বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।।দশ।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^
আগের
পর্বগুলোতে বলা হয়েছে যে হাত-মলাই (Hand rubbing) থেকে কালো-চায়ের যে
যাত্রা শুরু হয়েছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ‘প্রসেসিং’ বার বার পরিবর্তিত ও
ক্রমশ যান্ত্রিক (mechanized ) হয়ে উঠেছে।
গাছ
থেকে চা-পাতা তোলা হয় খালি হাতে। মহিলা-শ্রমিকদের হাতে তোলা পাতা গুণমানে
ভালো হয় –কেননা তাদের নরম হাত শুধুমাত্র পাতার নরম ডাঁটি ছিঁড়তে পারে –
শক্ত ডাঁটি ছেঁড়ে না। ফলে চা ভাল হয়।এখন পাতা-তোলার মেশিন এসে গ্যাছে। তাতে
man-days বাঁচে।
গাছ
থেকে তোলা পাতা প্রথমে মাটিতে কাপড় বিছিয়ে শুকানো (withering) হত। আমরা
ছোটবেলায় ‘শুকলাই ঘর’-এ (withering house) দেখেছি তারজালির (chicken mesh)
ওপর পাতা শুকাতে। একে চাং (Chung) বা Rack withering বলত। পাঁচ-ছয়ফুট
চওড়া তারজালি আশী থেকে একশ ফুট দূরে দূরে বসানো দুটো থাম বা স্টীলের
খাম্বায়(pillar) লম্বা করে আটকানো। একটার ওপরে আরেকটা – থাকে থাকে (rack)।
মাঝখানে দুই ফুটের মত ফাঁক। তার ভিতরে কাঁচা চা পাতা ছড়িয়ে শুকানো হত। সময়
লাগত পনেরো ষোল ঘন্টা। বর্ষাকালে আরও বেশী। (ছোটবেলায় আমাদের লুকোচুরি
খেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই শুকলাই ঘর। তারজালির ওপরে শুয়ে পাতা দিয়ে
নিজেকে লুকিয়ে ফেলা।)
এখন
সব ট্রাফ-হাউস (Trough House)। আশী থেকে একশ কুড়ি ফুট লম্বা কাঠের বা
লোহার- এখন ইঁট-সিমেন্টের –চৌকা সুড়ঙ্গ। নীচে আর ডান-বাঁ দুপাশে বন্ধ। শুধু
ওপরে তারজালি/নাইলন নেট বিছানো। তার ওপর পাতা বিছানো হয়।সুড়ঙ্গের এক মাথায়
বড় ব্লেড়-ওয়ালা ফ্যান ঘুরতে থাকে বোঁ বোঁ করে। হাওয়া সুডঙ্গের ভিতরে ঢুকে
তারজালি দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেই হাওয়ায় পাতা শুকিয়ে যায়।একে বলে
ট্রাফ(Trough)। বর্ষাকালে বা প্রয়োজন মত এই হাওয়াকে গরম করারও ব্যবস্থা
থাকে। ফলে শুকানোর সময় এখন নেমে এসেছে আট থেকে বারো-ষোল ঘন্টায়।
রোলিং
থেকে সিটিসি উত্তরণের কথা আগেই বলা হয়েছে।সেখানে প্রসেসড (রোলিং বা সিটিসি
দানা) হয়ে যাবার পর আগে ফার্মেন্টেশান করা হত সিমেন্ট বাঁধানো পরিষ্কার
মেঝেতে বিছিয়ে (Floor Fermentation)। এখন এসেছে CFM (Continuous
Fermenting Machine)। অনেক লম্বা চলন্ত কনভেয়ার বেল্টের ওপরে প্রসেস্ড টি
ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এক মাথা থেকে অন্য মাথায় এবং তারমধ্যেই তা প্রয়োজনমত
ফার্মেন্টেড হয়ে প্রস্তুত হয়ে যায় ‘ভাজা’ হবার জন্য।
আগে
উনুনের ওপর ধাতব পাত্র রেখে ভাজা হত। পরে এল গরম হাওয়া দিয়ে ‘ভাজা’। বদ্ধ
চেম্বারে গরম করা হাওয়ার ভিতর ছোট ছোট সমান (flat) ধাতব পাত্র বুকের ওপর
ফার্মেন্টেড চা নিয়ে ঘুরে ঘুরে এগিয়ে যায় আর পরিমাপ মত ভাজা হয়ে বেরিয়ে আসে
মুখ দিয়ে ( Dryer mouth/discharge end)। একে বলে FVD (Fluid Bed Dryer)।
আগে অর্থোডক্স এবং সিটিসি দুরকমের চা-ই এভাবে ভাজা হত। এখন সিটিসি চায়ের
জন্য ব্যবহার করা হয় VFBD (Vibro Fluid Bed Dryer)। এখানে একটা বড়, লম্বা
ধাতব পাত্র ক্রমাগত ওপর-নীচ কাঁপতে থাকে (Vibro)। তার ভিতরে গরম হাওয়া
ঘূর্ণির মত ঘুরতে থাকে আর চায়ের দানাগুলো নাচতে নাচতে, অনেকটা কুলো করে চাল
ঝাড়ার মত, তার ভিতরে ভাজা হতে হতে বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে ।দেখলে মনে হয় যেন
জলের ভিতরে টগবগ করে ফুটছে চায়ের দানা।এখানে চা-দানার সঙ্গে পাত্রের কোন
সংস্পর্শ প্রায় হয়ই না। ফলে দানার সব দিক সুন্দরভাবে ভাজা হয়।
চা ভাজতে হয় এমনভাবে যেন পাতার ভিতর চার শতাংশের বেশী জল না থাকে। জলের শতাংশ এরচেয়ে কমে গেল চা ‘পোড়া’-র দিকে চলে যায়।
#
এখানে একটা কথা ওঠে। পুরনো ড্রায়ার (FVD) না নতুন ড্রায়ার (VFBD) – কার চা ভালো?
আমার
কাছে মনে হয়েছে কাঠের আগুনে ঢিমে আঁচে রান্না করা মাংস আর গ্যাসে দ্রুত
রান্না করা মাংসের স্বাদের যে পার্থক্য। যে যেটা পছন্দ করে। আমি পোলট্রির
ডিম পছন্দ করি না। হাঁসের ডিমের নরম কুসুম দিয়ে মাখা ভাতের গন্ধ – আহা!!!
ওদিকে আমার ছেলে জন্ম থেকেই পোলট্রির ডিম খেতে অভ্যস্ত; সে হাঁসের ডিম খেতে
পারে না – গন্ধ লাগে। সুতরাং বুঝ লোক…..
#
এরপর
তৈরি-চায়ের ঝাড়াই-বাছাই এবং গ্রেডিং। মূলত চারটে জিনিষের ওপর নির্ভর করে
হয় এই কাজটাঃ আকার,আকৃতি, আপেক্ষিক গুরুত্ব (specific gravity – মানে কতোটা
হালকা-ভারী)আর দেখতে কেমন [চকচকে (shining), না ম্যাড়মেড়ে (dull) ইত্যাদি ]
ভাজা
চায়ের মধ্যে থেকে ডাঁটি, অবাঞ্ছিত জঞ্জাল (foreign material), আলগা আঁশ (
loose fibre) গোটা পাতা, ভাঙা পাতা ইত্যাদি সব ডালা বা কুলো ব্যবহার করে
হাতেই ঝাড়াই-বাছাই হত। সবুজ চা এবং অর্থোডক্স চায়ে এখনও এসব অনেকটাই আছে।
আস্তে আস্তে নতুন নতুন মেশিন আসতে শুরু করে, যেমন মিড্ল্টন, রোটারি
সিফটার, ইলেক্ট্রোস্টাটিক ফাইবার এক্সট্র্যাকটার, ম্যাকিনটশ টি সর্টার,
জাভা টানেল, সার্কুলার ভাইব্রো স্ক্রীন ইত্যাদি।
#
যখন
চায়ের ঝাড়াই-বাছাই চলে তখন ফ্যাকটরীর ভিতরে এক কোনায় একটা পরিষ্কার ঘরের
মধ্যে চলে এক কঠিন বিচার-প্রক্রিয়া – বাগানিয়া ভাষায় যাকে বলে Tea Tasting;
এতক্ষণ ধরে যা তৈরি করা হল – শেষ অবধি তার গুণমান কেমন হল।
টেস্টিং-এ মূলত চারটে জিনিষ দেখা হয়ঃ
১. দেখতে কেমন (Appearance)
২. সুবাস (Aroma)
৩. স্বাদ (Flavour)
৪. চেখে কেমন লাগে (Mouthfeel)
টি-টেস্টার
প্রথমেই পরীক্ষার জন্য শুকনো ‘নমুনা-চা’ (Tea sample) সাদা কাগজের ওপর
রেখে এর রঙ, আকৃতি, বাছাই-এর সমতা (uniform sizing) , কত ডাঁটি আছে, আলগা
আঁশ এবং দানার মধ্যে আঁশ ঢুকে আছে কিনা (embedded fibre -সিটিসি চায়ের
ক্ষেত্রে ) - এসব ভাল ভাবে লক্ষ করেন। ডাঁটি এবং আঁশ যত বেশী থাকবে –
ঝাড়াই-বাছাই তত খারাপ। এমবেডেড ফাইবার যত বেশী চা তত নিম্ন মানের – বড় বুড়ো
পাতা দিয়ে বানানো চা; কাটাও ভাল হয়নি ।
রঙ যত উজ্জ্বল কালো তত ভালো ভাজা।
এরপর
ছুঁয়ে দেখা। যদি পাতা/দানা যদি স্পঞ্জের মত হয় – তাহলে ভিতরে জল বেশী আছে
(ভালো ভাজা হয় নি)। আবার যদি চুরচুর ভেঙে যায় – ভিতরে জল কম আছে (বেশী
ভাজা হয়েছে)।
এর পরের কাজ শুকনো চা পাতার সামনে মুখ নিয়ে মুখের ভিতর থেকে একটু ভেজা শ্বাস ছেড়ে তাকে ভিজিয়ে তার সুবাস নেওয়া।
আগেই
বলা হয়েছে যে জাতি-ভেদে, অঞ্চল-ভেদে এবং ঋতু-ভেদে চায়ে নানা রকম সুবাস
পাওয়া যায়। কিন্তু সে সব চায়েরই গন্ধ। এর বাইরে কোন গন্ধ আছে কিনা তা এখানে
দেখা হয়।
চা খুব
গন্ধ-আকর্ষক। সহজেই অন্য গন্ধ শুষে নেয়। যেমন ধোঁয়ার গন্ধ, ফ্যাকটরীর
তেল-কালির গন্ধ। তাই খুব সাবধানে তাকে রাখতে হয়। এছাড়া চায়ের সঙ্গে কোন
মশলা- এলাচ,লবঙ্গ, আদা, লেবু,তুলসী, রজনীগন্ধা ইত্যাদি রাখলে চা সব গন্ধ
সহজেই টেনে নেয়। এমনকি ন্যাপথলিনের গন্ধও। অসাধু ব্যাবসাদাররা এভাবে চায়ে
নানা ‘কৃত্রিম’ গন্ধ তৈরি করে তুলসীগন্ধী চা, লেবুগন্ধী চা ইত্যাদি বলে
বাজারে ছাড়ে।
দক্ষিণ ভারতে চা-বাগানের পাশেই প্রচুর মশলার বাগান থাকায় সেখানকার চায়ে ‘spicy aroma’ খুব স্বাভাবিক ভাবেই পাওয়া যায়।
-------------------- ------------------ --------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া