10.লে পাঙ্গা-১০/শুভ্রজ্যোতি দাস
9.লে পাঙ্গা-৯/শুভ্রজ্যোতি দাস
8.লে পাঙ্গা-৮/শুভ্রজ্যোতি দাস
7.লে পাঙ্গা-৭/শুভ্রজ্যোতি দাস
6.লে পাঙ্গা-৬/শুভ্রজ্যোতি দাস
5.লে পাঙ্গা-৫/শুভ্রজ্যোতি দাস
4.লে পাঙ্গা-৪/শুভ্রজ্যোতি দাস
3.লে পাঙ্গা-৩/শুভ্রজ্যোতি দাস
2.লে পাঙ্গা-১/শুভ্রজ্যোতি দাস
1.লে পাঙ্গা-১/শুভ্রজ্যোতি দাস
লে পাঙ্গা/১০
শুভ্রজ্যোতি দাস
এক পলকের একটু দেখা
পরদিনই স্কুলের কয়জন টিফিনের পর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল হরিহরের খোঁজে। শুভাশিসদা বলছিলেন ঘাটপাড়া গ্রামে নাকি ওদের বাড়ি। বীরনগর গ্রামের উত্তর সীমানায় বেহুলা নদী। নদী পেরিয়েই দেউপাড়া - সুবীরের গ্রাম। দেউপাড়ার পূবদিকের গ্রামটাই ঘাটপাড়া। এদিকের বেশিরভাগ গ্রামের নামই হয় পাড়া নয় বাড়ি দিয়ে। গোঁসাই পাড়া, মানিকপাড়া, পলাশবাড়ি, কলাইবাড়ি.......।
ভালোই দূরে গ্রামটা। আধ ঘন্টার ওপর সাইকেল চালানো হয়ে গেছে। সুবীরের গ্রাম পেরিয়ে ঘাটপাড়ায় পৌঁছেছে ওরা। এবারে বাড়িটার খোঁজ করতে হয়। পথে তিন রাস্তার মাথায় একটা বট গাছ পড়ল। গাছটার চারপাশ ঘিরে বেদী বানান। পাশে বেতের তৈরি ছোট্ট একটা মন্দির। ফুটচারেক উঁচু ,আড়ে বহরে মেরে কেটে পাঁচফুট মত হবে। ভেতরে শুধু একটা সিন্দুর লেপা কালো পাথর মাটিতে পোঁতা। ওই বটগাছের পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। গাছটার বেদিতে একজন বয়স্ক লোক বসেছিল। চিমসে চেহারা, চুলের আধিক্য দিয়ে চেহারার দৈন্য ঢাকার চেষ্টা। লম্বা চুল, দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল। সাইকেল থামিয়ে শুভাশিস দা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন -"আচ্ছা, এখানে হরিচরণ হরচরণের বাড়িটা কোন দিকে?"
-"মানে হরিহরের খোঁজ করছেন? কাবাডি খেলত?" ওনার গলা শুনে মিহির থতমত খেল। ওই চিমসে চেহারায় এমন জলদ গম্ভীর নাদ আশা করেনি।
-"হ্যাঁ, হ্যাঁ ওনাদের বাড়িটাই খুঁজছি।"
-"হরি মারা গেছে দু বছর হল।"
-"আর হরচরণ? উনি আছেন তো?" দিলীপদা শঙ্কিত।
লোকটা বেদী থেকে নেমে এল। বট গাছের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ওই যে বাঁশ ঝাড় দেখতে পাচ্ছেন। তার ডান দিকে রাস্তা চলে গেছে। ওই রাস্তায় যাবেন না। সোজা চলতে থাকবেন। কিছুদূর গিয়ে একটা কালী মন্দির পাবেন। সেখান থেকে আর একটু এগিয়ে এবারে বাঁ হাতে আর একটা রাস্তা পাবেন।"
-"ওই রাস্তায় হরচরনের বাড়ি তাই তো?" - শুভাশিসদা ব্যস্ততা দেখায়।
-"না, ওই রাস্তায় গেলে আমার বাড়ি। সোজা চলতে থাকবেন। একটা বেড়া ঘেরা বাড়ি পড়বে। গেটের দুপাশে দুটো বড় বড় বেলি ফুলের গাছ।"
-"সেখান থেকেও সোজা চলতে থাকব, তাই তো"। শুভাশিসদার গলায় হতাশা স্পষ্ট।
-"সোজা যাবেন মানে? হরচরণের বাড়ি খুঁজছেন না? ওটাই তো হরচরনের বাড়ি।" লোকটি খ্যাক খ্যাক করে হেসে আবার বেদিতে গিয়ে বসল।
মিহির বেশ কৌতুক বোধ করছিল –“লোকটা বেশ মজার তো! চেহারা, কথার ধরণ, হাবভাব, আর ওই ব্যারিটোন - সব মিলে বিনোদনের একটা কমপ্লিট প্যাকেজ!”
লোকটার দেখান রাস্তায় সাইকেল চলল। শুভাশিসদা কিছু একটা ভাবছিলেন। হঠাৎ, যেন জটিল সমস্যা সমাধান করে ফেলেছেন এমন ভাবে বলে উঠলেন -"আরে, ওটা তো সদানন্দ বৈরাগী! আরে, দিলীপ ওই যে রে , যাত্রা করত না?" বলেই "সদানন্দদা , ও সদা দা" - ডাকতে ডাকতে সাইকেল ফেলে থপ থপ করে দৌড়তে লাগলেন বটগাছের দিকে। শুভাশিসদাকে এই প্রথম দৌড়তে দেখল মিহির। ওজন অনুপাতে গতি মন্দ না! দিলীপদা দৃশ্যতই বিরক্ত -"হল, এবার একঘন্টা এখানে খেজুরে আলাপ করবে। ও থাক, আমরা এগোই চল। দেরি হয়ে যাবে।"
হরচরণবাবুর বাড়িটা এই অঞ্চলের রীতি মেনেই তৈরি। তবে ঘরগুলো পাকা। অবস্থা কিছুটা স্বচ্ছল বোঝা যায়। উঠোনে বসার জন্য দুটো বেঞ্চি বের করা হল। হরচরণবাবু দাওয়ায় ছোট খাটিয়ায় বসে আছেন। চুলের পাক দেখে বয়স কিছুটা অনুমান করা যায়। তবে চামড়ায় একটুও ভাঁজ পড়েনি। চাবুকের মতো পাকানো চেহারা। বৃষস্কন্ধ শালপ্রাঙ্গশুবৎ। দুটো একথা সেকথার পর দিলীপদা প্রসঙ্গে ঢুকতে চাইলেন -"আমরা আসলে এসেছি বীর নগর হাইস্কুল....।" দিলীপদার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে শুভাশিসদা ভেতরে এসেই -"আআ রে হরদা, কেমন আছিস বল। ছোটবেলায় চাঁদনীর মেলায় তোদের খেলা কতবার দেখতে গিয়েছি । সেই যে সেবার কলকাতা থেকে এক ধরুয়া আর এক মারুয়া নিয়ে এসেছিল ............ । " এরপর ক্রমে শুভাশিসদা বউ বাচ্চা, গাই বাছুর, খেত খামার, বৃষ্টি বাদল ... আলাপ জুড়ে দিল। হরবাবুও দিব্যি জমিয়ে গল্প করছেন। বাকিরা ব্রাত্য হয়ে চুপচাপ শুনতে লাগল। একফাঁকে চা এসেছিল। চা খাওয়াও শেষ। শুভাশিসদা ভর্তি কাপটা মুখের সামনে ধরে অনর্গল গল্প করে যাচ্ছেন। একবারও চুমুক দেননি। নিতাই-এর চা বহুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। খালি কাপেই কয়েকবার চুমুক দিল। দিলীপদার ধৈর্য তলানিতে। অসহায়ের মতো মিহিরের দিকে তাকালেন একবার। মিহির চোখের ইঙ্গিতে শুভাশিসদাকে থামাতে বলল। দিলীপদা গলা খাঁকারী দিয়ে বললেন -"শুভাশিসদা, ইয়ে মানে স্কুলের কথাটা এবার একটু.... ।" যেন খুব জরুরি কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভাবে শুভাশিসদা বললেন -"ও হ্যাঁ। আরে হরদা শোন না, এবার না আমাদের স্কুলে ছাত্রদের কাবাডি দল তৈরি হবে বুঝলি। কিন্তু মুস্কিল হল কি আশেপাশে খেলা জানা লোক তো নাই। তোর কথা তখন মনে পড়ল। গুরু ছাড়া তো বিদ্যা হয় না। তো তুই যদি ছেলেদের একটু দেখিয়ে টেখিয়ে ..।"
এরপর যা ঘটল তার জন্য মিহিরের মন একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। শুভাশিসদা কথাটা শেষও করতে পারেননি, তার আগেই দ্যাখেন হরচরণবাবুর নিচের ঠোঁটটা থরথর করে কাঁপছে! মুহূর্তে ওনার চোখ জলে ভরে গেল! শুভাশিসদার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন -"নিশ্চয় শেখাব। ওই বিদ্যা বুকে ধরে বসে আছি। কাউকে দিতে পারিনি। খেলাটাই একদিন উঠে গেল। কাকে শেখাব?" আর কিছু বলতে পারলেন না। চোখের জল বাঁধ ভেঙেছে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। শুভাশিসদা ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন।
এমন সময়েই বেড়া ঠেলে সাইকেল নিয়ে এক তরুণী বাড়িতে ঢুকল। সবাইকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সুন্দরী নয়, তবে ভারী মিষ্টি মুখটা। দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। হরচরণবাবু মেয়েকে দেখে ভাষা খুঁজে পেলেন -"আমার মেয়ে - রচনা। এ বছর বি এ পাস দিয়েছে। ইউনিভার্সিটি যাবে এবার। রচনা সাইকেলটা বেড়ায় ঠেস দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। তারপর দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল। হরচরণ বাবু মেয়েকে ডাক দিলেন -"মা, এখানে চা দিয়ে যাস তো।"
যাক, নিতাইকে আর ফাঁকা কাপে চুমুক দিতে হবে না। একটু পরেই রচনা চা নিয়ে এল। মিহির ওকে জিজ্ঞেস করলো -"কি নিয়ে পড়েছ?"
মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ -"ভূগোল নিয়ে। সাথে সোসিওলজি আর হিস্ট্রি।" দিলীপদাও চা নিতে নিতে দুএকটা কথা বললেন। মেয়েটির সাথে কথা বলতেও ভালো লাগে। সব কথার জবাব সুন্দর হেসে হেসে দেয়। মিহির লক্ষ্য করলো - সুবীর মাথা নিচু করে আড়ষ্ঠ হয়ে চায়ের কাপটা নিল। পাত্র দেখতে এলেও বোধহয় মেয়েরা এত আড়ষ্ট থাকে না। এসব ব্যাপার শুভাশিসদার নজর এড়ানোর কথা না। মিহির তাকিয়ে দ্যাখে - শুভাশিসদা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে সেই বিখ্যাত হাসিটা।
আরো কিছুক্ষণ ওখানে গল্প চলল। বেলা পড়ে আসছে দেখে দিলীপদা উঠতে চাইলেন -"শুভাশিসদা এবারে যেতে হয় যে।"
-"ও হ্যাঁ তাই তো। অনেক বেলা হল। হরদা তাহলে উঠি আজকে।" হরচরণবাবুর মুখ দেখে মনে হল আমাদের ছাড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ওনার নেই।
-"ও ভাল কথা। হরদা তোর কোনও ফোন নম্বর আছে রে? তাহলে সুবিধা হত। কবে আসতে হবে না হবে তোর সাথে ফোনেই আলাপ করে নিতাম।"
হরচরণবাবু মেয়েকে হাঁক পাড়লেন -"মা, আমাদের ফোন নম্বরটা স্যারদের দিয়ে যা তো।"
শুভাশিসদা হঠাৎ উঠে পড়লেন -" চল দিলীপ। সুবীর, ফোন নম্বরটা নিয়ে নে।"
উফ্ এই লোকটা একটা বিষবিচ্ছু!
হরচরণবাবুর বাড়ি ছেড়ে সদানন্দ বৈরাগীর বাড়ির মোড় পর্যন্ত ওরা পৌঁছেছে - পেছন থেকে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে রচনা ওদের কাছে এসে থামল -"আপনার পেনটা, ভুলে ফেলে এসেছিলেন।" সুবীর তড়িঘড়ি পেনটা নিয়ে পকেটে পুরল। মেয়েটা যত দ্রুত এসেছিল, ততটাই দ্রুত বেগে ফিরে গেল।
রাস্তা খুব চওড়া নয়। দুজন পাশাপাশি সাইকেল চালানো যেতে পারে। সবার সামনে সুবীর, মাঝে দিলীপদা আর নিতাই, আর শেষে মিহির আর শুভাশিসদা। শুভাশিস দা গুনগুন করে গান করছেন - এক পলকের একটু দেখা, আরো একটু বেশি হলে......। এতটাও জোরে নয়, যে আশেপাশের লোক শুনবে, আবার এতটাও আস্তে নয়, যে সুবীর শুনতে পাবে না। বট গাছ পার হতেই শুভাশিসদা শুরু করলেন -"দিলীপ, মেয়েটা বেশ না? কেমন লক্ষীমন্ত মেয়ে।"
দিলীপদার হয়ে নিতাই জবাব দিল -"হ্যাঁ, লেখা পড়াতেও ভালো। জিওগ্রাফি নিয়ে পড়ে। ভূগোল পাইনি বলেই তো আমি পল সায়েন্স নিয়ে পড়েছি।"
-"সুবীর? মেয়েটা পছন্দ? চাইলে হরদার সাথে কথা বলতে পারি।"
-"ধূর স্যার, কি যে বলেন।" দুর্ভাগ্য, সুবীরের মুখটা দেখা যাচ্ছে না।
শুভাশিসদার গানে নতুন চারটা শব্দ যোগ হল - এক পলকের একটু দেখা/ধুর স্যার কিযে বলেন/ক্ষতি কি?/ যদি কাটে প্রহর/ কিযে বলেন/ মনের দুটো / ধুর স্যার/ ক্ষতি কি? এই কটা মাত্র লাইন শুভাশিসদা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান সুরে সারা রাস্তা গাইতে গাইতে চললেন।
আক্ষেপ একটাই - অস্তগামী সূর্যের শেষ মায়াবী আলোটা সুবীরের মুখে পড়ে যে বর্ণালিটা তৈরি করল – সেটা কারোর দেখা হল না।