শালসিঁড়ি-১০/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-১০
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
-নিলয় এসে পড়। আমি এসে গেছি।
মাস্টারদা বলে – আপনি বনের বড় কর্তা?
বিকাশ জিজ্ঞাসা করে- আপনি?
- এখানকার সবাই আমাকে মাস্টারদা বলে ডাকে।
- মাস্টার মশাই, আমাদের স্টাফদের একবার ডেকে দিতে বলুন।
- নিবারণ, দেখ্ তো স্টাফগুলা কোথায় গেল।
মাস্টারদা বলে- এই কে কোথায় আছিস, একটা চেয়ার নিয়ে আয়, বসতে দে…
বিকাশ দ্যাখে মাস্টারমশাই উচ্চতায় তার থেকে অনেকটা ছোট। মাস্টারমশাইকে ঘাড় পিছনের দিকে বাঁকিয়ে উপর দিকে তাকিয়ে বিকাশের সাথে কথা বলতে হচ্ছে। কিছু মাস্টারমশাইরা এরকম হয় যে উচ্চতাকে চেয়ারে বসিয়ে সমান করে নেয়। উনি নামে না কামে মাস্টার - সেটা জানার ইচ্ছা বিকাশের এখন নেই। এখানে শিক্ষক ছাড়াও অনেককে ভিন্ন ভিন্ন কাজে পারদর্শিতার জন্য সহজ সরল গ্রামবাসীরা মাস্টার বলে ডাকে। বিকাশের মন ছটফট করছে তার স্টাফদের দেখার জন্যে; গাউরটিকে সুস্থ অবস্থায় বনে ফিরিয়ে নেবার জন্যে। কে একজন একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে দেয়।
চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে বিকাশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে…একটা চেয়ারে বসার পিছনে কত কী কী যে স্বীকার করতে হয়- পাথর ফুল কাঁটা। বিকাশের মনে হয়- হিমালয়ের মতো উচু উচু পাহাড়গুলো পৃথিবীর অভিমান। হিমালয়ের চেয়ারের সাপোর্ট দরকার হয়না। বিকাশ বলে- না না, চেয়ার লাগবে না। কাজটা করতে দিন। কাজটা না হলে আপনাদের সারা রাত আতঙ্কে থাকতে হবে।
- না না, একটু বসুন। কতটা হেঁটে এলেন। আপনি এসেছেন, এই বার কাজ হয়ে যাবে।
- মাস্টার মশাই, সে হবার হলে এতক্ষণে হয়ে যেত। আপনার লোকজন করতে দিল কই।
ডাক্তারবাবু-নিলয়-নির্মলবাবুরা সবাই এসে বিকাশের পাশে দাঁড়ায়। একটা ট্র্যাংকুইলাজিং টিমে একজন পশু-চিকিৎসক, এক জন ট্র্যাংকুইলাইজার, একজন সহকারী, দুই জন বন্দুকধারী এবং নির্মলবাবুর মতো একজন অধস্তন বন-অফিসারের নিয়ন্ত্রণে ৭-৮ জনের সাপোর্ট টিম থাকে। এরা সব দুটো গাড়িতে করে আসে। সাথে যোগাড় করে নিতে হয় অচেতন করা বন্যপ্রাণকে বহন করার জন্য ট্রাক জাতীয় কোন গাড়ী। বিকাশ জানে এতজন স্টাফকে একত্র করে দ্রুত কোন মানুষ- বন্যপ্রাণ সংঘাত এলাকায় এসে পৌঁছনোর পিছনের ছবিটা ঠিক কী। কেউ হয়ত সকালে ব্রাশ করেনি, ঘুম থেকে সরাসরি উঠে এসেছে, কেউ হয়তো বাচ্চাটিকে সাইকেলে স্কুলে পৌঁছাতে যাচ্ছে-তখন অন্য কাউকে নিজের শিশু তুলে দিয়ে ছুটে এসেছে। কেউ হয়তো সারারাত ডিউটি করে সকালে ঘুমাতে গেছে- তাকে তুলে আনা হয়েছে। বিকাশ জানে সকালে যখন কোন ‘মানুষ- বন্যপ্রাণ’ সংঘাতের খবর আসে তখন একটা বন-অফিসের কি অবস্থা হয়। যেন যুদ্ধ শুরুর ঢংকা বাজে…
সব স্টাফকে এক সাথে দেখে বিকাশের মন এই সংকটের সময়ে মাঝ আকাশের সূর্য হয়ে উঠে- ওর আনন্দ উচ্ছলতা ও এগিয়ে যাবার সাহস সবাইকে চনমনে করে দেয়।
বিকাশ বলে- মাস্টারমশাই, আমরা গাউরটির কাছে যাচ্ছি। আপনার লোকজনকে বাঁশঝাড়ের কাছে থেকে সরিয়ে দিন। যতক্ষণ কাজ শেষ না হয় কেউ যেন বাঁশঝাড়ের কাছে না যায়। এই কাজটা করে সাহায্য করলে আমাদের খুব উপকার হবে। তা না হলে রাতে গাউরকে কিন্তু আর বশ করা যাবে না। রাতের বেলায় আর ঘুমপাড়ানি গুলি ছোঁড়া যাবে না।
বিকাশ, ডাক্তারবাবু, নির্মলবাবু, নিলয়’রা বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে নিলয়, নির্মলবাবু , ডাক্তারবাবু গাউরটিকে দেখে অনুমান লাগায় - গাউরের শরীরের ওজন কত হতে পারে। নিলয়, তার সহকারী ও ডাক্তারবাবু বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি গ্রাউন্ড সীট পেতে বসে পড়ে ডার্ট বানাতে। ডার্ট হলো স্বয়ংক্রিয় ঘুমপাড়ানি ইঞ্জেকশান। ঘুমপাড়ানি ইঞ্জেকশন শুনতে রোমাঞ্চকর হলেও, প্রয়োগ খুব কঠিন। একদমই “ বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ, মাগো আমার শোলক বলার কাজলা দিদি কই” এর মতো নয়। এর পিছনে রয়েছে সূক্ষ্ম বিজ্ঞান। কিছু একটা ভুলচুক হলে ঘুমপাড়ানি গুলি কাজ করবে না। অন্যদিকে নির্মলবাবু জান কবুল করে দিচ্ছে লোকজনদের বাঁশঝাড়ের কাছ থেকে দূরে সরাতে। হ্যান্ড-মাইক আর খালি গলায় চেঁচাতে চেঁচাতে গলা বসিয়ে ফেলেছে। মাস্টারদা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বাঁশঝাড়ের কাছ থেকে ভিড় কমাতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। এই জনসমুদ্রের এখন যেন ভরা কোটাল চলছে। একের পর এক উত্তাল ঢেউ এসে পড়ছে নির্মলবাবু এবং মাস্টারদাদের উপর। দুই বন্দুকধারী নিলয়কে গার্ড করে আছে । নিলয়-কে ডাক্তারবাবুর তত্ত্বাবধানে খুব সাবধানে ডার্ট বানানোর কাজটি করতে হয়। ওকে বিব্রত করলে ডার্ট তৈরিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে। বিকাশ সমস্ত বিষয়টির উপর নজর রাখে। মাঝে মধ্যে ফোন রিসিভ করে ও কথা বলে…
- কী বললে। অক্সিজেন চলছে? রক্ত লাগবে?
- এক্ষুনি দেখছি।
সদরে বন্যপ্রাণ দ্বারা আহত মানুষদের দেখভাল করার জন্য বিকাশরা একটা ব্যবস্থা করে রাখে। তারা যখন পেরে ওঠে না তখন বিকাশদের সাহায্য চায়। বিকাশ জানে এখন ওকে কিছু একটা করতে হবে। নাহলে সাবিত্রীর কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। বিকাশ ফোন করে ওর বন্ধু সার্কেলে। বন্ধুরা আশ্বস্ত করলে বিকাশের চিন্তা কমে।
বিকাশ দেখতে পায়, নিলয় কীট-ব্যাগে কী যেন তন্ন-তন্ন করে খুঁজছে।
- কি খুঁজছ নিলয়?
- স্যার সঠিক ড্রাগ-ব্যারেল পাচ্ছিনা। গাউরে শরীরের ওজনের তুলনায় হয় খুব ছোট হচ্ছে না হয় খুব বড় হচ্ছে…
ডার্টের যে অংশে তরল কেমিক্যাল থাকে সেটাকে ড্রাগ-ব্যারেল বলে। গাউরের শরীরের ওজন অনুসারে তরল কেমিক্যালের পরিমাণ নির্ভর করে। তরল রাসায়নিকের পরিমানের উপর নির্ভর করে ড্রাগ-ব্যরেলের সাইজ। সব গাউরের শরীরের ওজন এক হয়না এবং শরীরে ওজনের কোন শ্রেণী বিন্যাস নেই যে, সব রকমের সঠিক পরিমাপের ড্রাগ-ব্যারেল অগ্রিম পাওয়া যাবে। ড্রাগ-ব্যরেল কতগুলো নির্দিষ্ট দৈর্ঘের মাপে হয়। এই গাউরে সাইজটা এমন বেখাপ্পা যে সেসবের কোন মাপের সাথে মিলছে না - হয় ছোট হচ্ছে নয়তো বড়। অন্যদিকে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে হাজার হাজার লোকের চিৎকার- চ্যাঁচামেচি। নার্ভ ঠিক রাখা দায়।
বিকাশ বলে - নিলয় কেমিক্যাল ঢালা হলো?
- না। কী যে করি বুঝতে পারছি না।
- কেন, কানচুলকার চিতা-বাঘের ঘটনা ভুলে গেলে?
- ওহো… ঠিক তো স্যার। এবার হয়ে যাবে।
টেনশন এই রকমই হয়। সহজ জিনিস মানুষ ভুলে যায়। কিছু মানুষ আছে যারা শালসিঁড়ির মত টেনশনেও স্থির। গায়ে যতই কুঠারঘাত পড়ুক, যতক্ষণ পর্যন্ত না মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ততক্ষণ পর্যন্ত আলো জল মাটি ধরে রাখবে।
আবার বিকাশের রিং টোন বেজে উঠে… “চল চল চল উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল…”
-হ্যাঁ বল-
-অপারেশন করতে হবে? ঠিক আছে করাতে বল।
-আরো দুই ইউনিট রক্ত লাগবে? ঠিক আছে। হয়ে যাবে। চিন্তা করোনা।
বিকাশ আবার কাউকে ফোন করে বলে- শুনলি, আরো দুই উনিট যোগাড় কর। হ্যাঁ… ঠিক আছে, সব হয়ে যাবে তো? হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি ঠিক আছি।
এই শহরে বিকাশের কেউ চেনা-জানা ছিল না। কোন বন্ধু ছিলনা। প্রথম প্রথম শহরের যারা বন নিয়ে খোঁজ খবর রাখে তারা বিকাশকে বন-পাওয়া মানুষ ভাবতো। সংরক্ষণ সচেতনতা বৃদ্ধির প্রোগ্রাম করতে করতে এই শহরে ওর এখান অনেক সবুজ বন্ধু আছে। ওরা ওর খবর রাখে- বিকাশের ভাল লাগে। বিকাশের বন্ধুরা শালের সহযোগী গাছের মত। কেউ চাপ তো কেউ চিলৌনি। কেউ টুন তো কেউ চিক্রাসি। কেউ ময়না তো কেউ টিয়া পাখি। বিকাশের বন্ধু আড্ডা যেন শালবন। নিঃস্বার্থ – নিসর্গ।
নিলয় নিডিলের ডগায় ভেসিলিন লাগায় এবং ড্রাগ-ব্যারেলে কেমিক্যাল ভর্তি করে । ভর্তি ড্রাগ-ব্যারেল সহকারী কে ধরতে দিয়ে, নিলয় রবারের প্লাঞ্জার হাতে নিয়ে তাতেও ভেসিলিন লাগায়। প্লাঞ্জারের বাইরের দিকের খাঁচে অতি ক্ষুদ্র সাইজের সাইকেলের পাম্পারের মত একটা বারুদ ভর্তি চার্জ বসায়। এটাকে সিরিঞ্জ চার্জার বলে। বিকাশ নিলয়কে দেখে কিন্তু চারপাশেও খেয়াল রাখে। বিকাশ দেখতে পায় মাস্টার মশাই উত্তেজিত হয়ে কিছু লোক নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
- বিকাশ বাবু, হারানের বৌএর অবস্থা ভালো নয়। ওর ঠিক মত দেখ্ ভাল হচ্ছেনা। আর এই দিকে বাইসনটি একই ভাবে আছে। কখন কী হবে বলুন।
সঙ্গে সঙ্গে ওর সাঙ্গপাঙ্গ’রা রে রে করে উঠল।
- সাবিত্রীর অপারেশন হবে। আরো দুই ইউনিট রক্ত লাগবে। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তাও বলছেন দেখ্ ভাল ভালো হচ্ছে না।
মাস্টার মশাই অনেকটাই চুপসে যায়। সাঙ্গপাঙ্গরা রণে ভঙ্গ দেয়।
বিকাশ বলে- আমি যখন এতটা পথ আপনাদের বিশ্বাস করে আসলাম, আপনারা আমাকে একটু বিশ্বাস করুন। আমি সব দিকটাই দেখছি। আমাদের কাজ করতে দিন। আর শুনুন, আপনার লোকজনদের একটু সামলান।
- লোকজনদের ঠেকাতে গিয়ে কাল ঘাম ঝরে যাচ্ছে। আর কতক্ষণ জনরোষ সামলাবো। যা করবেন তাড়াতাড়ি করুন। কাজ শেষ করুন তারপর বসব।
নিলয় একমনে ড্রাগ-ব্যারেলের মধ্যে প্লাঞ্জার ঢুকায়। প্লাঞ্জার ঢুকিয়ে তার সাথে স্টেবিলাইজার লাগাতে থাকে। স্টেবিলাইজার দেখতে ধনুকের তীরের পিছনের দিকের মত- পালক লাগানো। স্টেবিলাইজারের কাজ হওয়া কেটে কেটে ডার্টকে সঠিক নিশানায় ধরে রাখা। এই ডার্ট গুলি করার পর রাইফেলের মত যায় না। রাইফেলের গুলি ছোটে তীব্র ঘূর্ণাবর্তের জোরে- সোজা পথে। ডার্ট যায় অধিবৃত্ত পথে হাওয়া কেটে কেটে। তাই রাইফেল দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা যত সহজ, ট্র্যাংকুইলাইজিং গান দিয়ে ডার্ট ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদ করা ততোধিক কঠিন। ডার্টের গতিপথে যদি হাওয়ার তারতম্য ঘটে, পাতার মত কিছু পড়ে তাহলেই ডার্ট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাবে। নিলয় এসব জানে বলে ওর কপালে ঘাম জমে। বিকাশ সাহস দেয়- পাহাড়ের মত। নিলয় অতি দামী কেমিক্যাল দিয়ে দুইটি ডার্ট তৈরি করে।
বিকাশ বলে- কেমিক্যাল কী দিয়েছ।
- স্যার, ডাক্তার বাবু বললেন তিন ভাগ পাঁচ ভাগ দিতে।
- ঠিক আছে।
বন্য প্রাণের জৈবিক ব্যবহার অনুযায়ী ঘুম পাড়ানি কেমিক্যাল নির্বাচন করা হয়। মাংসাশী প্রাণীর জন্য এক ধরণের রাসায়নিক, তৃণভোজীদের জন্য আর এক ধরণের রাসায়নিক। কখনো কখনো দুই ধরণের রাসায়নিক মিশ্রিত করে নতুন রাসায়নিক তৈরি করে ডার্ট বানানো হয়। আজ গাউরের জন্য মিশ্রিত রাসায়নিক বানানো হয়। এক ধরণের রাসায়নিক গাউরকে ঘুম পাড়াবে, অন্য রাসায়নিক গাউরের পা’কে- ঘাড়’কে অবশ করবে যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় স্টাফদের পা দিয়ে লাথি বা শিং দিয়ে গুঁতো মারতে না পারে।
বিকাশ বলে- নিলয়, কত মিটার দূর থেকে ডার্ট গুলি করবে( ছুড়বে)।
- ১০-১৫ মিটার দূর থেকে।
- ঠিক গান-চার্জার দেবে।
- হ্যাঁ স্যার।
গান-চার্জারকে ট্র্যাংকুইলাজিং গানের পিন আঘাত করে। সেই আঘাতে গান-চার্জার ফেটে গিয়ে কার্টিজকে গতি দেয়। সেই গতি নির্ধারিত হয় গান-চার্জারের ক্ষমতার উপর। কার্টিজের সঠিক গতি সঠিক দূরত্বে ডার্টকে ছুঁড়ে ফেলবে। তাই গান-চার্জারও খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিলয় দুই হাতের তালুতে গান-চার্জার ঘষতে থাকে- যাতে চার্জারটি গরম হয় এবং ঠিক মত ফাটে। নিলয় ট্র্যাংকুইলাইজিং গানের ব্যারেলে ডার্ট ঢুকায় এবং গান-চার্জার কার্টিজ-এ সেট করে ব্যারেলে ঢুকিয়ে ট্র্যাংকুইলাইজিং গান রেডি করে।
বিকাশ বলে- সিরিঞ্জ চার্জার ঠিক ছিল তো।
• হ্যাঁ স্যার। হাতের তালুতে ঘষে গরম করে লাগালাম।
বিকাশের আগের কিছু কথা মনে পড়ে। একবার নিলয় নদীভাসা গ্রামে একটা গাউরকে সুপারি বাগানে ট্র্যাংকুইলাইজ করেছিল। ডার্ট লেগেছিল সঠিক যায়গায়, সঠিক ভাবে। ট্র্যাংকুইলাইজিং করার সময় বন্য প্রাণীর শরীরের সব অংশে ডার্ট লাগানো যায় না। শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশে ডার্ট লাগাতে হয়। নিলয় সঠিক যায়গায় ডার্ট লাগায় কিন্তু গাউরের কিছুতেই ঘুম আসেনা। গাউর ডার্ট গায়ে নিয়ে ঘুরতে থাকে। এক ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার ট্র্যাংকুইলাজিং কাজের মধ্যে একটা এই রকমের ঘটনা ঘটলে কত কী যে সহ্য করতে হয় বন-দপ্তরকে। অনেক কথা কু-কথা শুনেও নিলয় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাউরটিকে শেষ অবধি ট্র্যাংকুইলাইজ করতে পেরেছিল-তার জন্য সে পুরষ্কৃত হলেও তার জীবনহানির আশঙ্কা ছিল একশ শতাংশ। বিকাশ জানে- এখানে জমায়েত হাজার হাজার লোকজনের হয়তো কেউই জানে না ডার্ট থেকে কী ভাবে ঘুম পাড়ানি রাসায়নিক গাউরের শরীরে ঢুকবে। মানুষের শরীরে যে ভাবে ইঞ্জেকশন থেকে ঔষুধ ঢোকে সেই রকম ভাবে গাউরে শরীরে রাসায়নিক ঢোকানোর জন্য কেউতো গাউরের পাশে থাকে না। তা হলে কি ভাবে ঘুম পাড়ানি রাসায়নিক গাউরের শরীরে ঢুকবে। এখানেই সিরিঞ্জ চার্জারের ভূমিকা। ডার্ট যখন কোন বন্য প্রাণের গা’য়ে সঠিক ভাবে আঘাত করে এবং নিডিলটি বন্যপ্রাণীর শরীরে ঢোকে তখন বন্যপ্রাণীর শরীর থেকে যে বিপরীত ধাক্কার সৃষ্টি হয় তাতে প্লাঞ্জারের পিছনের দিকের পিন স্টেবিলাইজারে আঘাত করে ফেটে যায় এবং গ্যাস সৃষ্টি করে। এই গ্যাস প্লাঞ্জারকে সামনের দিকে ঠেলতে থাকে। এই ঠেলাতেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে রাসায়নিক বন্যপ্রাণীর শরীরে ঢুকে যায়। যদি এই সিরিঞ্জ চার্জার না ফাটে, বন্যপ্রাণীর শরীরে ডার্ট গেঁথে গেলেও রাসায়নিক শরীরে ঢুকবে না। সেই দিন এই বিপত্তি হয়েছিল। বিকাশ ভাবে, ডার্টের এই সূক্ষ্ম কারিগরি বিজ্ঞান আমরা কতজন জানি! শালসিঁড়ি যে বহুস্তরীয় সাম্রাজ্য বিস্তার করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে তার সব সূক্ষ্ম বাস্তুতন্ত্রীয় বিজ্ঞান আমরা কতটুকু জানি বা বুঝি। এই অজানার জন্য কত কষ্ট কত বিভেদ এবং কত দ্বন্দ্ব। প্রাণ যায় কত প্রাণের।
বিকাশ বলে – নিলয় চল। আর দেরি নয়।
বিকাশ ফিল্ডে থাকলে সব কাজে সামনের থেকে নেতৃত্ব দেয়। বিকাশ, নিলয়, নিলয়ের সহকারী- তাপস এবং দুই বন্দুকধারী- সুনীল ও সমর বাঁশঝাড়ের দিকে রওনা দেয়। ওদের বাঁশঝাড়ের দিকে যেতে দেখে, বাঁশঝাড় থেকে কিছুটা সরে আসা লোকজন আবার হৈ হৈ করে ওদের পিছু নেয়। শুরু হয় আবার বিশৃঙ্খলা- ঠেলাঠেলি। সেই ধাক্কায় নির্মল বাবু পড়ে যায় মাটিতে। সেই দেখে ওঠে প্রচণ্ড হাসির রোল। বিকাশ বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছন ফিরে দ্রুত ছুটে যায় নির্মল বাবুর কাছে। বিকাশকে অনুসরণ করে অন্য সব স্টাফরা। ঐ দেখে ছুটে আসে মাস্টার আর তার সাঙ্গপাঙ্গ। হঠাৎ যেন সমুদ্র স্থির যয়ে যায়।
বিকাশ মেঘের গর্জনে বলে- আপনারা যদি এক জায়গায় স্থির ভাবে না থাকতে পারেন তাহলে আমরা এখানে স্থির দাঁড়িয়ে থাকবো। তাতে যা হবার হবে। বিকাশ জানে কিছু কিছু আগুনকে আগুন দিয়েই নিবাতে হয়। তাই এখন ওকে রুদ্র মূর্তি ধরতে হবে।
মাস্টার মশাই বলে- না না, আপনারা যান। আমরা এখানে আছি।
বিকাশ গম্ভীর গলায় বলে- সেটা হলেই ভাল। না হলে আমাদের সাথে আপনাদেরও সারা রাত দুঃখ আছে।
মাস্টারমশাই বলে – ঠিক আছে। ঠিক আছে।
বিকাশরা এগিয়ে যায় বাঁশঝাড়ের দিকে- ঘর ছাড়া এক প্রাণের খোঁজে… বন্যপ্রাণকে তার ঘরে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴