চাঁদের সঙ্গে সহবাস/অমিত কুমার দে
চাঁদের সঙ্গে সহবাস
অমিত কুমার দে
মায়ালু গোলাই!
রাস্তাটা অনেকটা উঠে একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! বট পাকুড়ের ছায়ায় স্কাই ভিউ হোম স্টে-র সাইনবোর্ড নজরে এল। জায়গার নাম দেখে জানতে ইচ্ছে করল – এর মানে কি? হোম স্টে-র কর্ণধার রামপ্রসাদ সরকার কোজাগরী ছোঁয়া জ্যোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে পরে জানিয়েছিলেন – নেপালিতে এ কথার মানে ‘প্রেমের চক্কর’। অর্গানিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন – “বলুন, প্রেমের জন্য এর চাইতে ভালো জায়গা আর কি হতে পারে?”
লক্ষ্মী পূর্ণিমার আগের দিন দু চাকায় উদ্দেশ্যহীন বেরিয়ে পড়েছিলাম। আসলে একটা বড়সড় দুর্ঘটনার পর বহু মাস প্রিয় মোটরবাইকটার সঙ্গে বিচ্ছেদ ছিল! তার দিকে তাকালেই মনে হত মুখ ভার করে আছে বেচারী! কত একাকী ভ্রমণের সঙ্গী, কত কত পথ হারানোর সঙ্গী, কত কিছু আবিষ্কারের বন্ধু আমার! বাড়ির তুমুল আপত্তিকে বাড়িতে রেখেই অনেক দিন পর আবার নিসর্গের নেশায়।
খুনিয়া মোড়ে এলেই আমি বারবার ভেতরে ভেতরে খুন হই! চাপড়ামারির দিকে চাকা ঘুরতেই রোদ আর ছায়া আমাকে জালবন্দী করে জানতে চাইল – এত দিন পরে এলে কেন?
চাপড়ামারি রেলগেটে নিজের অফিসিয়া ঘরের বারান্দা থেকে রেলকর্মী শেখর হাত নেড়ে বলল – “শুভ বিজয়া দাদা। বনে যাচ্ছেন? ফেরার সময় থামবেন!” এখুনি বন চিরে দূরপাল্লা আসবে, সিগন্যাল নিয়ে ব্যস্ত সে।
দুটো ময়ূর আমাকে চেনা রাস্তা আবার দেখিয়ে দিল রঙিন পালকে! কিছুক্ষণ বাইকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ল একটা ধনেশ পাখি!
কুমানীতে এসে একটু দাঁড়ালাম। যেমন আগেও বহুবার দাঁড়িয়েছি। ডানদিকে ঝালং-এর পথে অনেকবার গেছি। আজ বাঁদিকে নেমে পড়লাম। কিছুটা যেতেই ঘোর লাগল। সবুজের, আর নীল পাহাড়ের!
সেই ঘোরই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। যেন নিরুদ্দেশের দিকেই! অবশ্য গৌরীদা (ভ্রমণলেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য) আগেই বলেছিলেন –“ওদিকে গেলে অবশ্যই রামপ্রসাদের সাধনপীঠে যাবে!” সাধনপীঠই বটে। পাহাড়ে উঠে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নামলেই যেন স্বর্গে পৌঁছনো! ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ। সামনের ক্যানভাসে চোখ পাততেই কাছে দূরে এক ঝাঁক নদী – মূর্তি, কুমাই, জলঢাকা, ন্যাওড়া, ডায়না, মালনদী। চোখের সামনেই অর্গানিক কুমাই চা-বাগিচা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সামসিং বাগানের নতুন ও পুরাতন ফ্যাক্টরী।
পড়ন্ত রোদে অসংখ্য গাছের ছমছমে ভিড়। আঙুল তুলে রামপ্রসাদ দেখালেন – “এখানে দাঁড়িয়ে কত ওপর থেকে পুরো চাপড়ামারি বীট দেখা যাচ্ছে, দেখুন!” আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবছি – এক প্রিয় অরণ্যের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছি! ওর ভেতরে এত এত হাতি, গন্ডার, বাইসন, চিতা, সম্বরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে?
ফিরবার ইচ্ছেটা হারিয়ে গেল নিমেষে! রামপ্রসাদবাবুকে বললাম – “আজ যদি থেকে যাই?” তিনি যেন কথাটা লুফে নিলেন – “ফিরবার কি দরকার এই সন্ধেবেলায়? একটু পরেই চাঁদ উঠবে, দেখবেন কী অসামান্য! থেকে যান দাদা, আজ পুরো হোম স্টে খালি আছে।” অর্থাৎ ফেরার পরিকল্পনা বানচাল।
সামনের সবচেয়ে লম্বা গাছটার ডালে বিশাল ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ময়ূর এসে বসল। পশ্চিম আকাশ ডুবন্ত সূর্য-র কাছ থেকে কত লক্ষ কোটি রঙ পেল কে জানে! আর তার মধ্যেই পুব আকাশ অন্যরকম করে দিয়ে ভুটান পাহাড়কে পেছনে ফেলে চাঁদটা উঠে পড়ল।
চেয়ার পেতে বসেছিলাম একটা খোলা ছাদে। চাঁদ পুরো দখল নিয়েছে আমাদের। রামপ্রসাদ এক ডিসে সাজিয়ে এনেছেন আপেল, পাকা পেয়ারা। আরেক ডিসে টাটকা বোরোলি মাছ ভাজা। ভরা কাপে অর্গানিক চা। দীপাবলীর মতো জ্বলে উঠেছে কত দূরে মালবাজারের আলো, নাগরাকাটা ঝালং বিন্দু-র বাতিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রামপ্রসাদ বললেন – “কোনো কোনো দিন গজলডোবার আলোও দেখা যায় এখান থেকে।”
মায়ালু গোলাই-এ বসে আমরা একটা প্রেমের গল্পই করছিলাম সেই রাতে। আসলে রামপ্রসাদ বলছিলেন, আমি চুপ করে শুনছিলাম। দিনে দু’বার ইনসুলিন, তেরো খানা রকমারি ট্যাবলেট গিলেও কী প্রাণশক্তি। কে বলবে দিন দশেক আগেই চেন্নাই থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরেছেন! পাহাড়ি পথে ল্যান্ড-রোভার ছুটিয়ে এসেছেন কিছুক্ষণ আগে! শুনলাম আরো কতগুলো হোম-স্টে আর আধুনিক হোটেল তৈরির সংকল্পের কথা!
শুনছিলাম – এখানের তুমুল বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার গল্প। কীভাবে পাগলা বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁট এসে আছড়ে পড়ে তাঁর এই আকাশছোঁয়া বাসায়!
আজ অবশ্য আকাশ চাঁদের দখলে। টবের ফুলগাছ ও পাতাবাহারে জল দিয়ে একসময় রামপ্রসাদ চলে গেলেন রান্নার আয়োজনে। আপাতত আজ কোনো কাজের লোক নেই। তাতে ক্ষতি কি! তিনি নিজে রেঁধে ফেলতে পারেন ষোল আনা সুস্বাদু বাঙালি খানা। রেফ্রিজরেটর ভরিয়ে রেখেছেন ইলিশ, পাবদা, আড়, চিংড়ি, বাটা, বোরোলি, চিকেন, মাটন ইত্যাদিতে। রান্নাঘরের মেঝেতে তাঁর নিজের ফলানো অর্গানিক কোয়াশ, মিষ্টি কুমড়ো ইত্যাদি। হাসতে হাসতে বললেন – “ডালের বড়ি দিয়ে আমি যা শাক রাঁধতে পারি, মুখে দিলে জীবনে ভুলবেন না। আর ব্রেকফাস্টের জন্য আমি একটা সারপ্রাইজ আইটেম বানাই, আমার মস্তিষ্কপ্রসূত, নাম নেই! খেলে তারিফ করবেনই!”
চাঁদস্নান সেরে ঘরে এলাম। খাদের দিকটায় এক ফালি বারান্দাও আছে। চার জনের শোবার ঘরে আজ রাতে আমি একা। একটা দেয়াল প্রায় পুরো কাচের, দরজা জানালা সব এক মাপের। বিছানায় শুয়েই পুরো আকাশ দেখা যায়, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা চোখের সামনে! বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসলাম। কতকাল পর নিজের সঙ্গে নিজে। এই একা হয়ে যাওয়াটা যে কত জরুরি – আবারো অনুভব করলাম! ঠান্ডা বাতাসে নাগরিক মালিন্য কখন ধুয়ে মুছে গেল! মূর্তি নদীর সিম্ফোনি আর পাহাড়ি ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। আহা!
প্রায় গোটা রাত জেগে থাকলাম। বারান্দা থেকে বিছানায় শরীর ঢেলে দিতেই এক অন্য প্রশান্তি। গোটা বিছানা জুড়ে জ্যোৎস্না! চাঁদ এসে কখন শুয়ে পড়েছে আমার সঙ্গে, ধবধবে সাদা বিছানায়! এমন রাতে ঘুমোনো যায়? রাত যত বাড়ছে, দরজা-জানালার কাচে চোখ রেখে মনে পড়ছে রামপ্রসাদের কথা – “এখানে কখনো কখনো চিতাবাঘ আসে!” কাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা বড় মাকড়সা। ভূতপ্রেতে অবিশ্বাসী মানুষটারও কেমন গা ছমছম করতে লাগল। যদি কেউ এসে কাচ ধরে দাঁড়ায়! হোম স্টে-র চারখানা ঘরের একটিতে শুধু আজ একজন! এক অদ্ভুত গা-ছমছম শিহরণে আমি বিছানায় শোয়া চাঁদকে জড়িয়ে ধরলাম!
ভোরে চোখ লেগে গেছিল। ময়ূর আর মোরগের ডাকে উঠে পড়তেই বিস্ময়। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এই সব স্বর্গরঙ কথায় বা ছবিতে ধরা যায় না। একদিকে রমনক্লান্ত নিস্তেজ চাঁদ, অন্যদিকে সূর্যের প্রস্তুতি। অসংখ্য পাখি ডাকছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর ঘর ছেড়ে সেই খোলা ছাদে এসে দাঁড়ালাম। গাছের রঙ পাল্টাচ্ছে, নদীর রঙ বদলাচ্ছে। দিন এসে চাঁদকে সরিয়ে দিল। কুমাই বাগানে সাইরেন বাজল। হোম স্টে-র পাশের সিঁড়িরাস্তা দিয়ে কুলিকামিনরা ছুটতে ছুটতে নামছে, কাজে চলেছে। চা নিয়ে পাশে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন রামপ্রসাদ। “পুজোর পর আজ বাগান খুলছে। রাতে ঘুম হয়েছিল তো?”
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴