ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/১০
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১০)
মৈনাক ভট্টাচার্য
------------------------------------
গোপেশ্বর পালের ভাস্কর্য ঃ বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ
গঙ্গার ধারে স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নের বেলুড় মঠ তৈরি হবে। স্বামীজীর বড় সাধ মন্দিরে থাকবে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ছোঁয়া। এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে আসরে নেমে পড়লেন ঠাকুর রামকৃষ্ণের আরেক প্রিয় শিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ, যিনি সন্ন্যাস গ্রহণের আগে পেশাগত ভাবে ছিলেন বাস্তুকার। ভবিষ্যৎ ভাবনার চিত্রকল্পে তাই তিনি বেলুড় মঠকে রূপ দিলেন বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম এবং হিন্দু ধর্ম ভাবধারার সমন্বয়ে এক অত্যাধুনিক স্থাপত্যের নকশায়। ঠিক হল, স্থাপত্যের সাথে মানানসই ঠাকুরেরও এমনই এক অত্যাশ্চর্য মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই মন্দিরে। ততদিনে কৃষ্ণনগর, ঘূর্ণির প্রতিমা শিল্পী গোপেশ্বর পাল এক পরিচিত নাম। প্রচলিত পুতুল ভাবনাকে তিনি ভাস্কর্যের উত্তরণে ইতিহাসের এক পথ প্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। গোপেশ্বরই যে এই ব্যাপারে ভারতবর্ষে একমাত্র শিল্পী। ততদিনে তিনি দুর্গা প্রতিমার প্রচলিত ফর্ম ভাঙ্গার মত বৈপ্লবিক নানান কাজ ভারতবর্ষে প্রথম করেও দেখিয়েছেন। প্রতিমা বিগ্রহের ভেতর সব সময় পরিব্যাপ্ত থাকে পরম্পরায় বয়ে নিয়ে যাওয়া এক ধরনের প্রচলিত বিশ্বাস। অন্ধবিশ্বাসে যার বিচ্যুতি ঘটলেই অনিবার্য অকল্যাণ। সাথে এই অন্ধবিশ্বাস আগলে রেখে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার বাসনায় ফেউ ধরা থাকে অসৎ কিছু লোকের। সময়ের বিচারে এই কাজ তাই কিন্তু খুব সহজ ছিলনা। গোপেশ্বর আর দশজন নিছক কৃষ্ণনগর ঘরানার পুতুলশিল্পী মোটেই নয়, সে বরাবরই ডাকাবুকো স্বভাবের মানুষ। খুব ভাল বোঝেন পুতুল আর ভাস্কর্যের প্রভেদ।
# # #
পুতুল এবং ভাস্কর্য কোন কালেই অবশ্য এক নয়। বরং বলা যায় সম্পর্কটা দুই রকম। পুতুলের মাধুর্য থাকলেও, প্রচলিত পদ্ধতিতে একই রকম মূর্তি অনেক পরিমাণে তৈরির একটা সহজিকরণকে পুতুল বলা যেতে পারে। কোন সন্দেহ নেই ভাল পুতুল তৈরির জন্য ভাল কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন। কখনও কখনও এই দক্ষতার উত্তরণে নিজের ঘরানা থেকে পুতুল বেরিয়েও আসে, তখন সেই পুতুলই আর্টের আধার গুণে ভাস্কর্যে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। পুতুলও যে একটা শিল্প এই ব্যাপারে অবশ্যই সন্দেহের কোন অবকাশ নেই । এটাও সত্যি কথা পুতুল যতক্ষণ পুতুল থাকে তার মাধুর্য ভাস্কর্য কোন দিনই গ্রহণ করতে পারেনা, কেননা একটা সৎ ভাস্কর্য সব সময় একক একটা চরিত্র তৈরী করতে পারে। সময়ের কথা বলতে পারে। একটা পুতুল সেটা পারেনা। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা একটু স্পষ্ট হবে হয়ত। — মাথা সর্বস্ব পোষাকহীন গর্ভবতী এক মেয়ের রূপে বালজাকের পুরুষ ভাস্কর্য গড়লেন ফরাসী ভাস্কর রদ্যাঁ, লোকের চিৎকার আর প্রতিবাদে পরে সে মূর্তিকে পরিয়ে দিতে হল বাথরোব(বাথ গাউন)। কিন্তু স্ফীত উদর রেখেই দিলেন। সেখানে কোন সমঝোতা করলেন না। শুধু রদ্যাঁ নয়, ফরাসি ইতিহাসই তো বলে বালজাকের গর্ভেই জন্ম নিয়েছে আধুনিক ফরাসি উপন্যাস। এই রকম একটা মূর্তির সামনে দাঁড়ালে যখন মূর্তির ভেতর থেকে ভাষা বেরিয়ে আসে, সেটাই ভাস্কর্য। সহজ ভাবে বললে ভাস্কর্যের নিজস্ব একটা ভাষা থাকে, কৃষ্টি থাকে। ভাস্কর্য সর্বদাই নিজস্ব সৃষ্টির সময়কে আগলে থাকে।
# # #
১৯৩৮এর ঘটনা। কুমোরটুলি সর্বজনীনের গত পাঁচ ছয় বছর থেকে বরাত বাঁধা শিল্পী গোপেশ্বর পালের। সেবারেও তিনি প্রতিমা বানিয়েছেন। ততদিনে প্রচলিত মৃন্ময়ী প্রতিমার চোখের আদল বদল করে চিন্ময়ী চক্ষুদানের মতো পরিবর্তনও করে ফেলেছেন শিল্পী। মূর্তির ফর্ম ভাঙ্গার জন্য তাঁর হাত সব সময় যেন নিশপিশ করে। বাধা একটাই, বেশী কিছু পরিবর্তন একসাথে করতে গেলে পাছে প্রাচীনপন্থীদের রোষানলে পড়তে হয়। তাতে যে তাঁর পেটে-ভাতেই টান পড়বে। কুমোরটুলি সর্বজনীন পুজোর প্রতিমা তখন এসে গেছেন মন্ডপে, কিন্তু এক দুর্ঘটনায় পঞ্চমীতে আগুনে ভস্মীভূত হল মূর্তি। উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। রাত পোহালেই যে বোধন। শিল্পীর কাছে মুশকিল আসানের জন্য ছুটে এলেন স্বয়ং সভাপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। খুব দ্রুত কাজ করতে পারতেন গোপেশ্বর। গোপেশ্বরের কাজের প্রতি অদ্ভুত আনুগত্যের সব খবরই তখন নেতাজীর জানা। নেতাজী এটাও জানতেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের উদ্যোগে ১৯২৪ সালে এক শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে গোপেশ্বর পাড়ি দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। সঙ্গে জাহাজে ছিল আর বিশেষ কিছু নয়, তাঁর শিল্পচর্চার প্রধান উপকরণ – দু ব্যারেল ভর্তি গঙ্গামাটি। ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে কুকুর, ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে ছুটন্ত ঘোড়া এবং তাদের সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি - এমন সব একটার পর একটা কাজ করে বিদেশের মাটিতে দেখিয়ে দিয়েছিলেন দেশের মাটির ভেল্কি। প্রদর্শনীতে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এসে বিস্মিত হয়েছিলেন শিল্পীর কেরামতিতে। ‘ডিউক অফ্ কন্নট্’- এর কানেও পৌঁছেছিল এই বিস্ময়-যুবকের কথা। তিনিও প্রথমে মানতে চাননি সেই “অসম্ভব” প্রতিভার কথা। পাঁচ মিনিটের সিটিং, তাতেই তাঁর নিখুঁত অবয়ব ফুটে উঠলো গোপেশ্বরের হাতে। তিনি মেনে নিলেন-এই ছেলে সত্যিই মূর্তির জাদুকর। লন্ডনের নানান কাগজে উঠে এল গোপেশ্বরের দুরন্ত প্রতিভা সমন্বিত সেই সংবাদ। গোপেশ্বর অভিহিত হলেন ‘বিশ্ময় ভাস্কর’ হিসেবে। পারলে গোপেশ্বরই পারবে এক রাতে এই কাজ করতে। হাতে আর কোন রাস্তাও নেই; তাই নেতাজী ছুটে এসেছেন গোপেশ্বরের কাছে ‘যে করেই হোক, একদিনের মধ্যেই নতুন প্রতিমা গড়ে দিতে হবে’। এক রাতে একটা দূর্গা পরিবার - এ অসম্ভব ব্যাপার। নেতাজী নিজে এসেছেন বলেও কথা। গোপেশ্বরও তাই নিরুপায়, কিছু যে করতেই হয়। হাত লাগালেন বটে, বুঝতে পারছিলেন এক চালায় এত দ্রুত সম্ভব নয় । একটু অন্যরকম কিছু ভাবতে শুরু করলেন। সহকারীদের একেক জনকে দায়িত্ব দিলেন এক একটা মূর্তি গড়বার। তদারকি করলেন গোপেশ্বর নিজে। এক রাতে গড়ে তুললেন দুর্গা সহ লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ তাঁর চার ছেলেমেয়ের মূর্তি। প্রতিটিই আলাদা আলাদা ভাবে। সবই ঠিক আছে কিন্তু একসঙ্গে একচালায় যে বড্ড বেমানান ঠেকছে। ঠিক করে ফেললেন সব মূর্তিকেই আলাদা আলাদা ভাবে উপস্থাপন করবেন মণ্ডপে। পাঁচটি আলাদা চালায় নিয়ে এলেন দুর্গা পরিবার। শুরু হল দুর্গা মূর্তির নতুন ইতিহাস – একচালা থেকে পাঁচচালায় বিবর্তন।
শেষ পর্যন্ত মানুষ কিন্তু মেনেও নিলেন সেদিনের এই যাত্রা যা কিনা সময়ের সাথে আজও বয়ে নিয়ে চলেছেন মা দুর্গার আদলে শিল্পী বাঁধন দাস-সুনীল পাল হয়ে এই প্রজন্মের সনাতন দিন্দারা।
সে যাই হোক খুব স্বাভাবিক ভাবেই গোপেশ্বর পালের ডাক এলো বেলুড় মঠ থেকে। এমন একটা মন্দিরে মানানসই ঠাকুর রামকৃষ্ণের মূর্তি তৈরির যোগ্য শিল্পী তো তিঁনিই। গোপেশ্বর বেছে নিলেন ইতালিয়ান মার্বেলের চাঁই। আস্তে আস্তে গোটা পাথর থেকে ছেনি হাতুড়ির শিল্পে রূপ পেল ধ্যানভাবে শান্ত সমাহিত রামকৃষ্ণ মূর্তি।
বেলুড়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণের এই মূর্তিতে ভক্তদের ভেতর জীবন্ত হয়ে আছেন ঠাকুর তাঁর ভাব সমাধিতে। যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরাই জানেন অদ্ভুত এক মায়া মাখা আছে এই মূর্তি জুড়ে। কথিত আছে এই মূর্তি তৈরির পর রামকৃষ্ণের পরিচিত প্রায় অন্ধ এক ব্যক্তি মন্দিরে এসে মূর্তির আদলে হাত দিয়ে আঁতকে উঠেছিলেন ‘এ কী! এ যে আমাদের গদাই...।‘ এখান থেকেই তো আলাদা হয়ে যায় একটা পুতুল আর একটা ভাস্কর্য। কেননা হৃদয় দিয়ে না দেখতে জানলে একটা চরিত্রকে ধরা যায়না। কালজয়ী শিল্পীরা বার বার নানা ভাবে সেটাই তো প্রমাণ করে গেছেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴