বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব : দশ
মিশা ঘোষাল
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
শরতের টোটোপাড়া ও সনে টোটোর লেখা একটি টোটো গান
শরতের
গুঞ্জনে যখন রুপালি মেঘ উড়ে বেড়ায় টোটোপাড়ার আকাশে, মেঘের চিবুকে তখন এক
চিলতে রোদ্দুর -টোটোপূজার গানের সুর ভেসে বেড়ায় টোটোপাড়ার আকাশে ও বাতাসে,
টোটো কিশোরী কন্যার পায়ে আদিম নৃত্যের ছন্দ, টোটো নাচের তাল...
হাউড়ি
তখন বালি-পাথরের বুকে তার তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেখে নৈশব্দের কিনারায়
নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়, এক অপার বিস্ময় তাকিয়ে থাকে টোটোপাড়ার নীলাকাশে,
তোর্ষার ধার ঘেঁষে কাশবনে সাদা সাদা কাশফুল ফোটে, হাওয়ায় হাওয়ায় দোলে কাশের
গুচ্ছ ... নাইয়ু পূজার (টোটো পূজা) সুবাস তখন টোটোপাড়ার নির্মল প্রকৃতিতে,
পূজার আনন্দে মাতে টোটোদের কচি কাঁচারা। চোখে তাদের আনন্দের বন্যা !
'গোরেয়া'তে
মামার বাড়ি, পিসির-বাড়ি কলাপাতায় মুড়ে মাংস-ভাত পৌঁছে দেওয়া শেষ। 'গোয়াটি'
পূজাও হয়ে গেছে আগেই । নদী, নালার পূজাও শেষ। এবার টোটো গানের উৎসব। নাইয়ু
পূজার অনুষ্ঠান এবার!
টোটো কিশোরী কন্যারা ছুটে
বেড়ায় টোটো নৃত্যের ভঙ্গিমায়, উড়ে বেড়ায় শরৎ-মেঘ হালকা হাওয়ার গানে। ভূটান
পাহাড়ের উপর ঐ পাশাখা পাহাড়ে এখন বলাকা মেঘের পর্যটন !
রোদের আলো নরম হয়ে আসলে সেই আলোর ছোঁয়ায় মনে লাগে পূজার মরসুমি হাওয়া, সাথে শীতের আগমনী বার্তা!
আসছে
এই টোটোপূজার 'নাইয়ু' অনুষ্ঠানটি। এবারের এই অনুষ্ঠানের দিন ধার্য্য করা
হয়েছে ১০ই অক্টোবর। প্রতিবছরই এই সময় অর্থাৎ সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসেই এই
'নাইয়ু' পূজার নাচগানের অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। তারিখ ও দিন নির্ধারণ ও
নির্দিষ্ট করেন টোটোদের প্রধান পুরোহিত বা কাইজী। বর্তমানে টোটোপাড়ার
প্রধান পুরোহিত (কাইজী) হলেন ইন্দ্রজিৎ টোটো।
প্রধান পুরোহিতের (কাইজীর) নির্দেশে 'নাইয়ুর' এই নাচগানের অনুষ্ঠানটি আগে
'ডেমসা'তে
(টোটোদের পূজা-ঘর) করা হত। এই অনুষ্ঠানের প্রথমে টোটোদের আদিম নৃত্য (Toto
traditional song with dance) মাদল বাজিয়ে পরিবেশন করতেন টোটো-পুরোহিতরা।
তারপর নতুন আঙ্গিকের যে টোটোগান বর্তমান প্রজন্মের টোটোরা লিখেছে (বিবর্তিত
ও কিছুটা পরিবর্তিত), সেই গানগুলি কিছুটা আধুনিক এই টোটো গান ও নৃত্যের
ধরণ। 'টোটো ইয়ং গ্রুপে'র ছেলেমেয়েরা পরিবেশন করে এই নতুন আঙ্গিকের টোটো
লোকসংস্কৃতির উৎসব। কয়েক বৎসর যাবৎ এই 'নাইয়ু'র অনুষ্ঠানটি একটু বড় করে
আধুনিক আঙ্গিকে টোটোপাড়ার 'ধনপতি টোটো মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের'
মুক্তমঞ্চে অথবা বিদ্যালয়ের মাঠে পরিবেশিত হয়ে আসছে।
সুখা মরসুমে অর্থাৎ শরৎকালের এই সময় হাউড়িতে জল থাকে না। এই সময় সূর্যের তেজে তোর্ষার জলজ কিরণ এসে পড়লে
সে
এক বানভাসি আলোর বন্যায় তখন মেতে ওঠে টোটোপাড়ার প্রকৃতি, সবুজের মখমলি রঙ
আরও ঝলমলে হয়, প্রতিফলিত হয় হাউড়ির চরে, বিস্তৃত বালুকা বেলায় পাথরেও রঙ
লাগে, চারপাশের অভয়ারণ্যের প্রতিটি বৃক্ষের পাতাও সবুজের গল্প বলে,
তখন
কিছুক্ষণ অন্তত থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় নৈশব্দের এই কিনারায়... ইচ্ছে
হয় অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই পটভূমি 'টোটোপাড়া'কে আরও ভালোবাসতে,
জানতে ও বুঝতে !
প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, মাধুর্য্য
সবকিছুই এমন নিপুণ অক্ষরে লিখে রাখা আছে এখানে যে, অবাক পথের দৃষ্টি এসে
থমকে যায় টোটোপাড়ার এই জাদুকরি ছবির ক্যানভাসে।
এ
যেন অনাবিষ্কৃত এক গল্প-কথার মায়া, প্রকৃতির এক নির্মল উপহার !তাই তো সনের
(সনে টোটো) হাতের কলম লিখতে পেরেছিল একটি অসাধারণ টোটোগান, যা এই শরতের
আকাশে, টোটোপাড়ার এই পটভূমিতে মিলে মিশে একাকার ...
টোটোপাড়ার এই আকাশ,বাতাস ও প্রকৃতিকে নিয়ে লেখা তাঁর এই গান,
গানটির কথাগুলি টোটো ভাষার উচ্চারণে মোটামুটি এরকম...
"সিনি কো সিং তিং
তৈতিং সো ডাং তিং...
নিনা অংকো লোই জেজেংপা
তাংসা তা নেত্তা না লোই
নেত্তা না ইয়োনিং পা
সেনে সুতিকো লা পা
ইয়াগো কলিতা নাইচিও সিতা
ইয়ুংমি ইয়াম্বি টোটোবি
চুংচা জোরা কো পাকোতা
সেঞ্জা ওয়াংতাতা হোইমসা
মোয়ূং সিতা সুমসা
চামি ইয়াম্বি টোটোবি
লাকা সো লোইরা চিমসা
সিনি সুতিকো লা পা"...
সনের লেখা এই টোটো গানটির অর্থ করলে এরকম ভাবার্থ এসে পড়ে :
"গাছপালায় ঘেরা আমাদের এই গ্রাম টোটোপাড়া।
এখানে আম গাছ,কাঁঠাল গাছ,সুপারি গাছ ইত্যাদিতে ভরা। খুব সুন্দর প্রকৃতি আমাদের এই টোটোপাড়ার। সজীব ও শ্যামল।
পাহাড়ের নীচে এখানে আমরা খড়ের ঘরের ছায়ায় বাস করি।
নদী-নালা ঘিরে থাকে আমাদের।
আমরা টোটোজাতিরা ভূট্টা যাতায় পিষে তারপর সেটা রান্না করে খাই ।
পাহাড়ের
ঢালে, উঁচু-নিচু ক্ষেতে ধান ফলাই আমরা। তারপর উড়ুন-গাইন দিয়ে সেই ধান ভেনে
চাল বের করি। তারপর সেই চাল রান্না করে ভাত খাই আমরা, আমরা টোটোজাতিরা।"