শূন্য আমি পূর্ণ আমি/১০
শূন্য আমি পূর্ণ আমি
পর্ব/১০
অমর চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন আমার এসবের প্রেরণা কে? আমি বলব, আমার বাবা। না তিনি সরাসরি কখনো কিছু বলেননি তবে অদ্ভুত এক উদ্দীপনা তৈরি করে দিতেন। সিনেমা নিয়ে কি বলেছেন সেটা আগে উল্লেখ করেছি। একদিন বললেন ভালো ছেলেরা সবসময় দেশের খবর রাখে, নিয়মিত পত্রিকা পড়ে। বললেন - আজ স্কুলে সাংবাদিক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী এসেছিলেন, এসেছিলেন হরিপদ চক্রবর্তী। পত্রিকা দপ্তরগুলোতে যাতায়াতের সূত্রে ওনাদের নাম শুনেছি। বাবার ওই কথায় মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ খেলে গেল আরে সাংবাদিকতা কাজটা খুব মজার, সম্মানের। এটা করলে কেমন হয়!
আমার কর্মজীবনের একটা অধ্যায় বা মিসিং লিঙ্ক ফিরিয়ে আনছি। বাবা একদিন বললেন - গভর্নমেন্ট প্রেসে কম্পোজিটর নেবে। তৈরি হও। কাল থেকে শ্রীকৃষ্ণ প্রেসে গিয়ে কম্পোজ শিখবে। এই প্রেসটা ছিল সুনীতি একাডেমীর উল্টোদিকের রাস্তায়, নামকরা নার্সিং হোমের উল্টোদিকে। যেতে শুরু করলাম এবং টাইপের কালি মাখা শুরু হল। কিন্তু চাকরি হল কই! একটা লাভ হল পরে যখন লাইনোটাইপে পত্রিকা করতাম জয়ন্তী প্রেসে, পানুদা ভানুদাদের সঙ্গে হাত লাগাতে পেরেছি। রাত জেগে পুজো সংখ্যা, প্রেসের কালি মেখে মুড়ি চানাচুর খাওয়া এবং ঐ হাতেই নতুন পত্রিকার গন্ধ শুঁকে এক লাইন গেয়ে ওঠা 'মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় ভাসালে'!
তো বাবা মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন সংবাদপত্র। বৈদ্যনাথবাবুর কাছে গেলাম কিন্তু খুব মিশতে পারলাম না। উনি আনন্দবাজারের কিন্তু যুগান্তর-এর হরিপদদা অর্থাৎ হরিপদ মুখার্জির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারলাম। ওনার পরামর্শে কোচবিহার সমাচার-এর অফিসে গিয়ে ছোটখাট খবর লিখে দিয়ে আসতাম। এর মধ্যেই কিছু বাইরের পত্রিকা কিনতে শুরু করলাম। 'ইলাস্ট্রেটেড উইকলি' কিনে আনলাম। ওখানে একটা বিজ্ঞাপন দেখে ব্রিটিশ ইন্সিটিউট থেকে মাস কমিউনিকেশনস-এর ডাকযোগে সাংবাদিকতার পাঠ নিতে শুরু করলাম। বাবাকে দেখাব আমিও সংবাদপত্রে আছি।বাবা খুব বড় চাকরি করেননি কিন্তু এত মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেয়েছেন আমি মুগ্ধ চোখে দেখেছি। বললেন, জর্জ কমার্সিয়ালে যাও, টাইপ শর্টহ্যান্ডে ভর্তি হয়ে যাও। একটুও দেরি করিনি কারণ সাংবাদিকতা করতে হলে এ দুটোই দরকার। জর্জ কমার্সিয়ালের মালিক বিজয় সরকারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ বিনে মাইনেতে এই সুযোগ দেওয়ার জন্য। খুব যত্ন করে স্টেনোগ্রাফি শিখিয়েছিলেন দুলুদা, দুলাল ঘোষ। এটাও জীবনে কাজে লাগল। দুটো রুলে লিখলাম এল (L) আর (V)এর স্ট্রোক। লিখলাম asdfg মানে টাইপ। পেলাম সার্টিফিকেট কিন্তু কাজে লাগল না। বাড়ি ছেড়ে কলকাতা যেতে হবে। কিন্তু মা চলে গেছেন বাড়ি ছেড়ে যাব কি করে! ছোট ভাই বোন। রান্নাও করতে হয়। না এখানে না কিছু হোক। মাস্টারমশাই বারীন রাহার নদার্ণ রিভিউ, মাস্টারমশাই গোপেশ দত্তের উত্তর ভূমিকা - এইসবেই থাকতে হবে। আরো একটি সমস্যা পারিবারিক কারণে যখন তখন সংবাদ সংগ্রহে ছুটে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ধুস্ এ আমার পথ নয়! আমার পথ গল্প কবিতা।
তবে আমার কি হবে! সাংবাদিকতা করা হবে না তবে! একদিন যুগান্তর-এর পাতায় একটা একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল - উত্তরবঙ্গের জন্য সাংস্কৃতিক সাংবাদিক চাই। আরে এই তো আমার সা়ংবাদিকতা পথ। এটাই বেছে নেব। এর মধ্যেই কোচবিহারের নাট্যদলগুলির সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে থিয়েটার ইউনিটের দিবাকর গাঙ্গুলি ইন্দ্রায়ুধের দীপায়ন, নন্তু, বলরামদের সঙ্গে। আমি 'অভিনয়' পত্রিকায় নাটক সংবাদ লিখতে শুরু করলাম। সম্পাদক দিলীপ বন্দোপাধ্যায় বেশ যত্ন সহকারে ছাপতেন। কিন্তু শখ মেটে অর্থ মেলে না। সংসারের অর্থের প্রয়োজন। আবার বাবা বললেন - কলকাতার এক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশক পাঠ্যবইয়ের ক্যানভাসার নেবে হোটেলে গিয়ে দেখা করো। গেলাম রবীন্দ্র (ভট্টাচার্য) বাবু কাজটা দিলেন কিন্তু জাঁকিয়ে বসতে পারলাম না। যখন স্কুলে চাকরি করি স্পেসিমেন কপি দিয়ে রেকমেন্ডের জন্য অনুরোধ করা মানুষটির দিকে তাকিয়ে অতীত দেখি আর সবার বই রেকমেন্ড করি কারণ একাডেমিক কমিটি নিজের মতোই করবে জানি তাই কাউকে কষ্ট দিতে পারিনি। এরা তো আর এক অমর চক্রবর্তী।
পতঞ্জলদর্শনে জেনেছিলাম প্রতিটি মানুষ আত্মীক শক্তিতে পূর্ণ থাকেন কিন্তু সাধারণ মানুষ অনেক সময়ই তার প্রকাশ ঘটাতে পারে না। তার জন্য স্বনিষ্ঠ নিয়মে অভ্যাস করতে হয়। আমি পারছি না! পারিপার্শ্বিকতা, সংসার প্রতিবন্ধক হয়ে যাচ্ছে। তাহলে অন্য ভাবনায় যেতে হবে। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গ সংবাদ শিলিগুড়িতে অফিস করল। ইন্টারভিউএ গেলাম। পিটিআই ইউএনআই-এর টেলিপ্রিন্টারে প্রাপ্ত সংবাদ অনুবাদ করতে হল। ইংরেজিটা তখন ভালো জানতাম না হয়তো! ঠিকঠাক হয়নি তাই চাকরি হল না। কিন্তু বন্ধুত্ব হল মনোজ রাউত (তুষার প্রধান) রামসিংহাসন মাহাতো ওদের সঙ্গে। তবে ওরা আমাকে আবীর চক্রবর্তী নামে চেনে। একসময় উত্তরবঙ্গ সংবাদের শিশু কিশোরদের পাতায় প্রচুর লিখেছি।স্বপ্নভঙ্গ হল! একটু কলকাতায় চেষ্টা করতে হবে। ইতোমধ্যে কলকাতা থেকে এবং ত্রিপুরা থেকে দুজন বন্ধু এলেন।। একজন আজকের সুখবর দৈনিক, বন্ধ হয়ে যাওয়া শিলাদিত্য এবং কর্মসংস্থান পত্রিকার মালিক শমীক ঘোষ, অন্যজন ত্রিপুরার বিখ্যাত কবি নকুল রায়। শমীক তখন প্রখ্যাত সাংবাদিক, শংকরলাল ভট্টাচার্যের শাশুড়ি এবং দূরদর্শনের সংবাদ পাঠিকা ফ্যাশান ডিজাইনার ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্যের মা গীতা মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত রূপসা-য়, কলিকাতা সাহিত্যিকা-য় (যে পত্রিকা একদা রবীন্দ্রনাথও সম্পাদনা করেছেন) বহু কাগজে আমার কবিতা। রূপসী থেকে রূপসা। শমীক-এর বারুইপুরের বাড়িতে আমি অনেক দিন থেকেছি। ও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল গাঙ্গেয় পত্রিকার সম্পাদক প্রফুল্ল রায়ের সঙ্গে। এ কাগজে আমি অনেক লিখেছি । প্রফুল্ল রায়-এর ছেলে শিখর রায় আর ইন্ডিয়া রেডিওতে ছিল। শিলিগুড়ি রেডিওতে আমাদের মতো নতুন কবিদের নিয়ে কবিতা পাঠ হত। আমি ডাক পেয়েছিলাম অঙ্কুর অনুষ্ঠানে। কবিতা লিখে কিছু আয়। 'নাচের মুদ্রায় ঝরে তুষার/রূপোলি জলপায়রা পশ্চিম থেকে খসে পড়ে কখনো সখনো পাশ দেখা যায়। উঁচু অনেক উঁচুতে তারাগুলি। পাবলো নেরুদার কবিতার মতো হয়ে যাচ্ছে এই রচনা। এক লিখতে গিয়ে চলে আসছে আর এক। স্মৃতিগুলি নদীর তরঙ্গের মতো আসছে বড়, ধরতে যাই পাশ থেকে ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবার বিস্মরণে চলে যাচ্ছে। অনেক উঁচুতে তারা। এর মধ্যে দুটি সুখবর আমার প্রথম গল্প 'মাছধরা' ছাপা হচ্ছে মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত বর্তিকা-য়।গল্প ছাপছে সত্যযুগ দৈনিকে এবং তখন বা়ংলাদেশের একমাত্র সাহিত্য সাময়িকী 'সুর' পত্রিকায়। বন্ধু পেলাম সাংস্কৃতিক খবর পত্রিকার সম্পাদক কাজল চক্রবর্তী সত্যযুগ পত্রিকার নিয়মিত লেখক সত্য মিত্র। তুলি পত্রিকার অসাধারণ হাতের লেখায় সহ সম্পাদিকা রত্না শূর। রত্নাদি এখন লেখায় নেই। পূর্ব পুটিয়ারীতে তৃণমূল দলের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর। আমি সবার বাড়িতেই থেকেছি আদর যত্ন পেয়েছি এবং বহু কাগজে লেখার সুযোগ পেয়েছি। ডাক পেলাম সমকালীন কলকাতা'র অসিত পালের। চিত্রশিল্পী হিসেবে যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। নকশাল আন্দোলন নিয়ে লিখলাম 'উত্তরে উনাইল মেঘ বর্ষিবে কি দক্ষিণে!' আমি কতবছর আগে 'পশ্চিমবঙ্গ' পত্রিকায় কোচবিহারের পাটিশিল্পীদের নিয়ে। 'পরিবর্তন' পত্রিকায় কোচবিহারের নাটক নিয়ে, সাহিত্যকদের নিয়ে। পরিবর্তন'তখন জনপ্রিয় পত্রিকা। গাঙ্গেয়'তে লিখেছিলাম হুদোম দ্যাও এবং টোটোদের নিয়ে।টোটোদের লেখাটি তৈরি করেছিলাম ড.কালী রায়চৌধুরীর সঙ্গে নানা গল্পে। উনি টোটোপাড়ায় সুইডিশ মিশনের ডাক্তার ছিলেন। অনেক শিকারের গল্প শুনেছি। এবার আমাকে কোচবিহারের কথায় আসতে হবে। কারণ এখানের বন্ধু বান্ধব স্বজন আমাকে পথ দেখিয়েছেন। যে প্রদীপ জ্বালিয়েছি তার সলতে পাকানো তো এখানেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴