সানিয়া/পর্ব-দশ
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^^
শক্তি
বেরিয়ে গেছে ঝড়ের। থেমে গেছে অবশেষে। হাত-পা ভাঙ্গা ছোট বড় গাছেরা
নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে। মাঠে ঘাটে জল জমে গেছে। সদ্য সন্তানহারা মা-বাবাদের
খবর নিতে বহু পাখী এসে জড়ো হয়েছে জমে থাকা জলের উপর। মেঘলা আকাশের গায়ে
ফুটতে শুরু করেছে সাতরঙা ধনুক। ফুটবো ফুটবো করেও অল্প দেখা দিয়েই মিলিয়ে
গেল আকাশে। চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজেছে পথঘাট। পথ-ঘাট আর মাঠ সোঁদা
গন্ধে ভরিয়েছে চারপাশ। সে গন্ধ নাকে আসে সানিয়া রামুর। বালিভেজা গন্ধের
থেকে এ গন্ধ একেবারেই আলাদা। ইতিমধ্যে মেঘ সরিয়ে সূর্য উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু
করেছে। এতক্ষণ মেঘের আড়ালে থেকে সে হয়তো দেখেনি কিছুই। ঝড় এসে তছনছ করেছে
চারপাশ। হেলে পড়েছে ঘরবাড়ি। টিনের চালগুলিকেও শুকনো পাতার মতো উড়িয়ে নিয়ে
গেছে দূরে। লোকজন সবাই ছুটছে সেদিকেই।
আবার
ভিজেছে শরীর। ভিজে চুপচুপ গায়ের জামা কাপড়ও। সাথে রাখা চিড়া গুঁড়ও আর
শুকনোটি নেই। ভিজে মাটিতে বসেই বৃষ্টিভেজা চিড়া গুঁড় চিবিয়ে চলে সানিয়া
রামু। খাওয়া শেষ হলে বেরিয়ে পরে ময়নাগুড়ির দিকে। রোদ এখন প্রখর নয়। গায়ের
পোষাক শুকিয়ে যাচ্ছে গায়েতেই। বিকেলের নরম রোদে হাঁটতে মন্দ লাগেনা তাদের।
পায়ের নীচটাকে বেশ আরামদায়ক করে দিয়েছে প্রকৃতি। বিকেল পাঁচটায় সানিয়া রামু
পৌঁছায় ময়নাগুড়িতে।
ময়নাগুড়ি
তখন শহর হয়ে ওঠেনি। গুটিকয়েক পাকাবাড়ি আর বেশীর ভাগ ঘরই টিনের চালে ছাওয়া।
বাজার ঘাট খোলা রয়েছে। লোকসমাগমও মন্দ নয়। চায়ের দোকানের চাংড়াতে পা তুলে
বসে বৃদ্ধেরা। খোশ গল্পে মশগুল। রেডিওতে গান চলছে দোকানের ভেতর। চা পান
করবার ইচ্ছে হয় রামুর। সানিয়াকে বলতেই দু'জনে গিয়ে বসে চায়ের দোকানে।
সানিয়া রামুকে দেখে বুড়োদের গল্পের তাল কাটে। অস্বস্তিতে পরে সানিয়া রামু।
চায়ে চুমুক দিয়ে শরীরটা সতেজ হয়ে উঠে দু'জনেরই। মগ মগ চায়ের স্বাদ নেওয়া
মন দুটোর এক ভার চায়ে আয়েস মেটেনা। আরো দুই ভার চা ও বড়া নিয়ে রামুকে বলে
-বেলাটা
পরি গেল রে রামু। এঠে থাকি পানবাড়ি এলাও মেলা দূর। ঠিকমতন চলিলে আরো
দুই-তিন ঘণ্টা নাগিবে। এলা বেরালে মনে হয় ঠিক হবার নহয়? রাস্তাঘাটা তো
জানা নাই মোর। আন্ধারোত স্যালা কি করিমো হামা? ওইলা জায়গাতো জঙ্গল দিয়া
ভত্তি। ভাঙ্গাবেড়ার নগত য্যালা চরোত গেইসিনু স্যালাতো হিটা বাজার চক্ষুত
পরে নাই।
-মুইতো কিছুই জানোনা। তুই যেইটা করিবো সেইটায় হোবে। দ্যাখ কি করিবো।
-আতিটা
এঠে কাটালে একটা দিন লস হয়া যাবে রে। মালিকতো দুই দিন পড়ে যাবার কইসে।
যাবারে নাগিবে বাথান। ওইদিন বাথানোত নাকি কিল্যা পুজা হোবে। হামাক বোলে
নয়া জামাকাপড় দিবে। আরও বোলে কত কি।
-ঠিকে কইসিত। চল যা হোবার হোবে। যেঠে ঠেকি যামো ওঠেটায় তিস্তাবুড়ির নাম নিয়া থাকি যামো।
পকেটে
হাত দিয়ে চমকে ওঠে সানিয়া। পয়সার থলি টা যে নেই। পকেট হাতরাতে হাতরাতে
উত্তেজনায় হাত পা কাঁপতে শুরু করে সানিয়ার। শিরা উপশিরায় বইতে শুরু করে
ঠান্ডা স্রোত। হালকা হয়ে যায় শরীর। কষ্টে আর হতাশা বুকের পাজর ভেদ করে
গুলিয়ে দিচ্ছে হৃদয়। এখন কি হবে? কি করে সানিয়া মেটাবে চা আর বড়া ভাজার
পয়সা? তাড়াহুড়োতেই পথে হারিয়েছে পয়সার থলি। সে পয়সা ফিরে পাওয়ার আর কোন
সুযোগও নেই। ছল ছল করছে সানিয়ার চোখ। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে। দুরু দুরু বুক
নিয়ে দোকানের মালিককে সবকিছু খুলে বলে রামু।
-ঠিক আছে সবই বুঝলাম। তোরা যাবি কোথায়?
-নাথুয়া
-মরবি
নাকি রে? নাথুয়া তো এখান থেকে অনেক দূর। বেলা তো আর নাই বললেই চলে। এক কাজ
কর। রাতটা এখানেই থাক। দোকানের বাড়ান্দার চাংড়াতে ঘুমাতে পারবি। আর শোন ওই
যে হাড়ি পাতিল গুলা আছে ওইগুলা ভালো করে মেজে দে। তোদের আর চায়ের দাম দিতে
হবে না। বুঝলি?
বুকে জল
আসে সানিয়া রামুর। ভেবেছিল দোকানের মালিক মহিষ দুটিকেই হয়তো আটকে রেখে
দেবে। পয়সা না পেলে যেতে দেবেনা তাদের। কিন্তু এমনটি হয়নি। দোকানের মালিককে
দয়ালু বলেই মনে হয় তাদের। আর যা হউক রাতে মাথা গোঁজার জায়গাটাতো তিনি করে
দিচ্ছেন। সময় নষ্ট না করে দুই বন্ধু কাজে লেগে পরে। হাড়ি বাসন মাজার অভ্যেস
তাদের রয়েছে। তাই এ কাজে ভয় পায়না তারা মোটেই। বাসনের পরিমাণ দেখে তারা
বুঝতে পারে দিনের বেলায় এই চায়ের দোকানে ভাতের হোটেল চলে। পশ্চিম আকাশে
সূর্য ঢলে পরেছে। দোকানীরা দোকান বন্ধ করে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে ভাগ্যহীন দুই কিশোর ব্যস্ত বাজারের ঢ্যাপ কলের পাশে। একজন ছাই দিয়ে
বাসন ঘষছে আর একজন জল দিয়ে এক এক করে বাসন পরিষ্কার করছে।
অন্ধকারে
ঢেকেছে চারপাশ। সানিয়া রামুর কাজও শেষ। মহিষ দুটিকে দোকানের বারান্দার
খুঁটিতে বেঁধে হাত পা ধুয়ে মালিকের কাছে যায় সানিয়া। শেকল পেঁচিয়ে
দোকানঘরের দরজায় তালা মারতে মারতে বলে
-কোনো ভয় নাই এখানে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পর। কেউ আসবে না।
অবশেষে
একহাতে বিড়ি আর এক হাতে কালি পরা দোকানের হ্যারিকেনটা নিয়ে বাড়ির দিকে
রওনা দেয় দোকান মালিক। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। দুপুরের ঝড় বৃষ্টির পর
আকাশ এখন পরিষ্কার। আধ খাওয়া চাঁদ তার সুবিশাল সংসার নিয়ে মাথার উপরে
বিরাজমান। একদল মেঘ উড়ে যাচ্ছে নতুন ঠিকানায় আবার একদল ধীর স্থির হয়ে কারও
জন্য অপেক্ষারত। বাজারের মাঝে জোনাকি পোকার মত চলমান কিছু আলো। ছোট হতে হতে
তারা মিলিয়ে যেতে থাকে দূরে। এসব দেখতে দেখতেই মায়ের কথা মনে পরে যায়
সানিয়ার। মনে পরে বাচ্চু ফুলমণির কথাও । দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে থাকে।
কোন মুখ নিয়ে সে কাল দাঁড়াবে ভাই বোনের কাছে? চার বছরের যৎসামান্য সঞ্চয়
দিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখেছিল বিগত কয়েক দিন থেকে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই তা
ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। রাগে কষ্টে অসহ্য এক যন্ত্রণা শুরু হয় সানিয়ার বুকে।
চাংড়ার উপর শরীর ফেলে দিয়ে রামুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সানিয়া।
রামু তাকে শান্তনা দিয়ে চলে। থেমে যায় কান্না। সানিয়ার নিষ্পলক চোখ দুটি
তাকিয়ে থাকে অন্ধকার মাখা রাস্তার দিকে। রামু ঘুমিয়ে পরেছে পাশে। টু-শব্দটি
নেই তার। সবকিছু ছেড়ে এসেও ও কত সুখী। কোন চিন্তা ভাবনা নেই। সুখী মানুষের
মত বেঘোরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
ইতিমধ্যে
তাদের কাছে চলে এসেছে বাজারের নৈশপ্রহরীরা। মহিষদুটিকে দেখে চিৎকার
চ্যাঁচামেচি শুরু করে সারমেয়র দল। দলবদ্ধভাবে তারা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে
শুরু করে। বাঁধা মহিষ দুটি ভয় পেয়ে ডাকতে শুরু করে। এ ডাকের মানে বোঝে
সানিয়া। রামুকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। দুই বন্ধু লাঠি হাতে তেড়ে যায়
কুকুরগুলির দিকে। কিন্তু কুকুরেরাও বিন্দুমাত্র জমি ছাড়তে নারাজ। দুই পক্ষই
একে অপরকে সমীহ করছে। দূরত্ব বজায় রেখে অপেক্ষা করছে দু’পাশে। এ যেন
যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে একটুকরো ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। ক্লান্ত শরীর দুটির আর
ঘুম হয়না রাতে। মহিষ রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। লাঠি হাতে চাংড়ায় বসে অপেক্ষা
করতে থাকে ভোরের আলোর।