পইলা সাঞ্ঝির কথা/১০
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ১০
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ভাদর কাটানি
~~~~~~~~
বুধেশ্বরের বাড়ি যাবে বলে বেরিয়ে দেখে ফুলমতী হাতে কটা সজনেপাতার নিয়ে হন হন করে বাড়িমুখো হাঁটছে। ওকে দেখে দাঁড়ালো।
“কোটে বিরাসিস মাই”?
বসমতী ফুলমতীর হাতের সজনেপাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
“মুইও কয়টা সোজোনা আনির চাছোং, পেলকা খাইম। তুইও পেল্কা আন্দিবু আজি”?
শুনে ফুলমতী আঁতকে ওঠে। তারপর একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।
“না হয় পেলকা। পেলকার কাতা শুনিলে বড়বাউ এলায় মরিয়া মরিবে”।
বসমতী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেনে? উয়ায় আরো কোটেকার টাউনিয়া মানসি আসিল তে ছেকা পেলকা খাওয়া দেখির না পায়?”
ফুলমতী মনে মনে কিছুটা গর্বিতভাবের সঙ্গে সাড়ম্বরে বর্ণণা করল,
“জানিন না তুই? উদিনকা আতিত প্যাটের বিষৎ মরি যাং! মইধ্য আতিত ঠাকুমারিৎ গোড়ামরি দ্যাং! কোটে যাং, কোটে না যাং! বড়বাউটা আতিতে মতিনঘরের বুড়াটার জলকোষা আনিল। তাও কমে না। কুনোমতে আতিটা কাটেয়া পইলা মুরগা ডাকিতে না ডাকিতে বাউয়ে সেলা নিজে ভ্যানত বসে মোক বড় দাক্তারোক দ্যাখে আনিসে। কিচ্চু একান হাউসের খাজা খাবার দ্যায় না এলা”।
ফুলমতীর কথাতেই বোঝা গেল ছেলের শাসন বেশ ভালোই লাগছে। তারপর সজনেপাতাগুলো দেখিয়ে বললো,
“ছেকা নাহয়, ভাজা খাইম। চোকু ভাল্ থাকে”।
এখনও ভাদ্রমাস আসতে দু'দিন বাকি। শ্রাবণ যেন আগাম বিদায় নিয়েছে এবার। রোদ একেবারে আয়নার মতো চকচক করছে। ডোবাগুলো শুকিয়ে যাবার ভয়ে অনেকেই আগে আগে পাট কেটে ধুয়ে নিয়েছে। এসময়টা লোকের হাতে কাজ কম থাকায় অভাব খুব। 'হাজিরা মুজুরা' করে চলে যারা তারা ছাড়াও অল্প জমি গৃহস্থেরও খাবারে টান পড়ে। অনেকেরই জমির ধানে বচ্ছরকার খাবার কুলায় না। আবার অসুখে বিসুখে, নানান কারণে ওর থেকেই একটু ধান বেচে ফেলে কেউ কেউ। সেজন্য দু'কেজি এক কেজি কেউ পাঁচ কেজি করে পাট বিক্রী করে দিন কাটায়। শুধু চালটুকুই কেনে, সব্জি কেনার বিলাসিতা করার কথা ভাবতেও পারে না। নুনটা কিনতে হলেও তেলের খরচ সামান্যই। ছেকা পেল্কায় তো তেল লাগেই না। আর মাছ মাংস খাবার কথা এই অভাবের দিনে ভাবনাতেই আনে না কেউ। অতটুকু পাট বেচতে হাটে যেতে হয় না, বাড়িতেই ফড়েয়াগুলো হানা দেয়। এখন অভাবে লোকে কম দামে পাট বেচবে তারাও জানে। বসমতী ডোবার পাড়ের শুকনো ভাঙাচোরা পাটকাঠিগুলো মটমট করে মাড়িয়ে মাড়িয়ে বুধেশ্বরের বাড়ির দিকে গেল। ওদের বাড়ি থেকে ক'টা সজনে পাতা নিয়ে বুধেশ্বরের বউয়ের একটু নিন্দা শুনে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বসমতী উঠোনে পা দিয়ে দেখে, বুধেশ্বরের বউ ভালো একটা শাড়ি পরে সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে। তারপর বুধেশ্বর সাইকেল নিয়ে বেরোতে আস্তে আস্তে পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। বসমতী জিজ্ঞেস করল,
"কোটে যান বারে?"
বউটি অল্প হেসে লাজুক কন্ঠে উত্তর দিল,
"কোনেক বাড়ি যায়া আইসোং। মাও বোলে যাবার কইসে"।
"তে হাঁটি যাবেন"?
বসমতীর এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে লাজুক হেসে কোলের বাচ্চাটাকে ভালো করে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগল। ব্যাগ-বোঁচকা বুধেশ্বরের সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলছে। পেছন থেকে বুধেশ্বরের মা বলে উঠল,
"সাইকোলোত চড়ির সোমায় ভাল করি ছাওয়াটাক ধরেন, নাতেন পড়ি যাবে আরো।"
বোঝা গেল হেঁটে নয়, সাইকেলে চড়েই যাবে। বুধেশ্বরের মা গলাটা উঁচু করে বলে,
"সাইকোলোতে না যাবে। এইলা সোবাং! ভাদর মাসখান না পইত্তে উমার বইনি আসি আছে বাপের বাড়িৎ। আর বচ্ছর যে বিয়াও হইল, অইটা বইনি। ওই তো শুনিয়া ইয়াও এলা যাবে। বাদায় না মানে। এলকার বউগিলা যে হইসে 'আহ্লাদের কাটুয়া, চুড়া ভাজা বাটুয়া'। কয়ায় না যায়"।
মাঝামাঝি জায়গায় রতনদের বাড়ি। রতন গাড়িটাকে খুব মন দিয়ে ঝাড় পোঁছ করছে। একপাশে ছইটা রাখা। ওটাও লাগাবে। পাশেই তাগড়াই গরু দুটো খুঁটে বেঁধে রাখা। সামনে জাবনা দেওয়া। ওরা কেউ কিছু খাচ্ছে না, আয়েস করে জাবর কাটছে আর গলার ঘন্টি বাজছে টুংটাং। হনহন করে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকা বসমতী থমকাল। দাঁড়িয়ে পড়ে রতনকেই জিজ্ঞেস করল,
“গাড়ি জোতাছিত যে অতন, কোটে যাবু”?
রতনের হয়ে উত্তর দিল রতনের মা,
“উদিনকা থাকি যে ভাদর মাস পড়েছে। বড় বৌমাক বাপের বাড়ি থুয়া আসিবে, বৌমার বাপ বলে না পায়। আশিনার হাতোত কয়া পেটাইসে নিগি থুবার। উমরা সেলা থুয়া যাবে।”
বসমতী কৃত্রিম মনখারাপ করল,
“মন্তেসের মা'র হইল কষ্ট! আরো একান মাস আউংশালিবাড়ি টানির নাগিবে”। রতনের মা'র বড় বৌমা আসলে মন্তেসের বউ। রতনের বড় জ্যাঠামশায়ের ছেলে। শ্রাবণের ঘোর বর্ষাটায় বিয়ে হল। রতনের মা মাথায় জল ছিটিয়ে জলছিটা মা হয়েছে। বিয়েতে ছেলে-বৌমাকে একটা দুধেল গাই দিয়ে আশীর্বাদ করেছে আবার মেয়ের বাড়িতে বিয়ের আসরে কাঁসার দুটো থালা, গ্লাস-বাটি দিয়েছে। বেশ ভালো কাঁসা। বউয়ের মুখে অবশ্য খুব 'মা' ডাকটা আছে। কলকল করে নদীর মতো কথা বলে সারাক্ষণ। আদর যত্নও ভালোই করে শ্বশুর-শাশুড়ি সবাইকে। রতনের মা'র মনটা ভেতরে ভেতরে একটু খারাপ। এমন হাসিখুশি বউটা গেলে বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। তাছাড়া এই ক'দিনেই সময়ে অসময়ে এসে হাতের কাজটা করে দেয়। খুব মায়া মেয়েটার। কিন্তু নিয়ম যে! ভাদ্রমাসে নতুন বউয়ের মুখ দেখা যায় না। ভাদ্রমাস পড়ার আগেই নতুন বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হয়। একমাস না হলেও কমপক্ষে পনেরোদিন তো থাকতেই হবে। তারপর বাপের বাড়ি থেকেই দিয়ে যাবে অথবা ছেলে গিয়ে নিয়ে আসবে। রতনের মা বসমতীকে পিঁড়ি দিয়ে বলে,
“বইস মাই, চা খায়া যা”। বসমতী রাজী হয় না। অনেক কাজ পড়ে আছে। রতনের মা একটু ইতস্তত করে বলে
“এইলা নিয়াম আরো কেনে হইসে ক তো! বিয়াওখান বিরিবার ছয়খান মাস না হইতেই বৌমাটা বাপের বাড়ি যায়া একমাস নবে”।
সজনেপাতাগুলো পাশে রেখে বসমতী আয়েস করে পিঁড়িতে বসল। তারপর বলল,
“এইলা নিয়ম হামার ভালোর জন্যেই হইসে দিদি। কতলা মানসির বাড়িত ভাদর মাসখান কেমন আকাল যায়, দেখিস না”
ধীরে ধীরে গল্পচ্ছলে বসমতী রতনের মা'কে যা বলল 'ভাদর কাটানি'র বিষয়ে অনেকাংশেই সত্যি। এই সময় ছোট গৃহস্থের বাড়িতে অভাব দেখা যায়। নতুন বউ অনেক সময় লজ্জায় খিদে পেলেও প্রকাশ করতে পারে না। আবার অল্প খাবার বাড়ির সদস্যদের পরিবেশন করতে করতে নিজের জন্য কিছুই রাখতে পারে না। অনেকক্ষেত্রে নতুন বউটির প্রতি কিছুটা প্রচ্ছন্ন অবহেলাও কাজ করে। অন্যদিকে শ্বশুর বাড়ির লোকও অভাবের কারণে বাড়ির নতুন সদস্যটির কাছে বিব্রতবোধ করে। এসব কারণে ভাদ্রমাসে নতুন বউকে বাপের বাড়ি রেখে আসার প্রথা। আবার গ্রামবাংলায় হেঁউতি বা হেমন্তের ধান ওঠার আগে সব বাড়িতেই ভাদই ধান উঠলে গৃহস্থ অনেকাংশে অভাব সামলে নিতে পারে। তখন আবার বৌমাকে নিয়ে আসা হয়। একনাগাড়ে কথা শেষ করে বসমতী উঠল। রতনের মা এবার সজনেপাতাগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“সজনা কি করিবু তে, ছেকা খাবু?”
কথাটা বলেই অবশ্য উত্তরের অপেক্ষা না করেই ছেলেকে তাড়া দেয়, স্নান করে ভাত খেয়ে নেবার। বৌমাকে রেখে রতন এই পথটা তো ফিরবে আবার! ‘আতি আন্দারে' রাস্তায় কোথায় কী আছে না আছে কে বলতে পারে? রতনের মায়ের আবার অপদেবতার ভয়টা একটু বেশি। রতন গায়ে মাখে না। হাসতে হাসতে বলে,
“মুই কী বৌদিক ধরি একলায় যাছোং? মংলুটাকো সাজাসুং। দোতারাখান নিবে। কত আতি হয় হোউক। উয়ায় দোতোরা ধরিবে, মুই এলায় গালাটা ছাড়ি দিম। কিসের ওঠে ভয়?”
কথামতো বিকেল বিকেল সময়ে রতন মংলু মন্তেসের বউকে নিয়ে রওনা হল। নতুন বউ সবাইকে প্রণাম সেরে ছইয়ের ভেতরে পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে বসল। খুশি খুশি মুখে। মংলু গাড়োয়ানের পাশে দোতারা নিয়ে আয়েশ করে বসে টুং টাং করে আস্তে আস্তে দোতারায় সুর তুলতেই, রতন ফুরফুরে মেজাজে গলা ছেড়ে গান ধরল। সাথে সঙ্গত করছিল গরুর গলার ঘন্টির আওয়াজ। চলার ছন্দে এক অপূর্ব সুর ছড়িয়ে পড়ল পথজুড়ে। তিনজনে সারা পথটা গানে গল্পে পেরোতে লাগল আনন্দে।
------------------------------------------------------------
সোবাং - ঢং
আহ্লাদের কাটুয়া চুড়া ভাজা বাটুয়া - বেশি আহ্লাদী
জোতাছিত - জুড়ছিস
উদিনকা - পরশু
আতি-আন্দারে - রাত-বিরেতে
______________________________________
ছবি : তুষার কান্তি মাঝি
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴