মায়াপথের মীড়-১০/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়/১০
সৌগত ভট্টাচার্য
জলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়ি যাওয়ার পথে কাশিয়াবাড়িতে রাস্তার ধারে একটা বড় হাউসিং কমপ্লেক্স, একশর মত পরিবার, কমবেশি পাঁচশ বাসিন্দা। প্রতিটা বিল্ডিংয়ে আটটি করে ফ্ল্যাট। কমপ্লেক্সের মাঝে বিরাট একটা মাঠ। আসলে মাঠটা অন্য হাউজিং কমপ্লেক্সের মাঠের মত না! আসলে আমাদের চোখ বা ধারনায় যেমন হাউজিং কমপ্লেক্স বা সোসাইটির মাঠ দেখতে হয় ঠিক সেরকম না।
বিরাট এই মাঠের মধ্যে বেশ কয়েকটা গোয়াল, গরুগুলো হেমন্তের রোদে জাবর কাটছে, মাঠ জুড়ে বিরাট বিরাট খড়ের গাদা, কেউ গরু খাওয়াচ্ছে। প্রায় প্রতিটা ফ্ল্যাটের সামনে খুঁটে গরু বাঁধা, ব্যালকনি থেকে মাছ ধরার বিরাট জাল ঝুলছে, সদ্য জল ঝড়া জালের গায়ে সূর্য এসে পড়ছে। ফ্ল্যাটের ঘরের সাথে লাগোয়া মাচায় লাউ ধরেছে, অন্য একটা মাচায় পুঁইগাছ উঠেছে। মাঠ জুড়ে ঘুঁটে শুকোচ্ছে ডালের বড়িও শুকোচ্ছে। প্রতিটা ফ্ল্যাটের সামনে একটা করে মাটি লেপা তুলসীতলা। মাঠের একপাশে মাটির মেঝে টিনের ঘরে বিষহরির থান,পাশ দিয়ে একটা কুলগাছ উঠেছে। ঘাস কেটে সাইকেলের পিছনে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরছেন একজন, যেমন গ্রামে ফিরতেন। কেউ টোটো চালিয়ে বাড়ি ফিরছে। মাঠের মাঝে সিমেন্টের কয়েকটা বেঞ্চ, রঙিন জামা কাপড় শুকাচ্ছে। কমপ্লেক্সের ভেতরের রাস্তায় জায়গায় প্রচুর জ্বালানি খড়ি স্তূপ করে রাখা। নিরঞ্জন মণ্ডলের ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরে মুদি দোকান, যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছোট্ট পড়ার দোকানটা কী ভাবে যেন ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে উঠে এসেছে!
২০১৫ সালে ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় হয়। বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ভারতীয় ছিট মহলের বাসিন্দারা ভিটামাটি ছেড়ে চলে এল ভারতের মূল ভুখন্ডে।চারপাশে বাংলাদেশ আর মাঝে দ্বীপের মত ভেসে থাকা ভারতীয় ভূখণ্ড, এই তো ছিটমহল। ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের গ্রাম হল বাংলাদেশের ছিটমহল। এই ছিটমহলগুলোই তো বিনিময় হয়েছে ২০১৫ সালে। পঞ্চগড়ের জেলায় থাকা ছয়টি ছিটমহলের বাসিন্দারা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে কাশিয়াবাড়ির "পার্মানেন্ট রিহ্যাবিলিটেশন শেল্টার", অর্থাৎ এই ফ্ল্যাট, হাউজিং কমপ্লেক্সে উঠল। এই ফ্ল্যাটগুলো হয়ে উঠল নিজেদের বাড়ি।
"পার্মানেন্ট রিহ্যাবিলিটেশন ক্লাস্টার" লেখা গেট দিয়ে বেরোনোর সময় গেটের বাইরে পবিত্র বিশ্বাস টোটো সারাইয়ের দোকান খুলেছে। দোকানের নাম
"বজরঙ্গবলি টোটো রিপেয়ারিং":
"ছিটমহল", হলদিবাড়ি, জেলা: কোচবিহার।
এই কমপ্লেক্সের সবাই ছিল পঞ্চগড়ে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দা। ছিটমহল ছেড়ে আসা মানুষ, ছিটমহলের আকাশ ছেড়ে আসা মানুষজন, আর কখনও জন্মভিটায় ফিরে যাবে না। তাই হয়ত হাউসিং কমপেক্সের মাঠটাকে অবিকল পঞ্চগড়ের ছিটমহলের আদলে একটা গ্রাম বানিয়ে তোলে, ফেলে আসা স্মৃতি আর মায়া দিয়ে ঘেরা গ্রাম।
কার্তিক মাসে সন্ধ্যা নামলে কমপ্লেক্সের প্রতিটা ফ্ল্যাটের ছাদের ওপর আকাশ প্রদীপ জ্বালানো হয়। যে আকাশ প্রদীপ পঞ্চগড়ের ছিট মহলের দিকে তাকিয়ে থাকে ... অন্ধকারে সলতে হয়ে জন্ম ভিটার দিকে তাকিয়ে জ্বলে থাকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴