সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
18-August,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 504

পরম্পরা/শুক্লা রায়

পরম্পরা
শুক্লা রায়

দীনদয়াল বসে কার একটা পুরনো জুতা সেলাই করছিল। একদিকে ডাঁই করা পুরনো জুতো, ক্ষয়ে যাওয়া সোল এইসব। অন্যদিকে হাতুড়ির উপর একটা জুতো চেপে রেখে প্রাণপণে সেলাই করছিল দীনদয়াল। তবে জুতোটা দেখে এর মালিকের প্রতি করুনাই হয়। দীনদয়াল তবু অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে জুতোটা নিয়ে পড়ে আছে। আসলে জুতোর চেহারা যা-ই থাক ফুটো-ফাটা মেরামতিতেই দীনদয়ালের পয়সা। সবচেয়ে ছোট ছেলেটা ওর কাছেই বসে। মুড়ি চিবাচ্ছে। নাক দিয়ে সিকনি গড়িয়ে পড়তে না পড়তেই সেটা আবার এক ঝটকায় তুলে নিচ্ছে। অসাধারণ টাইমিং। এসব দেখে তিতিবিরক্ত দীনদয়াল ছেলেকে ধমক দেয়, "এ বেটা। যা। মার কাছ থেকে নাকটা মুছে আয়।" ছেলের তাতে হেলদোল নেই। কালিঝুলি মাখা হাতেই একটা একটা মুড়ি মুখে ফেলছে আর উদাস চোখে এদিক ওদিক চেয়ে দেখছে। দৃশ্যটা বিরক্তিকর হলেও দীনদয়ালের এখন কাজ ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া মুখে বললেও দীনদয়াল জানে ওর বৌ মতিয়া এখন বাড়িতে নেই। কারো না কারো বাড়িতে এটা ওটা কাজ করে দিয়ে চালটুকু অথবা একটু আটা জোগাড় করবে। না হলে কারো বাগানে ঢুকে শুকনো কঞ্চি কী গাছের ডাল টাল কুড়াচ্ছে। বাচ্চাগুলো নিজে নিজেই এদিক ওদিক চড়ে একসময় মানুষ হবে।পাঁচ-পাঁচখানা ছেলে-মেয়ে তার। বড়, মেজো এবং ছোটটা ছেলে, বাকি দুটো মেয়ে। সবগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড়টা কাজ করার মতো হয়েই গেছে। কিন্তু বাপের কথা কী শুনবে? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে, শরীরটাও যেন হাল্কা লাগে তাতে। "দীনদয়াল, বাড়িতে আছিস?" মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে ও পাড়ার শিবানী জ্যাঠাইমা। দেখে মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে দীনদয়ালের। "বলেন কেনে, কেন ডাকছেন।" দীনদয়ালের এই অপূর্ব বাংলায় সবাই বেশ অভ্যস্ত। আসলে শিবানী ডাকতে এসেছে মানেই ছাগল 'খাসি' করে দিতে হবে। তাহলে দুটো টাকা আর আধসের চাল জুটে যাবে আজকের মতো। কাজ তেমন প্রায় নেই। বড্ড খাবারের আকাল চলছে এখন। 
শিবানীর তিনটে ছাগলের বাচ্চার দুটোই পাঁঠা। আগেরবারের একটা পাঁঠা রেখেছে মানত, পূজায় উৎসর্গ করবে। সেটাও বেশ অনেকটাই বড় হয়েছে। কালো কুচকুচে উজ্জ্বল চেহারা। লোকজনের আজকাল ওকে দেখলেই লোভে চোখ চকচকে হয়ে ওঠে। সেজন্য খুব তাড়াতাড়ি পুজোটা দেবে। কেউ চুরি করে নিল তো গেল। এবারের দুটো পাঁঠার দুটোকেই 'খাসি' করে বড় করে বিক্রি করবে। দুটো খাসি বিক্রি করলেই মেয়ের হাতের বালা, গলার মাছিহারটা হয়ে যাবে। দীনদয়াল আয়েস করে পিঁড়িতে বসে। শিবানীর ছেলে একদিকে শিবানী একদিকে ঠ্যাঙগুলো চেপে ধরে। বাঁশের পাতলা আঁশ যেটাকে ছেঁচকুনি বলে, ব্লেডের মতো ধার, দীনদয়ালের হাতে ধরা। ছাগলের বাচ্চাটা বিপদ বুঝে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। অপারেশন শেষ করে উনুন থেকে তুলে নিয়ে আসা পোড়ামাটির গুঁড়ো দিয়ে ক্ষতস্থানটা বন্ধ করে দেয়। মাথায় একটু জল থুপে থুপে দিয়ে ছেড়ে দিতেই ছাগলের বাচ্চাদুটো কেমন ঝিম মেড়ে বসে থাকে। একটু পরেই উঠে অবশ্য আগের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে। শিবানীও নিশ্চিন্ত হয়।  এজন্যই দীনদয়ালকে ডাকা। আর একজন আছে, কিন্তু ওর হাতের তেমন গুণ নাই। বেশ কয়েকটা ছাগলের বাচ্চা মরে গেছে। চারটা টাকা আর একসের চাল দিয়ে শিবানী দীনদয়ালকে বিদায় করে।
বাড়ি এসে আর কাজে মন বসে না। চার টাকার দুটাকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। হাড়িয়া খাবে। পেছনে বৌ চেঁচায়। ওসব পাত্তা দেওয়ার মানুষ অবশ্য সে নয়। নিজের মতো হাঁটতে থাকে। মনটা তার খারাপ। বড় ছেলেটা খানিকটা ইস্কুলে পড়ে লায়েক হয়ে গেছে। বাপ-দাদার এসব কাজ করতে ওর সরম লাগে। তাহলে যা না তুই, কোথাকে যাবি যা। পন্দেরো-ষোলো বছর হইয়ে গেল, এখনও বাপের ঘাড়ে চড়ে খাওয়া কেনে? হুঃ! কাজ করবি, পয়সা কামাবি, হাড়িয়া টানবি তারপর ঘরে এসে বৌ পেটাবি। শালা একদম বাপকা বেটা। এসব ভাবতে ভাবতে দীনদয়াল দুটাকার দুই বাটি হাড়িয়া খেয়ে অনুভব করে দুই বাটি বড় কম হয়ে গেল। বাকি চাইতেই সোনামণি মুখ ঝামটা দিল। "ধার শুধবি কি করে?" বৌকে ইচ্ছেমতো যখন তখন গরম দিতে পারলেও সোনামণির কাছে দীনদয়াল কেঁচো। কাকুতি-মিনতিতে কাজ হচ্ছে না দেখে প্রতিজ্ঞা করল এই সোনামণির দোকানে আর কোনোদিনও পা রাখবে না। মাঝপথে আসতে আসতে মতলব অবশ্য অন্যদিকে ঘুরে গেল। নাঃ, দুটাকা তো এখনও আছে। ওটা দিয়ে আর দু বাটি পাওয়া যাবে। তাছাড়া সোনামণিকেও একটু দেখিয়ে দেওয়া দরকার, বেটির এত দেমাক! ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। বেশ করে একটা গান ধরল।  দারুণভাবে সেটাকে গলায় খেলাতে খেলাতে এসে দেখল, নাই। বৌ নাই। মুহূর্তে গান থেমে গিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে দীনদয়ালের। "শালি, রেন্ডির বাচ্চা।" বৌও চালাক। জানে এক্ষুণি এই টাকা হাতছাড়া হয়ে যাবে। ভাত বসিয়ে দিয়েই দোকানের বাকি টাকা শোধ করতে চলে গেছে।
জুতো সেলাই আর ছাগল 'খাসি' করা -এই দুটো কাজে যথেষ্টই দক্ষ দীনদয়াল। কিন্তু আর কোনো কাজ জানে না। গ্রামের মানুষ কত আর জুতো সেলাই করাবে। অতএব দিন কাটানো বড় দায়। তবু ইচ্ছে বড় ছেলেটা বাপের কাজ শিখুক। তা সে তো লায়েক এখন। দীনদয়ালের অত্যাচারে পড়া ছেড়ে কোথায় কোন মাড়োয়াড়ির কাপড়ের দোকানে কাজ নিয়ে চলে গেল। এ হেন আচরণে দীনদয়ালের কষ্ট হল খুব। বুকে বড্ড লাগল। কী আর করা। বৌকে মেরে ধরে যে কয়টা টাকা গোপনে লুকানো ছিল কেড়ে নিয়ে সোনামণির দ্বারস্থ হল। দস্তার বাটিতে এক চুমুক করে হাড়িয়া খায় আর ভেউ ভেউ করে কাঁদে। তবে মেজো ছেলেটা তার মানুষের মতো মানুষ হবে। এখনি বাপের কাজ ধরে ফেলেছে।
 একেতে কাজ-কামাই নেই। দুটো জুতো সেলাই করে রেখেছে। মালিক এসে টাকা দিয়ে নিয়ে যাবে। সে কবে কে জানে। কাজ না করে করে হাতে পায়ে কেমন খিল ধরে গেছে। সুতরাং উঠল। বৌয়ের লুকানো জায়গা থেকে টাকা কয়টা তুলে নিল। কয়েকদিন আগেই জায়গাটা দেখেছে, বৌকে বুঝতে দেয়নি। একটু হাড়িয়া টেনে এলে শরীরটা ঝরঝরে লাগবে বলে মনে হচ্ছে। সোনামণির বাড়ির ভেতর থেকে প্রবল ঝগড়ার আভাস। কে বটে? দীনদয়াল উঠোনে পা রাখে। তার ছেলের বয়সী দুটো ছেলে একেবারে হাতাহাতির চরম পর্যায়ে গেছে। এখন ছেলেরা সব কম বয়সে নেশা করবে আর মারামারি করে মরবে। যাঃ শালা। দীনদয়াল মনে মনে গালি দেয়। তবু একপা দু'পা করে এগোয়। থামাতে চেষ্টা করে। কেউ কিছু বোঝার আগেই একটা ছেলে সোনামণির বেড়ায় গুঁজে রাখা হাসুয়াটা টেনে অন্য ছেলেটার কাঁধে কোপ বসায়। ছেলেটা 'বাবুজী' বলে ডুকরে উঠেই তার গায়ে ঢলে পড়ে। মুহূর্তেই নেশা করার শখ ছুটে যায় দীনদয়ালের। ঘায়েল হয়েছে তারই মেজো ছেলেটা! একটা ভ্যান ডেকে নিয়েই পড়ি কী মরি করে হাসপাতালে ছোটে। নিজের মনে বিড়বিড় করে, "তোকে কতবার কহিনু, ও বিষুয়ার বেটার সাথে না থাকিস। তুই শুনিলু না। খালি মারামারি করে আর দারু খায়।"

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri