বেতগুড়ি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
বেতগুড়ি চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^
আজকের সফর বেতগুড়ি। পশ্চিম ডামডিমে তারকদার রিসর্টে রাত্রিযাপন করে এলাম ডামডিমে। ডামডিম গ্রাম পঞ্চায়েত, পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে ডামডিম বৌদ্ধমন্দির ছুঁয়ে কুমলাই টি গার্ডেন ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে চলে এলাম বেতগুড়ি টি গার্ডেনে। ডায়না টি কোম্পাণী লিমিটেডের বাগান বেতগুড়ি। ডামডিম থেকে আট কিমি। লাটাগুড়ি থেকেও আসা যায় নেওড়া মোড় হয়ে। লাটাগুড়ি-রাজাডাঙ্গা-মালবাজার রোড হয়ে ৪ কিমি দূরে অ্যামালগামেটেড প্ল্যান্টেশনের নেওড়া নদী চা বাগান। সেখান থেকে ১৩
কিমি। ৩০ মিনিট লাগে। নেওড়া মোড় বাস স্টপ থেকে লাটাগুড়ি ফরেস্ট রিট্রিট হয়ে নেওড়া ব্রিজ পেড়িয়ে নেওড়া পোস্ট অফিস হয়ে নেওড়া নুদী চা বাগান এবং ফ্যাক্টরি। রাস্তাতে যেতে যেতে দেখলাম শুরু হয়ে গেছে চা বাগিচাগুলিতে পাতা তোলার পর্ব। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাগিচাগুলিতে আসতে শুরু করে দেবে ফার্স্ট ফ্লাশের চা। মোটামুটিভাবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চা পাতা তোলা শুরু হয়। সেই অনুযায়ী এ বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের প্রাক প্রস্তূতি শুরু হয়েছে বাগিচাগুলিতে পুজা অর্চনার মাধ্যমে। এই ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং লাগল আমার কাছে। বাগিচার পাতা তোলার আগে বাগিচাগুলির অনেকগুলিতেই পূজা অর্চনা দেওয়া হয় প্রকৃতিকে অনুকূল রাখার জন্য। হায়রে ডিজিটাল ইন্ডিয়া! এখনো আমাদের মন এবং মননে প্রকৃতি ভিতিকে কাটানোর জন্য পূজা পার্বণের প্রথা! যেতে যেতে ভাবছিলাম যতই আমরা আধুনিকতার বড়াই করি না কেন আমাদের অনেকের মন এবং মনন এখও সেই প্রাক আধুনিক যুগের সংস্কারের ধারা নিয়েই এগিয়ে চলছে। মরুক গে। ওগুলো নিয়ে মনোবিদরা গবেষনা করুক। আমি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে ডুয়ার্সের মাটির নির্যাস্টুকু তুলে আনি।
ডায়না টি কোম্পানি লিমিটেড বা ডিটিসিএল একটি শতাব্দী প্রাচীন কোম্পানি যেটি ১৯১১ সালে নিবন্ধিত হয় জলপাইগুড়ির নবাব পরিবারের হাত ধরে। নবাব গুলাম জব্বর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ডায়না টি কোম্পাণীর মালিক ছিলেন। ১৯৭৬ সালে কোম্পানিটি সিংহানিয়া পরিবার অধিগ্রহণ করে চা ব্যবসা পরিচালনার মূল লক্ষ্যে। ডায়না টি কোম্পাণী বা ডিটিসিএল ১৯৮৩ সালে ডানকানস থেকে আরও একটি চা-বাগান অধিগ্রহণ করে। এটিই হল বেতগুড়ি টি এস্টেট। দুটি চা বাগানই জলপাইগুড়িতে অবস্থিত। ডায়না গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রয়াত রাধেশ্যাম সিংহানিয়া একজন দূরদর্শী চা প্রেমিক ছিলেন। বাগানটিকে সেই অঞ্চলের অন্যতম সেরা বাগানে পরিণত করার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং তিনি পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলের অন্যতম সেরা বাগান হিসাবে তাঁর পরিচালিত চা বাগানগুলিকে পরিণত করার জন্য আপগ্রেডেশনের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। গুণমান, চা উৎপাদন এবং সর্বোত্তম রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে বর্তমানে ডায়না টি এস্টেটের মোট বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১০ লাখ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে ডায়না সিআইআই দ্বারা গুণমানসম্পন্ন সিটিসি চা উৎপাদনের জন্য মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতেছিল এবং ডায়না চা বাগান তরাই এবং ডুয়ার্সের ১৫০ টিরও বেশি বাগানের মধ্যে "ডুয়ার্সের রানী" হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ডানকান্স অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং বাজালোনি থেকে গুডহোপ টি এস্টেট এবং বেতগুড়ি টি এস্টেট অধিগ্রহণ করে ডিটিসিএল। তারপর থেকে ডিটিসিএল তার তিনটি এস্টেট থেকে বার্ষিক ৩.৫৪ মিলিয়ন কেজি কালো চা উত্পাদন করতে থাকে। কোম্পানি তার তত্বাবধানে চা বাগানগুলির একত্রীকরণ এবং আধুনিকীকরণের মাধ্যমে ব্যবসা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও কোম্পানি দেশীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য চা বাগান অধিগ্রহণের মাধ্যমে অজৈবভাবে তার বাগান ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে অগ্রসর হয়।
ডিবিআইটিএ এর সদস্য মালবাজার মহকুমার বেতগুড়ি টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী ডায়না টি কোম্পানি লিমিটেড এর অন্তর্গত বেতগুড়ি বাগানের ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৯ জন, সাব স্টাফ ১২৪ জন, করণিক ৯ জন এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১১ জন। এছাড়াও ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ১৮৪ জন। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৭০০ এর উপরে। বেতগুড়ি চা বাগানের আয়তন ১০৫৬.৮৩ হেক্টর এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ৬৫৭.৮৬ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১৯৮৮ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। বেতগুড়ি চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত চা ৫০ থেকে ৫৫ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা ১১ থেকে ১২ লাখ কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে সংগৃহীত এবং কেনা কাঁচা চা পাতায় প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য চা এর পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কেজি। তাই চা বাগিচার নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে গড়ে ১৩ থেকে ১৫ লাখ কেজি চা বছরে উৎপাদিত হয়। এই বাগানে উন্নত ইনঅর্গানিক সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। বাগানটির লিজ হোল্ডার ডায়না টি কোম্পানি লিমিটেড এবং বর্তমান লিজের সময়সীমা ২০২৫ সাল। মোট শ্রমিক আবাস ১০৬৯ টি এবং যেগুলিতে মোট শ্রমিক সংখ্যা ১৮৯৭ জন। শ্রম দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বেতগুড়ি চা বাগানে ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকা বাড়ির সংখ্যা ৭৮৩ টি। এখনো বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা ১৪২ যেগুলির মধ্যে আধা পাকা বাড়ির সংখ্যাই বেশি। সরকারি সহ অন্যান্য বাড়ির সংখ্যা মোট ১৪৪ যেগুলি বেশিরভাগই বৈদ্যুতিকীকরণ হয়ে গেছে। বেতগুড়ি টি গার্ডেনটি ব্যাংকের কাছে আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ নয় এবং যার ফলে বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে চা বিক্রি বাবদ আয়ের থেকে। বেতগুড়ি চা বাগানের লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার কর্মরত রয়েছেন। বাগিচায় হাসপাতাল এবং ডিসপেনসারি, ৭ টি মেল ওয়ার্ড, ফিমেল ওয়ার্ড, মেটারনিটি ওয়ার্ড, আইসোলেশন ওয়ার্ড, অ্যাম্বুলেন্স এবং ডাক্তার আছে। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা দুজন এবং নার্স এর সহযোগী মিডওয়াইফ সংখ্যা ও দুইজন। বাগিচায় স্বাস্থ্য সহযোগী আছেন একজন। মোট ক্রেশের সংখ্যা আটটি। বাৎসরিক বোনাসের শতকরা হার গড়ে কুড়ি শতাংশ। শ্রমিক সন্তানদের নেওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা হিসাবে একটি স্কুল বাস রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী মজুরি দেওয়া হয় এবং শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া থাকে না। জ্বালানি চপ্পল ছাতা কম্বল ইত্যাদিও নিয়মিত সরবরাহ করা হয়।
ডায়না টি কোম্পাণীর পরিচালন অধিকর্তা এবং ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ললিত কুমার সিংহানিয়া। ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পশ্চিমবঙ্গ আঞ্চলিক কমিটির সক্রিয় সদস্য কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং বাণিজ্যে স্নাতক সন্দীপ সিংহানিয়া ২২ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোম্পানির সাথে যুক্ত। তিনি চা বাগান এবং বিপণন ব্যবসার সমস্ত দিকগুলিতে যথেষ্ট জ্ঞান এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছেন। ডায়না চা বাগানের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তিনি নীতি, কৌশল পরিকল্পনা এবং পরিচালনা করেন। চা শিল্পে ব্যাপক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সরিতা সিংহানিয়া ১৯৯৬ সাল থেকে কোম্পানির সাথে যুক্ত এবং বিপনন বিভাগের সম্পূর্ণ সময়ের পরিচালক। তিনি কোম্পানির দৈনন্দিন ব্যবসা পরিচালনা এবং দেখাশোনা করেন। চা শিল্পে ৫০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হরিশ পারেখ বিশ্বের বৃহত্তম চা ব্রোকিং কোম্পানি জে টমাস এন্ড কোং প্রা. লিমিটেড এর চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি অনেক শীর্ষ চা উৎপাদনকারী কোম্পানির বিপণন উপদেষ্টা এবং গুণগত পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন এবং বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য চা কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন। স্বাধীন পরিচালক হিসাবে ২০০৫ সালে তিনি ডায়না টি কোম্পাণীর বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হন। ডায়না গ্রুপের প্রধান মহাব্যবস্থাপক এবং ডায়না চা বাগানের সুপারেন্টেন্ডিং সিনিয়ার ম্যানেজার সুদর্শন কুমার বাবল সাড়ে চার দশক ধরে চা শিল্পে রয়েছেন এবং ষোল বছর ধরে ডায়নাতে রয়েছেন। তাঁর অধীনে ডায়না চা বাগান ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে শিলিগুড়িতে সিআইআই দ্বারা আয়োজিত মর্যাদাপূর্ণ মানের চা উত্পাদন প্রতিযোগিতাতে জিতেছিল। তাঁর তত্বাবধানে বাগানটি কুইন এবং কিং অফ ডুয়ার্স পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। ২০২০ সালে কোম্পানিতে যোগদান করে কোম্পানির বেতগুড়ি টি এস্টেটের সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চা শিল্পে ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উজ্জল চন্দ্র রায়। ডুয়ার্স, দার্জিলিং এবং আসামের চা বাগানে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মিঃ রায়ের অর্থোডক্স এবং সিটিসি চা উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সহজ উঠোনের বন্ধু তথা পাঠকবর্গকে আজকের এই পর্বে লকডাউনের বাগিচা পরিক্রমার প্রেক্ষাপটে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আমার বিগত দিনগুলির অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই এই জন্যই যে অধিকাংশ তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম এই সমস্ত দিকপাল চা সাম্রাজ্যের অভিজ্ঞ মানুষজনের কাছ থেকে যাঁরা করোনাকালে বাগিচাতে যে লড়াই লড়েছিলেন সেই লড়াইয়ের সঙ্গে শ্বাপদসঙ্কুল অভয়ারণ্যে ব্রিটিশ প্ল্যান্টার্সরা যেভাবে গুণগত মানের চা এর জন্য অজস্র প্রতিকূলতা নিয়ে লড়াই চালিয়েছিল তার সঙ্গেই বুঝি তুলনীয়। আজকে বেতগুড়ি চা বাগিচার এই পর্বে আলোচনা করব শীতকালীন কাটিং এবং প্রুনিং এবং উত্তরের চা বাগিচার কিছু লুকিয়ে থাকা অকথিত ইতিহাস।চা আমরা সকলেই ভালোবাসি। কিন্তু ভালো এবং গুণমানে উন্নত চা উৎপাদন করাটা যে খুব সহজ কথা নয় সেটা আমরা কতজন জানি? এবারে শীত বিদায় নিতে চলেছে। ডুয়ার্স-তরাইয়ে শীতকালীন শুখা মরশুমে কাঁচা পাতা তোলার সময়সীমা ধার্য থাকে মোটামুটি ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত দুইমাস বাগিচা কাটিং, প্রুনিং, আপরুটিং এর জন্য বন্ধ থাকে। তাই বিজ্ঞানীদের মতামত ও রিপোর্ট নিয়ে চা শিল্পের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রত্যেক বছর শীতকালীন মরসুমে পাতা তোলা বন্ধে কড়া সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় চা পর্ষদ। শীতের সময় কাঁচা পাতা তোলা ও উৎপাদনের ওপর বিধিনিষেধ জারি করে তারা। টি বোর্ডের এই নির্দেশ জারির মূল কারণ ভরা মরশুমে উচ্চমানের উৎপাদন নিশ্চিত করা। কারণ শীতকালে নতুন কুঁড়ি মেলে না। ফলে এই সময় পাতা তোলা হলে রপ্তানির বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পাবলিক নোটিশে প্রত্যেক বছর টি বোর্ড বাগানগুলিকে জানিয়ে দেয় চা শিল্পের স্বার্থে নিকৃষ্টমানের পাতা তুলে উৎপাদন যাতে কোনভাবে না করা হয় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। টি বোর্ড পুরোনো চা গাছ উপড়ে ফেলা (আপরুটিং) থেকে শুরু করে নতুন গাছ রোপণের (নিউ প্ল্যান্টিং) জন্য অনুমতি প্রদান করে।
চা মহল সূত্রেই জেনেছি আপরুটিং বা নিউ প্ল্যান্টিং, ফ্যাক্টরির যন্ত্রপাতি কেনা সহ আরও কয়েকটি খাতে টি বোর্ড বাগানগুলিতে ভরতুকি দিয়ে থাকে। ওই ভরতুকির পরিমাণ মোট খরচের শতকরা ২৫ শতাংশ। হেক্টর পিছু আপরুটিং ও নিউ প্ল্যান্টিংয়ের জন্য ভরতুকি বাবদ একেকটি বাগান প্রায় ৩ লক্ষ টাকার মত পায়। উৎপাদনশীলতা ও কাঁচা পাতার গুণগত মান কমে যাওয়ার কারণেই পুরোনো গাছ উপড়ে ফেলে নতুন গাছ রোপণ অত্যন্ত জরুরি। ওই কাজে ১-২ বছরের দেরিও বাগানগুলির দীর্ঘকালীন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই আপরুটিং ও নিউ প্ল্যান্টিংয়ের জন্য ভরতুকি টি বোর্ড বন্ধ রেখেছিল বলে এর জেরে ডুয়ার্সের বহু চা বাগান সমস্যায় পড়ে। চা মালিকরা টি বোর্ডকে জানান আপরুটিং বা নিউ প্ল্যান্টিং এর অনুমতি না মেলার কারণে বাগানের ছায়াগাছও কাটা যাচ্ছে না। কারণ ওই ধরনের গাছ কাটার অনুমতি বন দপ্তর দিলেও তারা আগে নির্দিষ্ট সেকশনের চা গাছ আপরুটিং বা নিউ প্ল্যান্টেশনের জন্য টি বোর্ড প্রদত্ত এনওসি আছে কিনা সেটা যাচাই করে নেয়। চা বিশেষজ্ঞদের মতে, মরসুমে কোন কারণে পাতা তোলা বন্ধ হয়ে গেলে তরতর করে বাড়তে থাকে চা গাছ। পাতার আয়তন বড় হয়, উচ্চতা বাড়ে। দু সপ্তাহ বন্ধ থাকলে চা গাছের এমন আকৃতি হয় যে সবুজ পাতা থেকে চা তৈরি করা কার্যত অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই লকডাউনের সময়ে ভারতীয় চা পর্ষদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে যখন জানিয়ে দেয় লকডাউন পরিস্থিতিতে চা পাতা তোলা যাবে না তখন চা গাছের পরিচর্যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। চা পর্ষদ থেকে তখন জানানো হয় সেক্ষেত্রে যেন চা গাছের মাথা কেটে ফেলা হয়। চা বাগানের পরিচালকেরা পর্ষদের নির্দেশিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এইজন্য যে চা পাতা তোলার জন্যই যেখানে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে গাছের মাথা কাটার লোক পাওয়া যাবে কিনা। ফলে চা পাতার কি দশা হবে সে কথা ভেবে মালিকদের মাথার চুল ছেঁড়ার দশা হয় লকডাউনের সময়কালে। প্রশ্ন উঠল এই সময়ে চা গাছকে বাড়তে দিলে ২-৩ সপ্তাহ পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পাতা তোলা যাবে না। তখন গাছের মাথা কাটতে হবে। তারপরেও নতুন পাতা আসতে আরও মাস দেড়েক অপেক্ষা করতে হবে। মরশুমের বেশিরভাগটাই ফুরিয়ে যাবে ততদিনে। ফলে এক ভয়ঙ্কর দূর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে যায় উত্তর এবং উত্তর-পূর্বের চা শিল্প।
চা গাছের পরিচর্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক কীটনাশক ছড়ানো। লকডাউনের ফলে চা বাগানগুলো বন্ধ থাকার নির্দেশ যখন এল তখন বাগিচা কতৃপক্ষ জানায় যদি কীটনাশক না ছড়ানো হয় তাহলে চা বাগিচার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। টানা তিন সপ্তাহ চা বাগানে কীটনাশক না পড়লে চা গাছে রোগ সংক্রমণ হবে এবং তা সামাল দিতে গোড়ার কিছুটা উপর থেকে চা গাছ কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না। সেটা হলে লকডাউন ওঠার পরেও তিন মাস চা পাতা উৎপাদন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। সামাজিক দূরত্ব মেনে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ চলতে পারে বলে বাগিচাগুলির মালিকেরা এবং তাদের সংগঠন সিসিপিএ দাবি জানায় সরকারের কাছে। তখন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে চা বাগান কর্তৃপক্ষকে শুধুমাত্র সেচ এবং কীটনাশক স্প্রে করার অনুমতি দেওয়া হয়। বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে চা গাছের পাতা না তোলার কারণে বড় বড় পাতাগুলি কেটে ফেলার অনুমতি চাওয়া হয় সরকারের কাছে। যুক্তি হিসাবে বলা হয় লকডাউন শেষ হলে চা বাগানের কাজ শুরু হলে সেই সময় ভালো চা পাতা না হলে ব্যাপক ক্ষতি হবে চা শিল্পে।ফার্স্ট ফ্লাশের সময় যখন মোটা অর্থ উপার্জন হয় এবং সারা বছরের সংস্থান হয় সেই সময় চা বাগান বন্ধ থাকলে বিশাল ক্ষতি। লকডাউনের সময়কালে ফার্স্ট ফ্লাশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ধাক্কা যে খেয়েছিল তা নিয়ে চা শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের কোন সন্দেহ ছিল না। সপ্তাহ দুয়েক পর থেকেই সেকেন্ড ফ্লাশ আসার কথা ছিল। কিন্তু পাতা তোলা বন্ধ হয়ে গেলে চা গাছ বড় হয়ে যাবে এই দুশ্চিন্তায় এক অসহনীয় অবস্থার মধ্যে পড়ল চা শিল্প সংশ্লিষ্ট ওয়াকিবহাল মহল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴