তিস্তাবাথান-১০
তিস্তা বাথান
পর্ব : দশ
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
"""""""""""""'''''''''''''''''
আগেই বলেছি সে সময় একদিনে প্রায় ছয়-সাতটা মহিষকে টেনে নিয়ে যেত বাঘ। এতে প্রাণ হারাত বেশি ছোট মহিষেরাই। মহিষের পালকে একযোগে আক্রমণ করার মতো হিম্মত বা দুঃসাহস বাঘ বাবাজীদের ছিল না। মহিষের শিং-কে তারা ভয় পেত। মহিষের দলবদ্ধভাবে বাঘেদের আক্রমণের অনেক উদাহরণই রয়েছে। আশেপাশে বাঘ লুকিয়ে থাকলে তার উপস্থিতি মহিষের দল আগেই টের পেয়ে যেত। বাঘের গায়ের গন্ধই এর মূল কারণ বলে জানিয়েছেন মৈষাল বন্ধুরা। গন্ধ পেলেই সাবধান হয়ে যেত দলের দলপতি। তার কাছ থেকে সংকেতবার্তা পেয়ে বাকি মহিষেরাও ডাকাডাকি আর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিত। তখন এক একটি মহিষের পালে থাকত দুইশ’-তিনশ’ মহিষ। দলপতি ঐ একজন (পারা মহিষ)। তাই দলের পেছনে পরে যাওয়া আর দলছুট বাচ্চা মহিষেরাই ছিল বাঘেদের প্রধান টার্গেট। কত বাচ্চা মহিষ যে বাঘের পেটে গেছে তার কোনো হিসেব দিতে পারেননি মৈষাল বন্ধুরা । আজ তিস্তাচরে সেই বাঘের উৎপাত নেই। তিস্তা ঘেঁষা জঙ্গল ফাঁকা হয়ে গেছে। জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে উঠেছে। তবে কোনো কোনো সময় কুয়াশার মাঝে বাঘেরা পথ হারায়। শুধু বাঘেরা নয় অন্যান্য জীবজন্তুরাও পথ হারিয়ে ঢুকে পরে তিস্তাবক্ষে। এ কারণেই সকলকে একটা সাবধানি বার্তা দিয়ে দেই। ঘন কুয়াশার সময় রাতে তো কখনই নয়, দিনের বেলাও তিস্তার পাড় বরাবর অথবা ধাধিনা বরাবর একেবারেই হাঁটবেন না। কারণ জীবজন্তুরা পথ হারিয়ে সূর্যের আলোর অপেক্ষায় সেখানেই মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকে। এই তো মাত্র বছর সাতেক আগে তিস্তার চরে বাঘ ঢুকে পরা আর তাকে সামলাতে গিয়ে বা ধরতে গিয়ে ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট বা সমাজসেবী সংগঠনের নাকানি চোবানি আশা করি আমরা এখনও ভুলিনি।
গোলাবাড়ির বাথানের ঘটনাটা না বললেই নয়। তখনকার মৈষাল আমিরদা’র গলা এখনও শুকিয়ে যায় সেদিনের কথা মনে পরলে। বেচারা গোছা কাটতে ভাবনি বনের মাঝে ঢুকেছিল। ঘাস কাটতে কাটতে কেমন যেন একটা বুনো গন্ধ তার নাকে আসে। একটু পাশে তাকাতেই দেখে মাত্র বিশ-পঁচিশ ফুট আগে পেছন ফিরে শুয়ে আছে বাঘ মামা। বাঘ তো এর আগে অনেক দেখেছে আমির ভাই কিন্তু সে বাঘের আকৃতি দেখে আমিরদা’র হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায়। কোনো রকমে পা টিপে টিপে গছি-কাঁচি ফেলে প্রাণভয়ে ছুট লাগায়। ছুটতে ছুটতে এক্কেবারে বাথানের টং-এর মাথায় উঠে পড়ে। এত নাকি ভয় পেয়েছিল যে চিৎকার করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল আমিরদা। গলা শুকিয়ে পিপাসায় কাতড়াতে থাকে। ‘এত বাঘ দেখসি রে কিন্তু ঐদিন ঐটা যে কি বাঘ সিল। বাপরে বাপ’। টং-এর উপর থেকেই আমিরদা দেখেন যে ডাঙ্গায় দুধ দিয়ে সেই পথেই ফিরছেন পাশের বাথানের গজেন। বাঘ কিন্তু পথের মাঝে তখনও শুয়েই রয়েছে। চিৎকার করে গজেনকে সাবধান করবার ক্ষমতা নেই তখন আমিরদার। বুদ্ধি খাটিয়ে বহু কষ্টে টিন বাজিয়ে দূর থেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গজেনের। গজেন বুঝতে পারে। সে অন্য পথ ধরে টং-এর নীচে আসে। আমিরদা ইশারায় জল চাইলে গজেন জল নিয়ে উপরে ওঠে। সেই রেশ কাটতে নাকি তিন থেকে চারদিন লেগেছিল আমিরদার।
বার্ণিশের চরে-ও নাকি এমন বিশালাকৃতি একটি বাঘ বেরিয়েছিল। একথা বলেছেন বছর নব্বই-এর ফণীভূষণবাবু। সেই বাঘ ধরতে বা তাড়াতে হাতি আনা হয়েছিল শহর থেকে। এনেছিলেন তৎকালীন ইংরেজ সাহেবরা। ভাবনির বনে কয়েকদিন লুকিয়ে ছিল সেই বাঘ। বনের ভেতর সাহেবদের পোষা হাতিগুলি নাকি ঢুকতেই পারেনি। ভাবনির গোড়া ছিলো ভীষণ শক্ত আর ধারালো। এছাড়াও ভাবনি কাটার ফলে তার গোড়াগুলি ছিলো মারাত্মক ছুঁচালো। তখনকার সময়ে তিস্তাচরের এই ভাবনি কেটে ভাওয়ালি নৌকায় চাপিয়ে আনা হত এ’পারে। বার্ণিশ ঘাটের পাশে সারি সারি পিল করে রাখা হত। তারপর গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হত ডুয়ার্সের বিভিন্ন চা-য়ের বাগানে। যাই হোক - মূলত বাঘের গল্পই যেহেতু করছি তাই সুযোগ পেয়ে একটা কথা বলে রাখি। বারো বছর আগে কোনো এক বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যায় আপালচাঁদ জঙ্গলে আমি বাঘ দেখেছিলাম। কি ভাবছেন চিতা বাঘ? চিতা বাঘ হলে এ প্রসঙ্গে আসতামই না। আমার বাড়ির পাশেই গরুমারা অভয়ারণ্য। তাই কোনটি চিতা আর কোনটি চিতা নয় সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। ডুয়ার্সের সমতলের জঙ্গলে রয়াল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে, এই দাবি এর আগেও আমি বহু জায়গায় করেছি আজও করছি পাঠকবর্গের কাছে। আশা করি কোনো একদিন সেটা প্রমাণিত হবেই। যেমন কিছুদিন আগে ট্রাপ ক্যামেরায় রয়াল বেঙ্গলের অস্তিত্ব মিলেছে লাভা-লোলেগাঁও যাবার রাস্তায়। সেদিন আমার হাতে মোবাইল বা ক্যামেরা থাকলে আর একটা ইতিহাস হত। তিস্তাচরের যে দুই বাঘের কথা জানালাম সেই বাঘ যে সাধারণ আকৃতির লেপার্ড ছিল না সে কথা আশা করি আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴