বাগানের সাহিত্যিকরা ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতি, দলাদলি ও ক্ষমতা দখলের কথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বলেছেন। বিদেশী সাদা-চামড়ার সাহেবদের অত্যাচার ও পীড়নের কথা যেমন আছে, তার পাশাপাশি আছে তথাকথিত দেশীয় বাদামি সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনী। সকলেই যে যার মতো করে মুনাফা লুটেছে আর শ্রমিকরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। এ এক নিরন্তর বঞ্চনা ও শোষণের ইতিহাসের গল্প। আসলে চা-বাগানের মানুষের লোকগান ও সাহিত্য-সংস্কৃতি উঠে এসেছে তাদের জীবন থেকে। এতে কৃত্তিমতা নেই, আছে তাদের জীবনযাত্রার সত্য প্রতিফলন। এই সহজ, স্বাভাবিক বর্ণনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় চা-বাগানের মানুষদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিশেষ চর্চা প্রয়োজন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴