সরস্বতীপুর চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
গজলডোবাকে চিরে বেরিয়েছে তিস্তা ক্যানেল। পাশেই গড়ে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প “ভোরের আলো”। একটু দূরেই চা বাগিচায় ঘেরা আদিবাসী গ্রাম সরস্বতীপুর। আদিবাসী গ্রামটির চারপাশেই বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল। ওদলাবাড়ি থেকে গজলডোবা ভিউ পয়েন্ট ১৫ কিমি। পরিকল্পনা নিলাম একদিকে ক্ষেত্রসমীক্ষাও করব, অন্যদিকে টুরিজম অর্থাৎ পর্যটন শিল্পের বিকাশের গতিপ্রকৃতিও তুলে ধরা যাবে। অতএব চরৈবেতি। ওদলাবাড়ি থেকে একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম ফরেস্ট ড্রাইভে। ওদলাবাড়ি মোড় হয়ে গজলডোবা। বৈকুন্ঠপুর বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ডুয়ার্সের আদি চা বাগান গজলডোবা। ওদলাবাড়ি থেকে গজলডোবা মাত্র ১৪ কিলোমিটার। আমাদের গন্তব্য স্থান ওদলাবাড়ি থেকে গজলডোবা হয়ে সরস্বতীপুর। সমগ্র এলাকাটাই ফরেস্ট ড্রাইভ-এর মধ্যে। পথে যেমন ধুলোবালি, তেমনি খানাখন্দ। মাঝে মাঝে আমাদের পাশ কাটিয়ে ট্রাক-বাস, মোটরসাইকেলে পিকনিক প্রেমিকরা হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে ধুলো উড়াতে উড়াতে। সকলের লক্ষ্য ফরেস্ট ড্রাইভে গজলডোবা। ওদলাবাড়ি ছাড়ালেই তিস্তা ব্যারেজের নবনির্মিত অফিস বাড়ি। এই যাত্রায় যাব সরস্বতীপুর। গজলডোবায় বর্তমানে উত্তরবঙ্গের মেগা টুরিজম হাব গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে। স্বচক্ষে না দেখলে আমি কেন অনেকেই কল্পনা করতে পারবে না দুয়ার থেকে অদূরে ছড়িয়ে আছে একটি অসাধারণ সৌন্দর্যখনি। গজলডোবাকে কেন্দ্র করে চলছে ডুয়ার্সের অন্যতম পর্যটন প্রকল্প ভোরের আলো প্রজেক্টের বিরাট কর্মকাণ্ড। ওদলাবাড়িরও অনেক ভোল পাল্টেছে। ভোরের আলো প্রকল্পের কাজে সমগ্র অঞ্চল এখন কর্মব্যস্ত। চা বাগান, জঙ্গল, লোকালয়। পৌঁছে যাই ব্যারেজ সংলগ্ন মাঠে। এপারে অসংখ্য মানুষের মাথা। মারুতি, ট্যাক্সি, ট্রাক-বাস দাঁড়ানো। সবাই এসেছে ওদলাবাড়ি হয়ে। হনুমান মন্দির অতিক্রম করে ক্যানাল রোডের রাস্তা ধরে সোজা গজলডোবা ভিউ পয়েন্ট। একটু জলযোগ সেরে আমরা যাব সরস্বতীপুর চা-বাগান। জলপাইগুড়ির প্রতিষ্ঠিত চা ব্যবসায়ী কিষাণ কল্যাণীর বাগান সরস্বতীপুর।
সরস্বতীপুর টি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড জলপাইগুড়ির সদর মহকুমার একটি অন্যতম চা কোম্পাণী। জলপাইগুড়ির দিনবাজারে কল্যাণী হাউস কোম্পানির মালিকের স্থায়ী ঠিকানা। ডুয়ার্সের অন্যতম অভিজ্ঞ চা বাগান মালিক কৃষ্ণকুমার কল্যাণী সরস্বতীপুর টি গার্ডেনটির মালিক। তাঁর আর একটি ভালো চা বাগান গুরজংঝোরা মালবাজারের কাছে অবস্থিত। জলপাইগুড়ির মার্চেন্ট রোডে গুরজংঝোরা বিল্ডিং তাঁর আর একটি অফিস। সরস্বতীপুর বড় বাগান। বাগানটি আইটিপিএর সদস্য। বাগানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ১১ জন। কোম্পানির হেড অফিস জলপাইগুড়ি। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন দুটি। এগুলি হল সিবিএমইউ এবং টিডিপিডব্লিউইউ। চা বাগিচাটি রাজগঞ্জ ব্লকে অবস্থিত। লেবার অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জেনেছিলাম সরস্বতীপুর চা বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৩৭৯.৩১ হেক্টর। প্রতি হেক্টর সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ২২৪৪ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। সরস্বতীপূর চা বাগিচার সাব স্টাফ এর সংখ্যা ৪৪ জন, করণিক ১০ জন এবং ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ দুজন। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৫০৯ জন। মোট জনসংখ্যা ৩০১০ জন। স্থায়ী শ্রমিক ৫৮১ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি পায়। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৫৬৭ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংখ্যা ১০৫ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৭ জন। অন্যান্য বাগানের তুলনায় সরস্বতীপূর চা বাগানে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা মোটামুটি ভালই। বাগানের শ্রমিক হাসপাতালটি সাধারণ মানের হলেও উন্নত। কারখানাটিও উন্নত মানের। তবে বাগানে আবাসনের সমস্যা আছে। বছরের পর বছর শ্রমিকদের থাকার ঘরগুলি মেরামত হয় না বলে অভিযোগ। শ্রমিকদের মতে, প্রতিবছর কয়েকটা করে ঘর পাকা করে দিলেই সমস্যা ধীরে ধীরে মিটে যায়। বাঁশ, দরমা দিয়ে তৈরি অনেকগুলি ঘরের জরাজীর্ণ চেহারা নিজের চোখেও দেখে এলাম। পাশের জঙ্গল থেকে হাতি বের হয়ে এসেও মাঝে মাঝে শ্রমিক বস্তিতে হামলা করে।
শিলিগুড়ি লাগোয়া সরস্বতীপুর চা-বাগানের শ্রমিকরা প্রতি সোমবার ও শুক্রবার বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শালুগাড়া হাটে আসেন। পরিবেশ আইন মেনে পিচ ঢালা না-হলেও মাটির ওই সাইকেল চলা পথই সম্প্রতি বন দপ্তর গাড়ি চলাচলের মতো চওড়া করে দিয়েছে। প্রথমে ঠিক ছিল, গজলডোবার পর্যটন হাব ‘ভোরের আলোয়’ বেড়াতে আসা পর্যটকেরাই ওই জঙ্গল পথে শালুগাড়ার কাছে তৈরি মুক্ত চিড়িয়াখানা বেঙ্গল সাফারিতে আসতে পারবেন। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তে কেবল গাজলডোবার পর্যটকেরাই নন, শিলিগুড়িতে বেড়াতে আসা যে কোনও পর্যটকই বৈকুণ্ঠপুরের ওই জঙ্গল-পথে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। এই রাস্তাটি খুলে দেওয়া হলে ছোট গাড়িতে চড়ে পর্যটকেরা শালুগাড়া অথবা গজলডোবা হয়ে জঙ্গলে ঢুকতে পারবেন। আমি যখন সরস্বতীপুরে গিয়েছিলাম তখনও খোলা হয় নি এই রাস্তা, কাজ চলছিল। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের এই রাস্তাটি অসাধারণ। তাই কেবল গজলডোবায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের মধ্যে সীমিত না রেখে সাধারণ পর্যটকদের জন্যও এই রাস্তা খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। বন দপ্তরের বৈকুন্ঠপুর রেঞ্জ থেকে জানতে পারলাম পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য জঙ্গলের মুখে দুটি ড্রপ গেট তৈরি করা হবে। তৈরি করা হবে চারটি ওয়াচ টাওয়ারও। গোটা রাস্তায় নজরদারি রাখার জন্য বেশ কয়েকটি ক্যামেরাও বসানো হবে। উল্লেখ্য এটাই জঙ্গলের পথে আদিবাসীদের হাটে যাওয়ার পথ যা এ বার বনবস্তিবাসীদের পাশাপাশি সাধারণ পর্যটকদের জন্য খুলে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। বৈকুণ্ঠপুর সংরক্ষিত বনাঞ্চল না-হলেও ইতিহাস এবং কৌলিন্যে কোনও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে নেই। ইতিহাসে যেমন বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের নানা উল্লেখ রয়েছে, তেমনই এই জঙ্গল উত্তরবঙ্গের বুনো হাতিদের তিস্তা নদী পেরিয়ে ডুয়ার্স থেকে তরাইয়ে যাওয়ার পথ। প্রায় সারা বছরই এই জঙ্গলে বুনো হাতিদের দেখতে পাওয়া যায়। চিতাবাঘ-সহ নানা ধরনের ছোট জীবজন্তুতেও জঙ্গলটি ভর্তি। তার উপরে এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সাহু, করতোয়া, করলার মতো মোট ২৯টি ছোট, বড় নদী বয়ে গিয়েছে। রাস্তাটি ওই সমস্ত নদী পেরিয়েও গিয়েছে।
উত্তরের নবান্ন উত্তরকন্যাতে পর্যটন দপ্তর সূত্রে জেনেছিলাম ভোরের আলোকে জনপ্রিয় করার কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা রচনার সময়েই এই রাস্তাটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। সরস্বতীপুর চা-বাগানের আদিবাসীদের যাতায়াতের রাস্তাটিকে গাড়ি চলাচলযোগ্য করে তুলতে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করা হয়। ভোরের আলোর পর্যটকেরা যাতে এই রাস্তায় সাইকেলে ভ্রমণ করতে পারেন সে জন্য জিপিএস প্রযুক্তির সাইকেলও আনা হয়েছে। পরে বদল আনা হয় পরিকল্পনায়। সাধারণ পর্যটকদেরও এই রাস্তায় ভ্রমণের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোথাও নদীর উপরে তৈরি করা হয়েছে 'কজওয়ে'। কোথাও বা সেতু। ফলে এই জঙ্গল পথে পর্যটকেরা ভ্রমণের অনুমতি পেয়ে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাবেন বলেও মনে করেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তবে শীতে পিকনিকের জন্য জঙ্গল খুঁজে বেড়ান যাঁরা, তাঁদের কোনওভাবেই এখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে ঠিক হয়েছে। বন এবং পর্যটন দপ্তরের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরাও। জঙ্গল কখনও পিকনিক করার জায়গা নয়। তবে সাধারণ পর্যটকদের জন্য রাস্তাটি খুলে দিতে গিয়েও যাতে পরিবেশের কোনও ক্ষতি না-হয় সেদিকেও নজর দিচ্ছে পর্য্যটন দপ্তর। গজলডোবার "ভোরের আলো" খুলবে বলে সেখানে পর্যটনের প্রসারে কিছু কাজ হচ্ছে। তাই ভিড় এড়াতেই এই সিদ্ধান্ত পর্যটন দফতরের। বিকল্প জঙ্গল পথও প্রায় তৈরি। বিশেষ অনুমতি নিয়ে বেঙ্গল সাফারি পার্কের উল্টো দিক দিয়ে জঙ্গলের বুক চিড়ে ঢুকলাম সোজা গজলডোবার দিকে। জঙ্গলের পর কিছুটা সরস্বতীপুর চা বাগানের মধ্য দিয়ে রাস্তা একেবারে গহন অরণ্যের মধ্য দিয়ে। দেখলাম সেই রাস্তার কাজ প্রায় শেষ। গজলডোবার পাশে তৈরি হয়েছে এলিফ্যান্ট রুট। হাতির পিঠে চেপে ভোরের আলো থেকে সোজা সরস্বতীপুর চা বাগান ঘুরে আসতে পারবেন পর্যটকেরা। সেই কাজও প্রায় শেষ। সব ঠিকঠাক চললে এলিফ্যান্ট সাফারিও চালু হবে গজলডোবায়।
তবে চা বাগান পরিক্রমা করতে গিয়ে আলোর মাঝে কালো যেমণ দেখতে পাই, তেমনি পাশাপাশি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা কখনো কখনো পথ দেখায়। সরস্বতীপুর চা বাগিচার জয়েন্ট ফোরাম শ্রমিক নেতা সুভাষ করোয়া ইতিপূর্বে বাগানের আধিকারিকদের সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আবাসনের সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন বছর কয়েক আগে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুকে। সরস্বতীপুর বাগানে আসার আগে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী তৎকালীন জেলা শাসকের দফতরে বিভিন্ন বাগানে শ্রমিকদের আবাসন, পানীয় জল, রেশন ইত্যাদি নিয়ে উন্মা প্রকাশ করেছিলেন। চা-শ্রমিকদের বকেয়া পিএফ পরিশোধ করা নিয়েও রাজ্য সরকার অনড় বলে জানিয়েছিলেন শ্রমমন্ত্রী। বকেয়া পিএফ-এর টাকা উদ্ধারে রাজ্য সরকারের কড়া পদক্ষেপ গ্রহণের বার্তাও দিয়েছিলেন শ্রমমন্ত্রী। ন্যূনতম মজুরি নিয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানিয়েছিলেন মন্ত্রী। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু সেই সময়ে উষ্মাপ্রকাশ করে বলেছিলেন চা-বাগানের মালিকদের যা যা করণীয় অনেকক্ষেত্রেই মালিকপক্ষ তা করেন না। বাগানে ক্রেশের মান আরও ভাল হওয়া উচিত এবং সুযোগ সুবিধাও বাড়ানো উচিত মালিকপক্ষের। কিন্তু হায়! জয়েন্ট ফোরামের জিয়াউল আলমের পরিভাষায় ‘শূন্য কুম্ভ বাজে বেশি। উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলির বেশিরভাগ বাগান কখনো খোলা তো কখনো বন্ধ। এই লুকোচুরি খেলার মাঝে দুবেলা খাবার জোটে না শ্রমিক পরিবারগুলির। কিন্তু তার বাইরেও যে থাকে অনেক কৃতিত্বের কাহিনী সেটা কতজন জানে? ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে এসে সরস্বতীপুর বাগানে আমি মজে গেলাম রাগবিতে। বছর পাঁচেক ধরেই রাগবিতে মজে রয়েছে ডুয়ার্সের সরস্বতীপুর চা-বাগান। ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে উঠে এল ভিন্নধর্মী আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোতে এক বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প। এ গল্প নয়, এ সত্যি ঘটনা।
আধপেটা খেয়ে যে অসাধ্য সাধন করা যায় সেটা দেখিয়ে দিচ্ছে উত্তরবঙ্গের সরস্বতীপুর চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের দামাল মেয়েরা। এশিয়ান রাগবি চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের হয়ে খেলতে ফিলিপাইন্সের রাজধানী ম্যানিলায় উড়ে গিয়েছে সরস্বতীপুর চা বাগানের সরস্বতীপুর চা বাগানের লছমি ওঁরাও, আশা ওঁরাও এবং চন্দা ওঁরাও। শুধুমাত্র শরীরের ওজন কম থাকায় জাতীয় দল থেকে ছিটকে গেছে সুমন ওঁরাও, স্বপ্না ওঁরাও এবং পুনম ওঁরাওরা। সন্ধ্যা রাই, পুনম ওঁরাও, লক্ষী ওঁরাও-রা সরস্বতীপুর চা বাগানের বাসিন্দা। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের গজলডোবার স্কুলেই প্রথম রাগবির পাঠ সন্ধ্যা, পুনমদের। এটা সম্ভব হয়েছে সরস্বতীপূর চা বাগানের মহিলা রাজ্য রাগবি দলের কোচ রোশন খাঁখাঁর জন্য যিনি সরস্বতীপুর গ্রামেই থাকেন। রাগবির ভক্ত কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের রাগবি খেলার প্রশিক্ষণ দেন রাজ্য রাগবি দলের কোচ রোশন খাঁখাঁ। ছয় বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে যান রোশন। চার্চের এক পাদ্রী তাকে উদ্ধার করে অনাথ আশ্রমে নিয়ে আসেন। সেখানে তার রাগবি খেলার উৎসাহ দেখে রোশনকে ফ্রান্সে পাঠান ফাদার। সেখান থেকে রাগবি খেলার তালিম নিয়ে দেশে ফেরেন রোশন। এরপর উড়িষ্যার এক জনপ্রিয় আদিবাসী বিদ্যালয়ে কোচের চাকরি পান তিনি। সরস্বতীপুর বাগান এর পার্শ্ববর্তী এক চার্চের পাদ্রী দুটো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় রাগবি খেলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন সেই খবর পেয়ে চাকরি ছেড়ে এখানে চলে আসেন রোশন। এরপর থেকেই এখানকার তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষিত করছেন তিনি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট রাগবি সিরিজ প্রতিযোগিতার আসরে নেপাল, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, গুয়ামের পাশাপাশি ভারতও অংশগ্রহণ করে এবং সেখানে অংশগ্রহণ করেছে সরস্বতীপূর চা বাগিচার অবহেলিত শ্রমিক পরিবারের নারীরা একি কম গর্বের কথা? দেশের হয়ে সাফল্য অর্জন করার মধ্য দিয়ে চা বাগিচার ইতিহাসে নতুন পালক যুক্ত করেছেন তাঁরা। রোশনের অনেক ছাত্রছাত্রী খেলতে গিয়ে বিদেশ থেকে জিতে এনেছে অনেক পুরস্কার। রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতার ময়দান থেকেই সরস্বতীপূর চা বাগানের পাঁচজনের চেন্নাইতে জাতীয় স্তরের নির্বাচনী শিবিরে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয় যাদের মধ্যে স্বপ্না এবং চন্দ্রা সুযোগ পায় তাদের প্রতিভার জন্য।
চা বাগিচার শ্রমিক পরিবারের একেবারে সদ্য হাঁটতে শেখা মেয়েটির হাতেও রাগবি বল। চার বছরের দয়ালু ওরাও থেকে ত্রিশ পেরনো যুবক দীপু ওঁরাও সকলেরই প্রিয় খেলা রাগবি। গত দুই আড়াই বছর ধরে রাগবিতে মজে রয়েছে ডুয়ার্সের সরস্বতীপূর চা বাগান। বাগানের মেয়েরাই পশ্চিমবঙ্গের খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় স্তরে সাফল্য পেয়েছে। তাদের সকলেই গজলডোবা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। রাগবি খেলায় উৎসাহ যে বাড়ছে সেটা জানিয়েছিল সরস্বতীপুর চা বাগানের বাসিন্দা গজলডোবা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী কৌশল্যা ওঁরাও এবং ছাত্র সহদেব ওঁরাওরা। কিন্তু উৎসাহের গ্রাফ যে এতটা ঊর্ধ্বমুখী সেটা জানা ছিল না। কিন্তু কৃতিত্বের কাহিনী ঢাকা পড়ে ক্ষিদের যন্ত্রণায়। সরস্বতীপূর চা বাগান অধ্যুষিত গ্রামের গ্রামবাসীদের প্রধান জীবিকা চাষবাস এবং মাছ শিকার। একটা অংশ চা শ্রমিক। অত্যন্ত অভাবের মধ্যেই চা বাগিচার এই মেয়েরা রাগবির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে রোশনের কাছে। টিউশনের টাকা দেবার ক্ষমতা নেই এই মেয়েদের। বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের মধ্যেই মেয়েদেরকে প্রশিক্ষণ করাতে হয়। স্বপ্নার বাবা মনু ওঁরাও এবং চন্দার বাবা সুরেন ওঁরাও সরস্বতীপূর চা বাগানে মাসিক ৪৮০০ টাকার শ্রমিকের চাকরি করে। তাদের এই সামান্য আয়ে সংসার চালাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মেয়েদের খেলার জন্য যে ধরনের ভালো খাবার প্রয়োজন তা তাঁরা দিতে পারেন না। বাগানের মেয়ে রাগবি দলের ম্যানেজার কৃপা ওঁরাওর সঙ্গে যখন কথা বলেছিলাম তখন কৃপার মা অসুস্থ। বাবার সামান্য রোজগারে মায়ের চিকিৎসা প্রায় হয় না বললেই চলে। খেলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রয়োজন থাকলেও টাকা না থাকার ফলে সেগুলি জোটে না। দলের ক্যাপ্টেন চন্দা ওঁরাও এর কাছ থেকে জানা গেল প্রশিক্ষণ সেরে বাগানে ফেরার সময় বুনো হাতির সামনে পড়ে কতবার যে তারা প্রাণে বেঁচেছেন তার হিসাব নেই। মিনুখা কোরোয়ার বক্তব্য বন্ধ চা বাগানে না খেতে পেয়ে শ্রমিক মারা যাচ্ছে। আমরা চালু চা-বাগানে থেকে বাংলা তথা দেশের জন্য যদি একবেলা ঠিকমত না খেয়েও যদি কিছু করে দেখাতে না পারি তাহলে জীবনে আর কি করলাম? ডুয়ার্সের চা বাগিচা বলতে এখন অনেকেই বোঝেন অর্ধাহার, অনাহার এবং অপুষ্টিতে শ্রমিকের মৃত্যু। তার বাইরেও যে থাকে অনেক কৃতিত্বের কাহিনী সেটা কতজন জানেন?