চা-ডুবুরি : পর্ব :১০
সুকান্ত নাহা
~~~~~~~~~~
পরবাসে পা
জটেশ্বর
স্কুলে পড়াকালীন শেষের দিকে সত্যপ্রিয়কে বিনোদবিহারী নিজের কাছে নিয়ে
গেলেন। জটেশ্বরে ব্যবসা শুরু করার পর বিয়ে করে সেখানেই ঘর ভাড়া
নিয়েছিলেন তিনি। সতুকে রোজ এতটা পথ হেঁটে যেতে হয় দেখে একদিন তিনি তাঁর
বৌঠানকে প্রস্তাব দেন ,'সতুকে অখন আর হাঁইটা অদ্দূর স্কুলে যাইতে হইব না। ও
আমার কাছে থাউক। ওখান থিকাই স্কুলে যাইবো। কি, রে সতু থাকতে পারবি তো
আমাদের সাথে?' '। সত্যপ্রিয় লক্ষ করেছিল যে ছোটকা বাবা-মায়ের সাথে দেশের
ভাষায় কথা বললেও তার সাথে সবসময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন । তেমনি বাবা
মা-ও তার সাথে কখনও বাঙাল ভাষা বলতেন না। ছোটকা পছন্দের মানুষ। নতুন
কাকিমাও যেমন সুন্দরী তেমনি স্নেহপ্রবণ। তাই এককথায় যেতে রাজি হয়ে যায়
সত্যপ্রিয়।
জটেশ্বরে কাকা কাকিমার আদরে দিনগুলো বেশ
আনন্দেই কাটছিল। কাজলিডাঙায় মা-বাবার সান্নিধ্যে স্নেহমমতার ছায়ায় থেকেও
সত্যপ্রিয়র মনের ভেতর একটা দুঃখবোধ সবসময় সেতারের করুণ রাগিনীর মত বেজে
চলত। সে সময় মনে হত নির্বান্ধব,নিঃসঙ্গ জীবনটাই বোধহয় সেই বিষাদের উৎস।
ভুল ভেঙেছিল দীর্ঘদিন বাদে। ঘটনাচক্রে বহু চেষ্টা করেও যেদিন সুনয়নী ছেলের
কাছে আর আড়াল রাখতে পারলেন না সংসারের আর্থিক অনটনের ছবিটা, সেদিন
সত্যপ্রিয়ও উপলব্ধি করে কেবল নিঃসঙ্গতা নয়, নেপথ্যে কোথাও হয়ত আর্থিক
দৈন্যতাও ছিল সেই দুঃখবোধের কারণ।
দুঃখ যাকে তাড়া
করে ফেরে সুখ তার অদৃষ্টে বেশিদিন স্থায়ী হয় না। সুখের ভাঙনও তাই অচিরেই
শুরু হল যেদিন মাত্র কয়েক দিনের অসুখে মারা গেলেন কাকিমা। তেরো বছর বয়সে
জীবনে প্রথম প্রিয়জন বিয়োগ। সত্যপ্রিয়র মনে আছে ছোটকাকিমার মৃত্যু
ভীষণভাবে আঘাত করেছিল তাকে। শ্মশানে সেই সুন্দর শরীরটা যখন আগুনের গ্রাসে
একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিল, পাথরের মত সেদিকে তাকিয়ে বসেছিল
সত্যপ্রিয়। বুক ফেটে কান্না এলেও জল গড়ায় নি চোখে একটুও। ভবিষ্যতে আরো
অনেক শোক সহ্য করতে হবে বলেই কি সেদিন ঈশ্বর হৃদয়টা কাছিমের শক্ত খোলসে
পরিণত করে দিয়েছিলেন, প্রশ্নটা ইদানিং এলোমেলো বাতাসের মত মনের ভেতর
ঘুরপাক খায় সত্যপ্রিয়র।
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর
বিনোদবিহারী উদভ্রান্তের মত হয়ে পড়েছিলেন। কুমুদ-সুনয়নীর বহু অনুরোধেও
বহুদিন বিয়ে করেননি। ব্যবসাতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখনই একদিন
কুমুদরঞ্জন স্থির করলেন সত্যপ্রিয়কে বিনোদের সাথে পলাশপুরের গ্রামের
বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। ওখানেই সত্যর মামাবাড়ি। কাছেই নিজেদের গ্রাম
বহরপুর। গ্রামের বাড়িতে কটা দিন কাটিয়ে বিনোদের মনটা ভাল হলে ও ফিরে আসবে
আর সত্যপ্রিয় রয়ে যাবে পলাশপুরে। কাছেই বালিয়াকান্দি স্কুল। ওখানে
ক্লাস সেভেনে ভর্তি হবে সত্য।
সত্যপ্রিয়র
বেশ মনে আছে,দিনটি ছিল শুক্রবার, যেদিন জীবনে প্রথম সে কাজলিডাঙা ছেড়ে
বাইরে বের হলো।সকাল দশটা নাগাদ ছোটকার সঙ্গে ফালাকাটা থেকে বার্ণেশগামী
বাসে উঠে দুপুর নাগাদ বার্ণেশঘাটে পৌঁছেছিল দুজনে। ছোট্ট টিনের বাক্সে মা
গুছিয়ে দিয়েছিলেন একটিমাত্র জামা, একটি প্যান্ট, একটি চাদর, কিছু বইপত্র।
সেটি হাতে করে বার্ণেশ ঘাটে নেমে কিশোর সত্যপ্রিয় প্রশ্ন করে কাকাকে,
'এবার আমরা কোথায় যাব কাকা? '
কাকা উত্তর দেন, 'এখন আমরা তিস্তা পেরিয়ে যাব জলপাইগুড়ি। ঐ দেখ্ সামনে তিস্তা। '
চোখ
তুলতেই সামনে বিস্তির্ণ নদীখাত চোখে পড়ে। পৌষের দুপুরে হালকা কুয়াশা নরম
চাদর বিছিয়েছে নদীর বুকে। আদুরে রোদে মাঝনদী অবধি বিস্তৃত স্থির জলরাশি
চিকচিক করছে। শীত পড়তেই নদী এখন শান্ত।অথচ বর্ষায় এই নদীই নাকি দুকূল
ছাপিয়ে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ওপারে অস্পষ্ট বালুচর। চরের বুকে ইতিউতি কাশের
বন। চরের শেষ কোথায় কুয়াশার পর্দা ভেদ করে তা দেখা যায় না।
' ওপারেই জলপাইগুড়ি, ছোটকা?'নদীর দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে সত্যপ্রিয় প্রশ্ন করে।
-' হ্যাঁ, ওইপারে কিং সাহেবের ঘাট। ওইখানেই যাব আমরা। চল,পা চালা। টিকিট কাটতে হবে। ' বিনোদবিহারী তাড়া লাগান ভাইপোকে।
কিং
সাহেবের ঘাট! কে কিং সাহেব? তিনি কি ঐ ঘাটে বাস করেন! খুব জানতে ইচ্ছে
করছিল সত্যপ্রিয়র। কিন্তু ছোটকা এখন ব্যস্ত হয়ে ছুটেছেন টিকিট কাটতে।
পেছন পেছন বাক্স নিয়ে তাল মিলিয়ে কাকার পেছনে ছোটে সত্যপ্রিয়।
টিকিট দুটো পকেটে রাখতে যাচ্ছিলেন বিনোদবিহারী। চোখে পড়তেই সত্যপ্রিয় বলে, ' দেখি-দেখি কেমন টিকিট... '
চৌকো
মোটা কাগজের টিকিট দুটো হাতে পেয়ে উল্টে পাল্টে সত্যপ্রিয় বলে, ' এ মা, এ
তো রেলের টিকিট! রেল কোম্পানির নাম লেখা আছে! আমরা কি রেলে চেপে পার হব? '
-' না রে... এই ফেরিঘাটের দায়িত্ব হল রেল কর্তৃপক্ষর। তাই রেলের টিকিটেই পারাপার করতে হয়। চলে আয়। '
তীরের
উঁচু পাড় থেকে ঢালু জমি খানিকটা নেমে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন
ধরনের কয়েকটা নৌকো। ছোট খেয়ানৌকো গুলোর ভাড়া এক আনা। খেয়ানৌকোয়
যাত্রীদের ভীড় বেশি। বড় ছাউনি দেয়া নৌকোও চোখে পড়ে। ওতে নাকি ভাড়া
বেশি। অবস্থাপন্ন মানুষ আর সাহেবরাই নাকি কেবল চলাচল করে ঐ নৌকোয়। বাবার
মুখে শুনেছিল সত্যপ্রিয় কখনও সখনও স্টিমারও দেখা যায় তিস্তার বুকে। একটা
মজার ব্যাপার চোখে পড়তেই সত্যপ্রিয় উৎফুল্ল হয়ে উঠে কাকার দৃষ্টি আকর্ষণ
করে, 'দ্যাখো-দ্যাখো ছোটকা, নৌকোয় গাড়ি চেপেছে! '
দুটি
বড় মাপের চওড়া নৌকোর মাঝে কাঠের পাটাতন পেতে তার ওপর দুটি গাড়ি উঠিয়ে
ওপারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে কিশোরমনে বিস্ময় সৃষ্টি হয়।
'
হ্যাঁ, এইভাবেই চা-বাগানের সাহেবরা সদরে যাতায়াত করে। বাগান থেকে গাড়িতে
এসে ওরা নৌকোয় গাড়ি চাপিয়ে ওপারে নিয়ে যায়। কাজ সেরে আবার এভাবেই
ফিরে আসে।' বিনোদবিহারী ভাইপোকে বুঝিয়ে দেন। সত্যপ্রিয় দেখে গাড়ি দুটোর
পাশে সত্যিই দুজন ইংরেজ সাহেব দাঁড়িয়ে নৌকোর পাটাতনের ওপর।
'
চল তাড়াতাড়ি, দেরি করলে নৌকোয় জায়গা পাবি না। ' বিনোদ তাড়া লাগান
ভাইপোকে। একটা খালি খেয়ানৌকো নিয়ে মাঝি দাঁড়িয়ে ছিল ঘাটে। তাড়াতাড়ি
দুজনে গিয়ে নৌকোয় উঠে বসতেই কিছুক্ষণের মধ্যে আরো যাত্রী এসে পড়ে। লগি
ঠেলে মাঝি নৌকো ভাসায় মাঝদরিয়ায়। শীতেও মাঝনদীতে বেশ জল। হেলতে দুলতে
গুটিকয় যাত্রী নিয়ে নৌকো এগোয়। পড়ন্ত বেলায় মাঝ তিস্তায় শীতের মিষ্টি
রোদ ছাপিয়ে উত্তুরে হাওয়া শরীরে কাঁপন ধরায়। সত্যপ্রিয়র পরনে কেবল
ফুলসার্টের ওপর হাফসোয়েটার আর হাফপ্যান্ট। বিনোদবিহারী জামা-ধুতির ওপর
একটা কালো ওয়েস্ট কোট চাপিয়েছেন। শীতবস্ত্র বলতে ওটুকুই। যেতে যেতে মনে
চেপে রাখা প্রশ্নটা ফের চাড়া দেয় সত্যপ্রিয়র মাথায়,
-' কিং সাহেব কে ছোটকা? '
বিনোদবিহারী
কিং সাহেবের গল্প শোনান। সত্যপ্রিয় শুনতে থাকে। কিং সাহেব ছিলেন একজন
পাটের ব্যবসায়ী। নদীর কাছাকাছি কোথাও একটি কাঠের বাংলোয় তিনি থাকতেন।
বিয়ে করেছিলেন এ দেশেরই একটি নেটিভ মেয়েকে। তাকে তিনি ভীষণ ভালবাসতেন।
একদিন নৌকোয় চেপে মেয়েটি তিস্তা পার হচ্ছিল। সেসময় তিস্তার রূপও ছিল
ভয়ংকর। বর্ষায় তিস্তার ভরা যৌবন। মাঝনদীতে হঠাৎ সেদিন ঝড় ওঠে । উত্তাল
হয়ে ওঠে তিস্তা। নৌকা ডুবে যায়। মেয়েটিও তলিয়ে যায় তিস্তার অতল জলে।
স্ত্রী কে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে যান সাহেব। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই নেশা
করে বন্দুক হাতে তিনি চলে আসতেন তিস্তার পাড়ে। এসে অপেক্ষা করতেন কখন একটা
বড় ঢেউ আসবে। ঢেউ এলেই তিনি গুলি ছুঁড়তেন ঢেউ লক্ষ করে। লোকে অবাক হয়ে
দেখত পাগল সাহেবের কীর্তি। অবসাদগ্রস্ত হয়ে একদিন সাহেব নিজেকে গুলি করে
আত্মহত্যা করেন। তিনি মারা গেলে ঐ ঘাটের নাম হয়ে যায় কিং সাহেবের ঘাট।
গল্প
শুনতে শুনতে কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকো চরের কাছে পৌঁছে যায় । চরটা খানিক
উঁচু। যাত্রীরা সব একে একে নেমে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটে যায়।
সামান্য তাড়াহুড়োয় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত সেদিন। সত্যপ্রিয়র মনে আছে
বিনোদবিহারী নেমে ভেবেছিলেন ভাইপোটিকে হাত ধরে নামাবেন। কিন্তু তার আগেই সে
লাফ দিয়ে বসে। লাফ দিতে পাড়ের নরম ঝুরঝুরে বালি ধসে গিয়ে শরীরটা সরসর
করে নেমে যাচ্ছিল জলের দিকে। খালি নৌকো পায়ের চাপে কিছুটা পেছনে সরে
গিয়ে ফের পাড়ে আঘাত করার জন্য ছুটে আসছিল দ্রত। কিন্তু তার আগেই চটপট
বাঁশের লগি পাড়ে ঠেকিয়ে নৌকোর গতিরোধ করে সত্যপ্রিয়কে তুলে ধরে মাঝি।
জামাকাপড় বালিতে মাখামাখি হয়ে যায়। পাল্টে আরেকটা যে পড়ে নেবে সে
উপায়ও নেই। বাক্সে মাত্র এক প্রস্থ কাপড়। সেটাও বাইরে পড়ার মত নয়।
' খুব বাঁচা বেঁচে গেলি। ওভাবে লাফাতে গেলি কেন? ' বিনোদবিহারী খানিকটা যেন ক্ষুন্ন হন।
'
গা-টা ঝেড়ে নে। এই কাপড়েই যেতে হবে। উপায় নেই। চল এবারে আমাদের হাঁটতে
হবে। ' বলেই হাতে বাক্সটা নিয়ে বিনোদবিহারী হাঁটতে শুরু করেন। জামা
কাপড়ের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে সত্যপ্রিয় তাকে অনুসরণ করে। হাঁটতে হাঁটতে
সত্যপ্রিয় দেখে চরের ওপর কাশবনের ভেতর দিয়ে বিকট শব্দ করে অদ্ভুত দেখতে
কিছু গাড়ি চলছে। গাড়িগুলো পুরনো, লড়ঝড়ে। মোটা ক্যানভাসের ছাউনি। স্পোক
লাগানো বড় বড় চাকা। আদ্যিকালের ফিটন গাড়ির মত ছোট দরজা। বাইরে পাদানিতে
একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। পেছনে মালপত্র রাখার লাগেজ- ক্যারিয়ার। গাড়ির
ভেতরে লোক বসে আছে খড়ের গদীর ওপর রেক্সিন মোড়া সিটে। গোঙাতে গোঙাতে ছুটছে
গাড়ি গুলো।
-' গাড়িগুলো কোথায় যাচ্ছে ছোটকা? 'সত্যপ্রিয় অবাক চোখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-'কিং সাহেবের ঘাটে...। ' বিনোদ জবাব দেয়।
- আমরা তবে গেলাম না কেন গাড়িতে? '
-'
ওই ঘাটের-মড়া গাড়িতে চাপলে আর দেখতে হবে না। ঝাঁকুনির চোটে শরীর ব্যথা
হয়ে যাবে। একটু বাদেই ঘাটে পৌঁছে দেখবি গাড়িগুলোর মুখ দিয়ে কেমন আগুন
বের হচ্ছে । ' তেমনটা অবশ্য সেদিন চোখে পড়েনি। আসলে বেশি ভাড়া দিয়ে ঐ
গাড়িতে চড়ার সামর্থ্য ছিল না বলেই যে ছোটকা ও কথা বলেছিলেন সেটা পরে
বুঝেছিল সত্যপ্রিয়। তবে ছোটবেলায় দেখা ঐ গাড়িগুলো সম্পর্কে কৌতূহল
থাকায় সত্যপ্রিয় পরে আরো জেনেছিল গাড়িগুলো আর্মি অকশন থেকে নিলামে কেনা
হত। সামনে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট না করলে চলত না। কাঠ দিয়ে বেঁধে না
রাখলে গাড়িগুলোর গিয়ার অবধারিত ফেঁসে যেত। আর স্টিয়ারিং-এ হাত রাখলে
ড্রাইভার সুদ্ধ স্টিয়ারিং কাঁপত থরথর করে।
ওপারে
পৌঁছতেই দুজনেরই ক্ষিদে চাগাড় দিচ্ছিল পেটে। বিনোদবিহারী তাই ভাইপোকে
সাথে করে ঢুকলেন কাছাকাছি হিন্দু নিবাস হোটেলে। সেখানে মেঝেতে কলাপাতায়
পাত পেড়ে বসে চারটে ডাল-ভাত খেয়েই তড়িঘড়ি স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হতে
হল। বিকেল পাঁচটায় ট্রেন। হাতে তখনও ঘন্টাখানেক সময়। 'ট্রেন কখন আসবে',
'কোনদিক দিয়ে আসবে', কোনদিকে যাবে' ভাইপোর এমন নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে
দিতে একসময় বেঞ্চে বসেই চোখটা লেগে গেছিল বিনোদের। সেই ফাঁকে
প্ল্যাটফর্মের এ পার থেকে ওপার হেঁটে-হেঁটে অচেনা চারপাশটা মন দিয়ে দেখছিল
কিশোর ছেলেটা। হঠাৎ একসময় দূরে বাঁকের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে কালো দৈত্যটা
হুইসেল দিয়ে দৃশ্যমান হতেই অবাক চোখে থমকে যায় সে। তারপর ঘোর কাটতেই ছুটে
আসে কাকার কাছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ' ছোটকা, ঐ যে...দ্যাখো...এসে
গেছে... '
-' দাঁড়া হড়বড় করিস না। ট্রেন থামব
এইখানে কিছুক্ষণ । ধীরেসুস্থে উঠব আমরা। ' ধসধস শব্দ করে প্লাটফর্ম ছোঁয়
গাড়িটা। ছেলেটা অবাক চোখে তাকায়। আরো বিস্মিত হয় দেখে যে ট্রেনের
ড্রাইভার একজন সাদা চামড়ার ইংরেজ। আর ইঞ্জিনে যে কয়লা দিচ্ছে সে-ও খাঁটি
সাহেব। যে ধোপদুরস্ত ইউরোপিয়ান সাহেবরা চা-বাগানে দন্ডমুন্ডের কর্তা তারাই
কিভাবে ঝুল কালি মেখে এ কাজ করছে দেখে হাঁ হয়ে যায় ছেলেটা। আঙুল তুলে সে
কাকাকে দেখায়, 'দ্যাখো, দ্যাখো ছোটকা.... সাহেব গাড়ি চালাচ্ছে'
কাকা নরম সুরে ধমক দেন, ' আঙুল দেখায় না। সাহেব তো কী? ঐটাই ওর কাজ। '
ট্রেন
থামে। থার্ড ক্লাসের কামরায় উঠে পড়ে দুজনে। খুব একটা ভীড় ছিল না
গাড়িতে।খানিক বাদে গাড়ি ছেড়ে দেয় । জ্ঞান হয়ে সেই প্রথম ট্রেনে চাপা
কিশোর ছেলেটার। একে একে হলদিবাড়ী, চিলাহাটি, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর হয়ে
রাত দুটোয় পোড়াদহ স্টেশন। ঘুমিয়ে পড়েছিল ছেলেটা। মনে পড়ে ঘুম থেকে
তুলে কাকা সেদিন দেখিয়েছিলেন, ' সতু ওঠ্, দ্যাখ... সাড়া ব্রিজ পার হচ্ছি
আমরা... ' পদ্মার ওপর সেই ব্রিজ পেরোতে পুরো পাঁচ মিনিট সময় লেগেছিল।
বিস্ময়ের ঘোর লাগা চোখে অন্ধকারে পদ্মার সীমাহীন বিস্তার অনুভব করতে পেরে
রোমাঞ্চ জেগেছিল মনে ছেলেটার।
পোড়াদহে
নেমে প্ল্যাটফর্ম বদল করতে হতো। অন্য প্ল্যাটফর্মে যেতে না যেতেই কলকাতার
দিক থেকে এসে পড়ল ঢাকা মেল। তিন মিনিট স্টপেজ। লাল রঙের বিশাল ট্রেনটার
সব দরজা জানালা বন্ধ। বাইরে রাতের কনকনে শীত। হাত-পা জমে যাচ্ছিল ছেলেটার।
হাতে বাক্স নিয়ে দরজায় দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন ভদ্রলোক, ' একটু খোলেন
দয়া করে খোলেন... শুনছেন.. ও দাদা দরজাটা খোলেন,সাথে বাচ্চা আছে, ...ও
দাদা... দরজাটা খোলেন'। ট্রেন চলতে শুরু করে দেয়। দরজা খোলে না। চোখের
সামনে দিয়ে বন্ধ দরজা জানালা নিয়ে ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে যেতেই কাঁদোকাঁদো
হয়ে পড়ে ছেলেটা।
ভদ্রলোক আশ্বাস দেন ছেলেটিকে, 'মন খারাপ করিস না... কাল সকালে আরেকটা ট্রেন আসবে। সেইটাতে যাব আমরা। চল ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি। '
ওয়েটিং
রুমে চাদর পেতে শুইয়ে দেন ভদ্রলোক ছেলেটিকে। একটু বাদেই ছেলেটা ঘুমিয়ে
পড়ে। ভোর হতেই লোকজনের কোলাহলে তার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙতেই স্টেশনের বাইরে
রোদ ঝলমলে অপরূপ প্রকৃতি ধরা দেয় ছেলেটার চোখে। রেললাইনের ধারে যতদূর চোখ
যায় শুধু শস্যের ক্ষেত। ধান ক্ষেত গুলো থেকে ধান কেটে নিয়ে যাওয়া
হয়েছে।কিছু ক্ষেতে কাটা ধানের আঁটি উপুড় করে রাখা। ঘাসে ডগায় ভোরের
কুয়াশায় রোদ ঠিকরানো হীরের ঝলক। আলপথ বেয়ে কাঁধে লাঙল, লাঙলে বাঁধা
হুঁকো, মাথায় মাতলা... চাষী চলেছে কাজে। দূরে দূরে খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি
ঝুলছে। চা বাগানের বৃষ্টি ভেজা সবুজ প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা ছেলেটাকে ভোরের
শিশির ভেজা অচেনা গ্রামীন চালচিত্র যেন মুগ্ধ করে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে
থাকতে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলে ছেলেটা। এমন সময় পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকে, '
সতু... সতু... কী দেখছিস ওইদিকে। আয়...মুখ ধুয়ে চা খেয়ে নে। '
সকাল
নটায় চিটাগাং মেল আসে। সেই ট্রেনে চেপে কালুখালী। সেখান থেকে ট্রেন বদলে
সন্ধে নাগাদ বহরপুর স্টেশন। স্টেশন থেকে খানিকটা পায়ে হেঁটে যেতে হবে
মামাবাড়ির গ্রামে। ভাইপোকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে বিনোদবিহারী ফিরে আসবেন
নিজের গ্রামে। মাটির রাস্তা ধরে যেতে হবে। চারপাশে ধু-ধু মাঠ। চা-বাগানের
মত এখানে ঘন গাছপালা নেই। ইতস্তত ঝোপঝাড়। বিনোদবিহারী কাছেই একটা মাটির
বাড়িতে ঢুকে কয়েকটা পাটকাঠি নিয়ে এলেন। তারপর সেগুলো একসাথে জ্বালিয়ে
সেই আলোয় পথ চলতে লাগলেন । বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে
তিনি দাঁড়ালেন। বাড়িটার উঁচু দাওয়া। খোড়ো চাল। কাকা কারো নাম ধরে
ডাকলেন। অনেক ক্ষণ ডাকাডাকির পর একজন বেরিয়ে এলেন হাতে কুপি নিয়ে। কুপির
আলোয় ছেলেটা দেখে সাধারণ একটা শাড়ি পরিহিতা, মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক
মহিলা । কাছে এসে দাঁড়াতেই মুখটা পরিস্কার দেখা গেল। মহিলা কুপিটা একটু
উঠিয়ে তাদের দিকে আলো ফেলে বললেন, 'ওরে, তোরা আসছিস...আয় আয় ভিতরে আয়। '
ছেলেটার পা সরে না। অবাক চোখে মহিলাটিকে দেখতেই থাকে। এও সম্ভব! এত মিল
মানুষে মানুষে হতে পারে! নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেনা ছেলেটা। ছুটে গিয়ে
মহিলাটির কোমর জড়িয়ে বলে ওঠে, ' মা... মা গো... তুমি এইখানে! '