নানারঙের_গানগুলি-১০/শৌভিক কুন্ডা
নানারঙের গানগুলি-১০
শৌভিক কুন্ডা
-------------------------------
বাসুদার কথা তুললামই যদি, এবার একটু বিস্তারে যাই। ২০২০ সালের শেষ দিকে হবে, খবরের কাগজে, বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় আমার প্রিয় এই মানুষটির নাম আরও একবার রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে গেল। কিন্তু, গানের কারণে নয়। ইনিই সেই বাউল, কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত দলটির অমিত পরাক্রমশালী সর্বভারতীয় সভাপতি যাঁর বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সেরেছিলেন! এখানেই শেষ হয় নি, এক সপ্তাহ যেতে না যেতে আবার খবরে বাসুদেব। এবার অবশ্য রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের জেলা সভাপতির সান্নিধ্যে। কেন্দ্রীয় স্তরের আগের অতিথি এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে অভিমানে সুর মিশিয়ে! ক'দিন পর বীরভূমে মুখ্যমন্ত্রীর পদযাত্রায় মূল গায়েন হিসেবে পথও হেঁটেছিলেন। পরপর ক'দিন এভাবেই খবরে প্রথম সারিতে ভেসে ছিলেন বাসুদেব দাস। অবাক হয়েছিলাম খুব। এই বাসুদাকে আমি চিনতাম না, চিনি না।
আমি যাঁকে চিনি, তাঁর চোখ উদাস, হৃদয়ে প্রশান্তি। তিনি কিছু পেলেও ভালো থাকেন, না পেলেও। তিনি অনায়াসে লোকগানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ে বেরান। রাঙামাটির দেশে যা'র কথা তো আগেই লিখেছি, এছাড়াও বাসুদার গলায় "কলঙ্কিনী রাধা", "পিন্ধারে পলাশের বন", "বড়োবাঁধের ভুত" রসেবশে খেলা করে। তবে, নানাধরণের গানের মজা নিলেও হৃদয়ে তাঁর সবসময়ই বাউলের একতারা।
১৯৭৫, যুগোস্লাভিয়ার মাটিতে বিশ্ব যুবউৎসব। সে প্রাঙ্গণচত্বর কেঁপে উঠেছিলো যাঁর তারযন্ত্র ও স্বরের গমকে, তিনিই বাসুদেব দাস বাউল। হ্যাঁ, ঐ উৎসবে ভারতবর্ষের প্রতিনিধি। দেশবিদেশের নানা তথ্যচিত্র তাঁকে তুলে ধরেছে বাউলসাধনের সহজিয়া আলোচনায়,গানে-কথায়। ব্যান্ডদলের উদ্দাম সাইকেডেলিক আলোতেও স্বচ্ছন্দ তিনি। ভীড়ে, পুরস্কারে, পরিচিতিতে ভূষিত হয়েও হারিয়ে ফেলেন না একক সত্তাটিকে।
বাসুদেব দাস বাউলের বাড়িতে ঢুকে নজর আটকে যাবে তাঁর সাধন ঘরটিতে। আগে ছিলো খুব সাধারণ। বহুবছর যাই না, দেখা হয় নি, তবে শেষ ক'বছর যখন যেতাম, ঐ সাধারণ ঘরটিকে চোখের সামনে অন্যরকম প্রসারে বেড়ে উঠতে দেখেছি । এই বিবর্তনের গল্পটাও বাসুদার মুখ থেকেই শোনা।
মহিলা, যুবতীই, এসেছিলেন জার্মান দেশ থেকে। গানেই শুধু মজলেন না তিনি, প্রাণেও সুরসুধা ভরে নিয়ে নিজেকে সমর্পন করলেন বাংলার এই বাউলের কাছে। বাসুদাও বিদেশিনীর প্রেমে ডুবে তাঁর নাম রাখলেন বিজলী! বিজলীর সাধনপ্রেম কতদিন টিঁকে ছিলো, বলতে পারবো না। তবে একদিন ফুরিয়েছিলো, এটা জানি। প্রেম, এবং সম্ভবত ভিসার মেয়াদও! তিনি ফিরে গেলেন নিজের দেশে। যাওয়ার আগে বাসুদার নামে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলে তাতে জমা করে গেলেন একটি সুন্দর সাধনঘর তৈরী করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা। আমার চোখের সামনে গড়ে উঠতে থাকে বাংলার এক বাউলের জন্য বিঠোফেনের দেশ থেকে আসা অনুরাগিণীর ভালবাসার উপহার। অবশ্য তা যখন সম্পূর্ণ হয়েছে, না সে সময়, না তার পরে আর বাসু-বিজলীর দেখা হয়!
-"কোথায় আছেন এখন, জানো?"
-"নাঃ", মাথা নাড়েন বাসুদা।
-"জানতে ইচ্ছে হয় না, কোথায় আছেন, কেমন আছেন?"
আবারও সেই নির্বিকার "নাঃ"!
কিন্তু তারপর রাঙাধুলোর উঠোন কেমন থমকে থাকে। অলস ধোঁয়ার জাল ফিকে হয়ে এলে বাসুদা আনমনেই টেনে নেন জন্মসঙ্গী তারযন্ত্রটি, আনমনেই খেলা করে আঙুল, আনমনেই স্বর বেজে ওঠে সুর হয়ে, বাসুদেব দাস বাউল গাইতে থাকেন,
" খুঁজে যারে পেলাম না
তার জন্যে যে পাগল......"
এই গানটা বহুদিন হ'ল শুনি না আর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴