আমি এক যাযাবর-১০/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
১০ম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
সিকসিন ইকো হাট হোমস্টের থেকে পনেরো কুড়ি পা দূরে রডোডেনড্রন পার্ক সেজে উঠছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। মাথায় ছাতা নিয়ে বসবার জায়গাগুলো আর কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয়ের অনেক অনেক পাহাড়চূড়ার মাঝে কোনো বাধা নেই। ফলে পরিষ্কার দিনে এখান থেকে সূর্যোদয় দেখা টাইগার হিলের অভিজ্ঞতার সাথে লড়ে যেতে পিছপা হবে না। স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিয়ে জঙ্গলের বাঁক ধরে ট্রেকিং যথেষ্ট চমকপ্রদ। মংপুর রবীন্দ্রভবনে ঘুরে এসে এই সিকসিনেই হতে পারে আপনার নিরালা যাপন। পর দিন চাই কি ব্রেকফাস্ট সেরে চলে যাওয়া যাবে দার্জিলিং, খুব জোর ঘন্টা দেড়েক। সারা বেলা সেখানে কাটিয়ে ফিরে আসা যাবে আবার নিঝুম শান্তির দেশে। নিশ্চিন্তে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হোম স্টের লনে বসেই দূর পাহাড়ের আলোর ঝিকিমিকির কানে কানে আকাশের তারারা কী কথা বলতে আসে, সাক্ষী হওয়া যায় সে অপার্থিব দৃশ্যেরও!
যা যা লিখলাম তার সব কিছু আমাদের ভাগ্যে জোটে নি। তাতে আক্ষেপ নেই। কারণ, যে অভিজ্ঞতার স্বাদ পেলাম, সে আবার সকলের জোটে না! স্নান খাওয়া সেরে খেয়াল হ'ল, বেশ ঠান্ডা লাগছে। হ্যাঁ, ভরা এপ্রিলেও! রাস্তার গরম, চলার ক্লান্তি, খিদের পেটে স্বাদু খাবার আর নরম রেজাই, সুতরাং ঘুমের অতল।
জেগে উঠে দেখি ঘর অন্ধকার। কিন্তু শরীরঘড়ি বলছে অতক্ষণ ঘুমোই নি! জানালা খুলতেই ভেজা বাতাসে ভর করে মেঘের দল ঘরে ঢুকে পড়ছে যেন! হঠাৎ আগুন লেগে গেল মেঘেদের অরণ্যে। এক মুহূর্ত। বিদ্যুতের এমন চেহারা আগে দেখি নি। আর আগুনের ঐ তাৎক্ষণিকতায় বাতাসে-মেঘে শুরু হয়ে গেল আরও জোর ছোটাছুটি। সাথে বৃষ্টি, তুমুল। খানিক পর বন্ধ দরজার তল দিয়ে মুক্তোবিন্দু ঘরে ঢুকতে শুরু করলো, মাথার ওপর খট খট শব্দ। শিলাবৃষ্টি! দরজা খুলতে জলের ঝাপটা ভিজিয়ে দিলো ঠিকই, কিন্তু যে দৃশ্য বিছিয়ে রয়েছে চোখের সামনে, তাকে অগ্রাহ্য করবার মতো ক্ষমতা থাকলে তো! সবুজ লনের কথা বলেছি আগের পর্বে। সে সবুজে মুক্তো রঙ বলগুলো ছিটকে পড়ছে, গড়িয়ে যাচ্ছে, ঢেকে দিচ্ছে সবুজের অহংকার!
কারেন্ট চলে গেছিলো অনেক আগেই। সন্ধ্যের চা-পকোড়ার যোগান পেতে পেতে জানলাম, রাতের মতো তার আর বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা নেই। কোথাও গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে গেছে! বিশ্বাস হবে, একটুও বিরক্তি আসে নি মনে? বরং এই আবহাওয়ায় মোমের আলোই মানানসই অনেক! এরই ফাঁকে কিন্তু আবারও চা! রাতের খাবারও ঘড়ি ধরে। এ বেলা ডাল, সবজি, মুরগির ঝাল। বৃষ্টি ততক্ষণে রিমঝিমিয়ে ঘুমপাড়ানি ছন্দ ধরেছে। ঘুম ভাঙতেই মন খারাপ। ফিরতে হবে! গত সন্ধ্যেয় দীনেশকে জ্যাকেট দিতে চেয়েছিলাম, অল্প বয়সী রক্তের গুমোরে নেয় নি! এখন দেখি ফুলহাতা উইন্ডচিটার পরে আছে। জানলাম রাতেই প্রশান্ত বাধ্য করেছে! অতিথিবাৎসল্য।
বাড়িতে যেমন খাই, তার তুলনায় অনেকটাই মোটা, কিন্তু নরম আর তোয়ালে মোড়া গরম রুটি। সাথে ওঁরা আলুর দম দিয়ে থাকেন জেনে ইনস্যুলিন নির্ভর আমার কারণে মধুপর্ণা মিক্সড ভেজ অনুরোধ করেছিলো রাতেই। মেরিনা ভোলেনি সেকথা। প্রশান্ত কাজে বেরিয়ে গেছে সাত সকালেই। ব্রেকফাস্ট সেরে, সব গুছিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মেরিনা দাঁড়িয়েই রইলো, হাত নাড়তে থাকলো, যতক্ষণ দেখা যায়। রাতের বৃষ্টিতে পথ ভেজা। মনটাও কেমন ভিজে উঠলো সিকসিন ইকো হাট হোমস্টের আতিথেয়তা ছেড়ে আসতে আসতে!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴