দাঁড়াবার জায়গা/দশ
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
সময়টা
ছিল অন্যরকম। ক্লাস ফাইভে পড়ি। ক্লাস চলাকালেই একদিন তুমুল শব্দে কেঁপে
উঠল বিশাল স্কুল ভবন। তারপরই চিৎকার, চেঁচামেচি। ক্লাসের বাইরে দৌড়ে
বেরিয়েছে সকলে, স্যররাও। দেখা গেল, স্কুলের বাইরে থেকে অনেকে মিলে হই হই
করে কাউকে ধরে আনছে ভেতরে। দেখা গেলো একটি ফর্সা মতো ছেলে। তার ঠোঁটের কষ
বেয়ে রক্ত ঝরছে। এরই মধ্যে সকলে মিলে তাকে বেদম প্রহার করেছে। একজন তার
চুলের মুঠি ধরে আছে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার। নিতাই স্যর এগিয়ে এসে
ছেলেটির সামনে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তুমি
নষ্ট করে দিতে চাও’! তাকে এনে একটি ঘরে বসানো হল। এই ভিড়ে স্কুলের
কাছাকাছি বাড়ি এমন অনেকেই আছেন। পুলিশে খবর দেওয়া হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই
পুলিশ এসে হাজির হলে আমরা অনেকেই সরে পড়ি। স্কুল ভবনের দোতলার একটি ঘরের
দরজার সামনে দেওয়ালের একটা জায়গায় হলদে-কালো ধোঁয়ার ছোপ লেগে আছে। যে তীব্র
আওয়াজে স্কুল ভবন কেঁপে উঠেছিল সেই আওয়াজের উৎস একটি বোমা! পুলিশ এসে সেসব
জায়গা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কীসব লিখে নিলো স্যরদের কাছে জিজ্ঞেস করে
করে। জানা গেল, ছেলেটির বাড়ি শহরের গান্ধী কলোনি এলাকায়। মাধ্যমিকের টেস্ট
পরীক্ষায় সে পাশ করতে পারেনি। ফলে, তার সেবার ফাইনাল পরীক্ষায় বসা হবে না।
একারণেই সে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। পুলিশের কাছেও সে এসব বলেছে। শিক্ষকদের
ওপরে, বিশেষ করে হেডস্যরের ওপরে তার ক্ষোভ। তাই, সে বোমা মেরেছে! কী অদ্ভুত
যুক্তি! শুনে অবাক হয়েছিলাম। তবে, বোমার যথেচ্ছ ব্যবহার তখন প্রায় জলভাত
ছিল বলেই বোমা নিয়ে বিস্মিত হইনি। সে এক দিন ছিল বটে! সে-সময়ে রোজই এখানে
সেখানে বোমা পড়ত। যেখানে সেখানে পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে মারপিট
নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো। ছুরিকাঘাতের ঘটনা আকছারই ঘটতো। অনেকেই প্রাণ
হারাতো। কিন্তু দু-চারদিনের মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে আসত। কদিন পরেই ফের
আরেকটি ঘটনা ঘটতো এবং আগের ঘটনাটি সবাই ভুলে যেত। গুণ্ডামি, খুনখারাপির
ঘটনাগুলো আপাত শান্ত, নিস্তরঙ্গ এই শহরকে বেশ চাগিয়ে রাখতো প্রতিনিয়ত।
একেকটি ঘটনা ঘটত আর ছোট ছোট মজলিশে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা হত। এসব আলোচনায়
উঠে আসত নতুন নতুন মস্তানের নাম। কে কত বড় মস্তান, কার বোমা কত শক্তিশালী,
কে দলে ভারী, কে কে কোমরে পিস্তল গুঁজে রাখে, কে কটা খুন করেছে-এসব ছিলো
অনেক আড্ডার আলোচনার কেন্দ্রে। এসব মস্তান বা গুন্ডাদের পেছনে যে রাজনৈতিক
দলের মদত থাকতো তা বলাই বাহুল্য। আমাদের স্কুলের কাছাকাছি এলাকায় গামা বলে
একজন ছিল। সুস্বাস্থ্য, পেশল শরীর, ফর্সা। প্রায়ই লাল রঙের টি শার্ট পড়তে
দেখেছি তাকে। শুনেছি, সে দু-তিনটি খুনের পর একদিন নিজেও খুন হয়ে গেল! একদিন
শুনলাম ষাটের দশকের কোচবিহারের ত্রাস লালু মস্তানের কথা। প্রতিদিনই নাকি
সে ভবানীগঞ্জ বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলা আদায় করত। তার দাবি
মেটাতে কেউ আপত্তি করলে মারপিট, এমনকি খুনোখুনিও হয়ে যেত। একদিন এক
মাছওয়ালা তাকে টাকা দিতে আপত্তি করলে তুমুল লড়াই বেঁধে গেল। নিরীহ
মাছওয়ালাকে মাটিতে ফেলে সে মারছিল। কিছুক্ষণ পর সে একটা ড্যাগার বের
করেছিল। এই দেখেই প্রহৃত মাছওয়ালা হঠাৎ করেই নিজের আঁশবঁটি উঠিয়ে লালুর
ঘাড়ে বসিয়ে দেয়! লালুর ধর-মুণ্ডু সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। লালুর
সঙ্গীরা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনার পর বাজারে তোলা আদায় বন্ধ ছিল
বহু বছর। মস্তানি করতে করতে, মারামারি, খুনোখুনি করতে করতে একেকটি ক্লাব,
একেকটি পাড়া রীতিমতো কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। শহর ও তার পার্শ্ববর্তী
এলাকাগুলো মোটেই নিরাপদ ছিল না সাধারণের পক্ষে। আবার, কোনও কোনও পাড়া বা
এলাকার নানা কারণে সুনামও ছিল। যেমন হাজরাপাড়া। এই পাড়ায় বসবাস ছিলো অনেক
গুণিজনের। দুর্গাপুজোয় যেমন রুচিশীল সজ্জা হতো তাদের, তেমনই নানা ধরনের
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত থাকত সারা বছর। আরেকটি এলাকা ছিল
পাটাকুড়া। খুব সুনাম ছিল তাদের। আর, এই নিয়ে এলাকার মানুষদের দারুণ
গর্ববোধও ছিল। আমাদের এলাকাতেও ছিল লুম্পেনদের প্রবল তৎপরতা। তারা সবাই
কিন্তু এলাকার নয়। প্রায়ই বাইরে থেকে এসে ঘাঁটি গাড়ত তারা। অদ্ভুত ব্যাপার
যে, শহর জুড়ে প্রতিদিনের এই সমস্ত অশান্তির সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার
কোনও সম্পর্ক ছিল না। বরং, লুম্পেনদের অরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত
রাজনৈতিক দলগুলো, বা স্পষ্ট করে বললে, নেতারা।
তখন
নকশাল শব্দটা শুনেছি। নকশাল শব্দের সঙ্গে কেমন একটা ফিসফিসানি, একটা
গোপনীয়তার সম্পর্ক তখন থেকেই লক্ষ্য করেছি। ওই বয়সে বিনয়-বাদল-দীনেশ,
মাস্টারদা, ক্ষুদিরাম প্রমুখের সঙ্গে মিলিয়ে বা গুলিয়ে ফেলতাম নকশালদের।
তাদের অসমসাহসী বীর, আত্মত্যাগী, প্রচুর পড়াশুনো করা, গালে ঝুঝকো দাড়ির
ঝোপ, উলোঝুলো চুলের মানুষ বলে মনে হতো। সবটাই কল্পনায়, কারণ কাউকেই তো
দেখিনি স্বচক্ষে। শুধু, শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে আলকাতরায় লেখা তাদের স্লোগান
দেখেছি। স্টেনসিলে ছাপ মারা টেকো মাথার মাও সেতুঙের ছবিও দেখেছি সেসব
দেওয়ালে।
তখন প্রায়ই
দেখতাম রাস্তায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে পুলিশের কালো ভ্যান
চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঝিমুত। যখন তখন কেন তাদের সেই ঝিমুনি, কেন তারা ওভাবে
ঘাপটি মেরে পড়ে থাকত বুঝতাম না। সেই গাড়িগুলো ছিল কালো রঙের। পেছনের
দিকটা জাল দিয়ে ঘেরা। গাড়ির ভেতরে অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকতো কয়েকজন খাকি
পোশাকধারী, সশস্ত্র মানুষ। তারা পুলিশ। এরকম ভ্যান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
ঝিমুতে থাকলে কাকপক্ষীও কাছে ঘেষতো না। এবাড়ি, ওবাড়ির উঠোন পেরিয়ে স্কুলে
যাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একদিন কী মনে করে স্কুলে যাচ্ছি স্বাভাবিক
রাস্তা ধরে। কয়েক মিটার যাবার পরই আমাকে ডাইনে বাঁক নিতে হবে। সেখানে
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের গাড়ি। রাস্তার পাশের গাছগাছালিতে
পাখিদের দেখতে দেখতে আমি আপন খেয়ালে যাচ্ছিলাম। ফলে, একেবারে কাছাকাছি আসার
পরই গাড়িটা নজরে পড়েছে। কালো গাড়িটা দেখেই কেন যেন আঁৎকে উঠি। আসলে,
নানা জনের কাছে পুলিশ এবং তাদের ভ্যান সম্পর্কে নানা বিবরণ শুনে এসেছি।
সেসব বিবরণ শিশুমনে আতঙ্ক সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু লক্ষ্য করি,
ভ্যানের পেছন দিকের চাকা ঘেষে কেউ শুয়ে আছে। প্রথমে মনে হয়েছে মৃতদেহ।
ভাবছি, কে লোকটা? সে কি খুন হয়েছে? কিন্তু রক্তটক্ত দেখা যাচ্ছে না। ভাবতে
ভাবতেই কখন যেন দাঁড়িয়ে পড়েছি। ভ্যান থেকে একজন বেরিয়ে এসে লোকটার পাশে
দাঁড়িয়ে বলে, ‘ওই, যা, ভাগ’। ঝালুর ঝুলুর, নোংরা কাপড়কানি জড়ানো লোকটা
একটু নড়ে উঠল যেন। তার মাথায় চুলের জঙ্গল, ধুলোমাটি মাখা। পুলিশের কর্কশ
নির্দেশেও তার কোনও তাড়া দেখা গেলো না। একবার মাথাটা উঁচু করে দেখে ফের সে
আগের মতোই শুয়ে থাকলো। পুলিশটা বুটপরা জুতো দিয়ে একটা খোঁচা দিয়ে বলল,
‘এখান থেকে ভাগ’। তাতেও কোনও কাজ হলো না। এবারে ভ্যান থেকে নেমে এল আরেকটা
পুলিশ। সে এসেই একটা লাথি কষাল শায়িত লোকটাকে লক্ষ্য করে। লোকটা হাউমাউ করে
চিৎকার করে উঠলো। আবার একটা লাথি। লোকটা এবারে উঠে দৌড়তে থাকল। তাকিয়ে
তাকিয়ে দেখছিলাম, সে দৌড়তে দৌড়তে ক্লাবের বারান্দায় গিয়ে উঠল। তখন
পুলিশটা হাসছিল। হঠাৎ আমার দিকে নজর পড়তেই ভ্রূ নাচিয়ে সে বলে, ‘কী দেখিস,
অ্যাঁ? স্কুলে যাচ্ছিস, যা’। আমি দৌড় লাগাই। অনেকটা দৌড়ে স্কুলের মাঠে
ঢুকে পড়ি। স্কুলে নিরাপদ বোধ করি। পেছনে তাকিয়ে ভাবি, এতদূরে নিশ্চয়ই আসবে
না পুলিশটা। সত্যিই পুলিশটা আমার পিছু নেয়নি। অনেকটা দৌড়ে আমি
হাঁপাচ্ছিলাম খুব।
সে
বছরের শেষদিকে একদিন মেজদার সঙ্গে একজন আমাদের বাড়িতে এলেন। তার নাম
অজিত। শুনলাম, আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ‘পাগলা’র বাড়িতে তিনি এসেছেন। বয়স
মেজদারই মতো হবে। আমরা তাঁকে অজিতদা বলে ডাকতে শুরু করলাম। খুবই আকর্ষণীয়
মানুষ। চমৎকার গল্প বলেন। তাঁর বাড়ি নদিয়ার শান্তিপুর। ‘পাগলা’র বাড়িতে
বিরাট তাঁতশালা। সেখানে তিনি তাঁত চালান, সেটাই তাঁর জীবিকা। অনেক পরে
শুনেছি, তিনি অত্যন্ত সক্রিয় এক রাজনৈতিক কর্মী। পুলিশি ধরপাকড়ের জেরেই
তিনি শান্তিপুরে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। তাঁর গল্পগুলো এত
আকর্ষণীয় ছিলো যে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। স্রেফ গল্পের টানেই আমি নিয়মিত তাঁর
কাছে যেতাম। তিনি তাঁত চালাতে চালাতেই নানা গল্প বলে যেতেন অবিশ্রান্ত।
তাঁর ক্লান্তিহীন বলে চলা সেসব গল্পে ভালোরকম রাজনীতি থাকত, পরে বুঝেছি।
কিন্তু সেই বয়সে গল্পই মনে হতো সেসব। একবার মেজদা আর অজিতদা আমাদের
দু-ভাইবোনকে রাসমেলায় নিয়ে গিয়েছিল। রাসমেলায় সেই প্রথম প্রচুর ঘোরাঘুরি,
কেনাকাটা করেছিলাম আমরা। আর, জীবনে প্রথম সার্কাস দেখেছিলাম। আলো ঝলমলে
বিশাল মঞ্চে খেলা হচ্ছে। সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়ে এসে কত রকমের খেলা
দেখাচ্ছে। শূন্যে বিছিয়ে রাখা একটি বিশাল জালের অনেক ওপরে ঝুলে আছে ছোট ছোট
মঞ্চ। ছাদ থেকে ঝুলছে দড়ি। ছেলেমেয়েগুলো ওইসব দড়ি ধরে এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্তে ছোটাছুটি করছে। শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে। এন্টারটেনমেন্টের এমন
ঠাসা প্যাকেজ আর হয় না। কোন শৈশবে দেখা সেসব দৃশ্য এখনও চোখ বুজলেই দেখতে
পাই। সার্কাসে হাতি, বাঘ, জলহস্তিদের নিয়ে খেলা দেখেছি। এখন অবশ্য
পশুপাখিদের দিয়ে খেলা দেখানো নিষিদ্ধ হয়েছে। ফলে, আকর্ষণ হারিয়েছে সাবেক
সার্কাস। এখন আমরাই সার্কাসের খেলোয়াড়। কেউ কেউ ক্লাউনও বটে। কে যে দেখে
কার খেলা!