স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/দশম পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
আমাদের চোখের সামনে বড় দ্রুত পাল্টে গেল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় জনজীবন, বিশেষ করে শিবমন্দির এলাকা ।বদলে গেল বৈরাতিশালের ঘনসবুজ। ১৮৯১ সালে ইংরেজরা জমি জরিপের কাজ শুরু করে এ অঞ্চলে। এই সময়ে এখানকার যেখানে শিলিগুড়ির শক্তিগড় কলোনি, তার দক্ষিণে জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জ। সেই রাজগঞ্জ থানার অধীনে শিলিগুড়ি ছিল একটি গন্ডগ্রাম। আর দার্জিলিং জেলার সমতলের প্রধান সদর ছিল ফাঁসিদেওয়া বন্দর। সরকারি কাজকর্ম পরিচালিত হত হাঁসখোওয়া বাগান অঞ্চলে। এইটি ছিল তরাই অঞ্চলের মহকুমা। বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ বৈরাতিশালে ছিল বড় বড় গাছ জঙ্গল-জলা।বাগডোগরা ছিল বাঘের অঞ্চল। হাতিঘিসা হাতিদের আনাগোনার স্থান। খড়িবাড়িতে ধান চাষ হত প্রচুর, সেই ধান কেটে নেয়ার পর বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে থাকত খড়ের স্তুপ। সেই থেকেই হয়তো খড়িবাড়ি। ম্যালেরিয়া কালাজ্বরে মৃতদের শব মাটি চাপা দেয়া হত মাটিগাড়ায়। সুদূর অতীতে ফাঁসিদেওয়া ছিল সিকিমরাজের বধ্যভূমি। বিদ্রোহীদের ফাঁসি দেওয়ার স্থান। কত মিথ যে আছে, এই সব জায়গাকে নিয়ে।
১৯৬২-র পর পুরো এলাকাটাই বদলে গেল।এই বদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কি ভূমিকা? কী নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল? তা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। তবে সব বদলই যে সোজা একমুখী হয়েছে তা হয়তো নয়। সেসব ইতিবাচক বা নেতিবাচক তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। সেই তর্কে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষদের জীবনে কত হেরফের ঘটেছে তা নিয়ে কিছু কথা বলা যেতেই পারে। তবে বলে রাখি, কোনো ছক ভিত্তিক পরিসংখ্যান যুক্ত করে এই বিবর্তনের স্মৃতিকথায় কোনো দেশী বিদেশী গবেষকদের কোন থিওরির উদ্ধৃতি দিয়ে কথা রচনা করবার ক্ষমতা আমার নেই। কিভাবে সব বদলে যাচ্ছে সেই উপলব্ধিকে কেন্দ্র করেই কিছু কিছু ছবি তুলে ধরছি মাত্র।
শিব মন্দির এলাকার পুরনো চেহারা আর নেই। ফ্লাইওভার, রাস্তাঘাট-দোকান-বাজারের চেহারা সব বদলে গেছে। ওই শিবমন্দির বাজারে রাহুতবাবু আর বৈষ্ণববাবুদের দোকান ছিল। তার পাশেই ছিল একঘর কাবুলিওয়ালাদের বাস, সুদের ব্যবসা করত।এদের ফাঁদে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল অধ্যাপক আধিকারিকরা আর্থিক দিক থেকে সংগতিসম্পন্ন থাকাতে, কম মাইনের শিক্ষা কর্মীরাই কাবুলিওয়ালাদের খপ্পরে পড়ত
বেশি। মাইনে হবার দিন গেটের সামনে অপেক্ষা করত। এ গল্প আমাকে শুনিয়েছিল গ্রন্থ ভবনের রসিকদা, যিনি প্রথম উপাচার্যের পাচক ছিলেন, পরে গ্রন্থ ভবনের কর্মী। আদি নাম ছিল রসিকলাল বৈতরণী, পরে বৈতরণী পদবী বদলে দাস পদবী গ্রহণ করলেন। ছবি লেখার মতো তাকে তৎকালীন গ্রন্থাগারের আধিকারিকরা রসিকলাল দাস এই নামটুকু সই করতে শিখিয়েছিলেন! চা করা আর ফাইল এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে নিয়ে যাওয়া, এইটুকুই করতে পারতেন। খুব ভালো রান্না করতে পারতেন আর পুরনো দিনের গল্প শুনতে চাইলে খুব আনন্দ পেতেন। এই রসিকলাল দাস আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পুরনো গল্প শুনিয়েছিলেন ।
যাক ওই কাবুলিওয়ালাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-আধিকারিক-শিক্ষাকর্মী সকলের চেষ্টায় গড়ে উঠেছিল Co-operative Credit Society, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্তরের থেকেই নির্বাচিত প্রতিনিধি আসতেন এই ঋণদান সমিতি পরিচালন মন্ডলীতে। 'সমানী মন্ত্র' সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সমিতিতে। কত সমস্যার সমাধান হয়েছে এই সমিতির ঋণ দানে, বিয়ে- অন্নপ্রাশন- শ্রাদ্ধ-চিকিৎসা-গৃহনির্মাণ এরকম বহু প্রয়োজনে ঋণদান সমিতি ছিল একমাত্র ভরসা। তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীদের ব্যাংক বীমা কোম্পানিগুলো তেমন আগ্রহী হতেন না ঋণ দিতে। আজ এই ঋণদান সমিতি অত্যন্ত গর্ব করার মতো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।লক্ষীর ভান্ডার পরিপূর্ণ হয়েছে। অফিস হয়েছে। সুদৃশ্য লোগো যুক্ত সাইনবোর্ড। মনে পড়ে এই ঋণদান সমিতির লোগো এঁকেছিলেন কন্ট্রোলার ব্রাঞ্চের ভূপেশ বাগচি-দা।
প্রতিবছর আ্যনুয়াল মিটিংএর দিনটিকে মনে হত উৎসবের দিন। এখন এই সমিতি থেকে সদস্যদের সন্তানদের উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য পুরস্কার দেয়া হয়। অবসর নেবার সময় দেয়া হয় বিদায় সম্বর্ধনা। অনেক সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত এই ঋণদান সমিতি। আজ আর সেই কাবুলীওয়ালাদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয় না। এটা একটা বড় পরিবর্তন বৈকি ।
ক্যাম্পাসের মধ্যে কত কিছু নতুন হল আবার হারিয়ে গেল অনেক কিছু, কনজ্যুমার কোঅপারেটিভএর দোকান, কলাভবনে ছিল। মনিহারি দ্রব্য থেকে কেরোসিন তেল সবই পাওয়া যেত। কলা ভবনের সামনের ব্যাংকটিও স্থানান্তরিত হয়েছে।পোস্টমাস্টারকে থাকতে দেবার ঘরটিও
আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ, শিক্ষক ছাত্র ও গবেষক সব মিলিয়ে নিজস্ব গতিতেই চলছে। তবুও সন্ধানী দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলে আসা পুরনো দিনগুলিকে নতুন করে দেখা ।
এই নতুন-পুরানো, ভাঙা-গড়াকে উপলক্ষ করেই হয়তো অধ্যাপক মানস দাশগুপ্ত লিখেছিলেন - "The University experimented with many new things and remain always a symbol of 'creative construction and destruction'."
সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক নতুন অধ্যাপক যেমন যোগদান করেছিলেন, আবার অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন অনেকেই।এই হঠাৎ করে চলে যাওয়াতে ছাত্র-ছাত্রীরা খুব সমস্যায় পড়তেন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিল ত্রিস্তর বিভাজন,লেকচারার-রীডার-প্রফেসর। এই বিভাজনে নানা স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটত অধ্যাপক সমাজে। পদোন্নতির জন্য সিলেকশন কমিটি সুপারিশ থাকলেও অনেকসময় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের অনুমোদন না মেলায় আটকে যেত। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিতে তখন ভাগ হওয়া কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য অধ্যাপকদের সিপিআই ও সিপিআইএম দলভুক্ত অধ্যাপকদের মধ্যেও ছিল সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বাদ প্রতিবাদ চলত।উপাচার্য পূর্ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সময়ে টীচারস কাউন্সিল লিভ রুলের জন্য আন্দোলন করে, পরে তা অনুমোদিত হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও তর্ক বিতর্ক হত। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন ব্যবস্থা ব্যক্তিবিশেষ গোষ্ঠী বা দলের খেয়াল খুশি ভালোলাগার ঊর্ধ্বে থাকবে না কেন? কেন নিয়ম-নীতি মানা হবে না? নিয়ম যখন সিলেকশন কমিটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মান্য করা, সেখানে ব্যক্তিবিশেষের অঙ্গুলিহেলনে তার অন্যথা হবে কেন ?বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষায় অবস্থা চরমে উঠেছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কিরণ শংকর ভট্টাচার্যের নিয়োগ নিয়ে। অধ্যাপক ভট্টাচার্য্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার আগে ছিলেন মালদা কলেজে।তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক পদে প্রার্থী ছিলেন। সিলেকশন কমিটি দ্বারা মনোনীত হয়ে এল তার নাম, কিন্তু এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের অনুমোদন মিলল না। জানা গেল বাধা এসেছে প্রার্থীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জলপাইগুড়ি র আনন্দ চন্দ্র কলেজের অধ্যাপক দেবেশ রায়ের কাছ থেকে। পরে অনেক মধ্যস্থতা ও বাদ-প্রতিবাদের ঝড় তুলে মীমাংসা হয়।অনুমোদিত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক কিরণশঙ্কর ভট্টাচার্যের নিয়োগ। যাক সেসব কথা! "কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!"
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মীদের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে উপাচার্যকে অনেক সময়ই নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হত। হয়তো এখনো হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক খবরদারিতে বহু সমস্যা তৈরি হত। কোনো রাজনৈতিক দলই শিক্ষায় রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ নিয়ে বিশেষ কিছু বলেন না।বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উপাচার্যরা পূর্ণ স্বাধীনতা পান না। উপাচার্য অধ্যাপক পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কার্যকাল শেষ হয়ে এল। দেশে তখন জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। নতুন উপাচার্য এলেন সুপ্রসিদ্ধ অর্থনীতিবীদ অধ্যাপক অম্লান দত্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হল আর এক নতুন আরম্ভ। এই পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ছাত্র হয়ে প্রবেশের অধিকার পেয়েছিলাম। (1975 -77 শিক্ষাবর্ষ) বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'বছরের স্মৃতির কত সঙ্গ অনুসঙ্গ আজো পিছু টানে।