অন্তহীন আকাশের নীচে/১০
অন্তহীন আকাশের নীচে
দেবপ্রিয়া সরকার
পর্ব-১০
-----------------------
গতকাল পাখির সঙ্গে পরিচয় হয়ে স্বয়ংদ্যুতির খুব ভাল লেগেছে। একটা অদ্ভুত সারল্য আছে মেয়েটার মধ্যে। স্বয়ংদ্যুতির ইউটিউব চ্যানেল প্রতিনিয়ত ফলো করে পাখি। তাকে দেখেই গড়গড় করে বলে দিল শেষ কয়েকমাসে আপলোড করা সমস্ত ভ্লগের বৃত্তান্ত। স্বয়ংদ্যুতির মতো পাখিও ইতিহাস পাগল। কথায় কথায় পাখি বলছিল, জানো তো টুপুরদি আমাদের কোচিংয়ের ইন্দ্রদা খুব ভাল ইতিহাস পড়ায়। এই বিষয়ে ইন্দ্রদার প্রচুর পড়াশোনা। শুনেছি কোচ-কামতার ইতিহাস নিয়ে গবেষণাও করছে।
-জানি তো। আমাদের হেড-ডিপ অনির্বাণ স্যারের সঙ্গে পরিচয় আছে তোদের এই ইন্দ্রায়ুধের। নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটির কোনও এক সেমিনারে দেখা হয়েছিল। স্যারই তো দিলেন ওর ফোন নম্বর। আগামীকাল মিট করব। তুই যাবি আমার সঙ্গে?
কোচিং সেন্টারের বাইরে ইন্দ্রায়ুধের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি পাখির। তাই স্বয়ংদ্যুতির কাছ থেকে প্রস্তাবটা পেয়ে দু’সেকেণ্ডও ভাবেনি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। দুপুর দুপুর খাওয়া দাওয়া সেরে তৈরি হয়ে নিল দু’জনে। রোদের তেজ একটু কমতেই বেরিয়ে পড়ল তারা। যেতে যেতে পাখি স্বয়ংদ্যুতিকে পথঘাট চিনিয়ে দিচ্ছিল। মদনমোহন মন্দিরের সামনে পৌঁছতেই স্বয়ংদ্যুতি দেখল ফেডেড ডেনিম আর কালো টি-শার্ট পরা একজন লম্বা, ফর্সা যুবক দাঁড়িয়ে আছে বাইক স্ট্যান্ড করে। পাখি তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ওই তো ইন্দ্রদা চলে এসেছে।
ইন্দ্রায়ুধের সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিল স্বয়ংদ্যুতি। হাত মেলালো একে অপরের সঙ্গে। ইন্দ্রায়ুধ পাখির দিকে তাকিয়ে বলল, আরে! তুমিও এসেছ?
-হ্যাঁ টুপুরদি বলল তাই...
পাখি কথা শেষ করার আগেই স্বয়ংদ্যুতি বলে উঠল, আমার মনে ছোটবেলায় দেখা কোচবিহারের ছবি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে রাজবাড়ি আর সাগরদিঘির সামান্য কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া চিত্র আবিষ্কার করতে পেরেছি শুধু। এই কোচবিহার আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন এক শহর। এর ছোটবড় রাস্তা, ঝলমলে দোকানপাট, বড় বড় হাইমাস্ট ল্যাম্পের ঝকঝকে আলো সবই ভীষণ ভীষণ অচেনা। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে ভাবছিল একজন সঙ্গী পেলে মন্দ হয়না, যার সঙ্গে পথ চলতে চলতে সামান্য হলেও চিনে নেব রাজনগরের গলিঘুঁজি, আনাচকানাচ। পাখি খুব সুইট ওকে একবার বলতেই রাজি হয়ে গেল। বাই দ্য ওয়ে, আমরা মন্দিরটা আগে দর্শন করে নিই তারপর নাহয় কোথাও বসে কথা বলব, কেমন?
ইন্দ্রায়ুধ সম্মতি জানাতেই পাখির হাত ধরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল স্বয়ংদ্যুতি। প্রশস্ত অঙ্গন পেরিয়ে চোখে পড়ল ধবধবে সাদা মন্দিরখানা। স্বয়ংদ্যুতি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল বাংলার আটচালা মন্দিরের আদলে তৈরি দেবালয়টাকে। কিছুটা তফাতে থাকা ইন্দ্রায়ুধের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মদনমোহন ঠাকুর তো রাজপরিবারের কুলদেবতা, তাই না? কবে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির?
ইন্দ্রায়ুধ তার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, হ্যাঁ ঠাকুর মদনমোহন রাজপরিবারের অধিদেবতা। ১৭০৭ সালে পুরনো রাজনিবাসের পূর্বদিকে প্রথম মদনমোহন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । পরবর্তী সময়ে নতুন রাজবাড়ি তৈরি হওয়ার পর মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুর ১৮৮৯ সালে বৈরাগী দিঘির বিপরীতে এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করেন। *
এই সময় বিশেষ কোনও পুজোপার্বণ না থাকায় মন্দিরচত্বর ফাঁকাই ছিল। মূল মন্দিরের বিগ্রহের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ছিল পাখি আর স্বয়ংদ্যুতি। একটা ঘিয়ে সাদা লখনউ চিকনের সালোয়ার-কুর্তি পরেছে স্বয়ংদ্যুতি। তার গায়ের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে পোশাকের রঙ। চৈত্র শেষের দখিনা হাওয়ায় তার হাইলাইট করা একগোছা সোনালি চুল উড়ছে। স্বয়ংদ্যুতির দিকে এক পলক তাকিয়ে ইন্দ্রায়ুধ তার পাশে এসে দাঁড়াল। বংশীধারী মদনমোহনের দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই স্বয়ংদ্যুতি জিজ্ঞেস করল, এখানে মদনমোহন একাই রয়েছেন দেখছি। শ্রীরাধা নেই কেন?
ইন্দ্রায়ুধ হাসিমুখে বলল, মদনমোহনের এই বিগ্রহ শুনেছি বৈষ্ণব সাধক শঙ্করদেবের কল্পনাপ্রসূত। মদনমোহন এবং শ্রীরাধা এখানে একই দেহে লীন হয়ে আছেন। মদনমোহন এখানে প্রেমের ঠাকুর বা আদুরে যশোদানন্দন রূপে প্রকাশিত হননি। তিনি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বিষ্ণুর অবতার হিসেবে। রাজকীয় বেশে সজ্জিত, মিলন-বিরহের উর্ধ্বে উঠে মহারাজদের কুলদেবতা হিসেবেই তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এই মন্দিরে। রাজঅহংকেই তাঁর অলংকার বলে মনে করা হয় এখানে। *
মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রায়ুধের কথা শুনছিল স্বয়ংদ্যুতি। পাখি বলল, টুপুরদিদি তুমি কখনও মদনমোহনের রাস উৎসব দেখেছ? মেলার সময় এখানে থেকেছ কোনওদিন?
-না রে পাখি, আজ পর্যন্ত কখনও সেই সুযোগ পাইনি। তবে মা-বাবার মুখে গল্প শুনেছি প্রচুর।
ইন্দ্রায়ুধ বিস্ময়ের স্বরে বলল, সে কী! আপনি কখনও রাসমেলা দেখেননি? একবারও ঘোরাননি রাসচক্র?
-উঁহু। মা বলে ওই রাসচক্রই নাকি মেলার মূল আকর্ষণ। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসে রাসচক্রের টানে।
-একদম ঠিক বলেছেন আপনার মা। বৌদ্ধদের চক্রের আদলে বংশ পরম্পরায় আলতাফ মিঁয়ার পরিবার তৈরি করে আসছে রাসচক্র।
স্বয়ংদ্যুতি অবাক হয়ে শুনছিল সব কথা। বলল, উফ্, এগুলো তো দুর্দান্ত কনটেন্ট হতে পারে আমার ভ্লগের জন্য। একদম আনকমন। রাসমেলার ওপর একটা বড়সড় ভিডিও বানাতেই হবে দেখছি।
মন্দির থেকে বেরিয়ে তারা ঢুকল একটা কফি শপে। তিন কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ইন্দ্রায়ুধ বলল, আপনি ক’দিন আছেন এখানে?
-আছি আরও চার-পাঁচদিন। একটা অনুরোধ করব? প্লিজ এই আপনি আজ্ঞেটা এবার বন্ধ করতে হবে। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।
-সে তো করাই যায়। তবে বন্ধটা দু’পক্ষ থেকে হলেই ভাল।
-সে আর বলতে? আমি হাপিত্যেশ করে বসে আছি কখন আপনি ছেড়ে তুমিতে নামব।
স্বয়ংদ্যুতির কথায় হেসে উঠল ইন্দ্রায়ুধ। পাখি চুপচাপ বসেছিল। ঘুরেফিরে তাকাচ্ছিল ইন্দ্রায়ুধের দিকে। দু'দন্ড শান্তি দিচ্ছিল না হতচ্ছাড়া পারফিউমটা! সেটার টানেই বারবার ইন্দ্রায়ুধের দিকে নজর চলে যাচ্ছিল পাখির। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিয়ে স্বয়ংদ্যুতি বলল, তোমায় অনির্বাণ স্যার নিশ্চয়ই বলেছেন দিদার একশোতম জন্মদিন সেলিব্রেট করা ছাড়াও আমার এখানে আসার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে।
-হ্যাঁ, শুনেছি তুমি ইউটিউবার আর ভ্লগের জন্যে কনটেন্ট খুঁজতেই এখানে এসেছ। তা আমি কীভাবে তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি?
-অনেক কিছু করতে পারো। আমি চাই কোচ রাজবংশের ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে মানুষের সামনে তুলে আনতে। আমাদের দেশ, এমনকি এই রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষেরই সামান্যতম ধারণা নেই কোচবিহারের রাজ ইতিহাস সম্পর্কে। সেটা নিয়েই আমার সীমিত ক্ষমতায় কিছু কাজ করতে চাই আর তুমি যেহেতু এই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছ তাই তোমার কাছ থেকে ইনফর্মেশন চাই আর কী, অবশ্য যদি তোমার তাতে কোনও আপত্তি না থাকে।
-আরে আপত্তি থাকবে কেন? ইটস্ অ্যান অনার। তোমার মতো বিখ্যাত ইউটিউবার কনটেন্টের জন্য আমার কাছে হেল্প চাইবে, এতো আমি কখনও ভাবতেই পারিনি।
-আমি মোটেও বিখ্যাত ইউটিউবার নই। অনেক কষ্টে এক লক্ষ সাবসক্রাইবার জোগাড় করে সিলভার প্লে বটনের মালিক হয়েছি সবে। আরও কিছু ভিউয়ারস্ যাতে বাড়ে সেই উদ্দেশ্য নিয়েই নতুন নতুন কনটেন্ট খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছি। আগামীকাল কি একবার দেখা হতে পারে আমাদের?
-আগামীকাল?
স্বয়ংদ্যুতির প্রস্তাব শুনে একটু ভাবনায় পড়ে গেল ইন্দ্রায়ুধ। সঙ্গে সঙ্গে পাখি বলে উঠল, কাল কীভাবে হবে? কাল তো আমাদের মক টেস্ট নেবার কথা আছে ইন্দ্রদার।
ইন্দ্রায়ুধ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো কাল টুয়েলভের মক টেস্ট নেব বলেছিলাম। ঠিক আছে তুমি চিন্তা করো না আমি দেখছি কী করা যায়।
-প্লিজ একটু দেখো। বেশি সময় নেই। কাল বাদে পরশু দিদার বার্থডে। তারপর আর মাত্র দুটোদিন হাতে থাকবে, এরমধ্যেই আমার যতটুকু কাজ করার করে ফেলতে হবে।
-বুঝতে পারছি। এখানে যখন এসেছ তখন তুমি আমাদের শহরের অতিথি আর অতিথি আমাদের কাছে দেবতার সমান। তার সবরকম ইচ্ছে অনিচ্ছের খেয়াল রাখা আমাদের কর্তব্য।
একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল ইন্দ্রায়ুধ। স্বয়ংদ্যুতিও পাল্টা হেসে চুমুক দিল কফির কাপে ।
-তবে কি কাল আমাদের টেস্ট হবে না?
বিষন্ন গলায় জিজ্ঞেস করল পাখি। উত্তরের প্রত্যাশায় সে একবার ইন্দ্রায়ুধের দিকে তাকাল আর একবার স্বয়ংদ্যুতির দিকে। তারা দু’জনে তখন নীরব হাসি বিনিময় করছে একে অপরের সঙ্গে।
তথ্যসূত্রঃ কোচবিহারের সম্পূর্ণ ইতিহাস – মহেন্দ্র দেবনাথ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴