শালসিঁড়ি/১
বিমল দেবনাথ
-------------------
ময়ূখকে এখন শুধু বনে পায়। বন ছাড়া তার কিছু ভালো লাগে না। ওর বাবা মা ওকে একটা আধুনিক বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছে । ঐ বৃত্তের বাইরে যাওয়া ময়ূখের অসাধ্য কাজ।
কয়েক বার সে অদৃশ্য বৃত্ত ভাঙ্গার চেষ্টা যে করেনি তা নয়। তবে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবার। ময়ূখের মন খারাপ করে। কিন্তু তার মনের কষ্ট প্রকাশের কোন উপায় নেই। স্কুলের বন্ধুরা মন খারাপে অল্পস্বল্প দুষ্টুমি করলেও ময়ূখের পক্ষে কোন রকম অনিয়ম করা খুব কঠিন কাজ। কারণ তার বাবা মায়ের ইমেজের খ্যাতি। ময়ূখের বৃত্তের বাইরে যত মানুষ আছে সবাই ওর বাবা মায়ের আকাশের সূর্য তারা চাঁদ। তাই ওর চার পাশের ভিতরের গন্ডির পরিধি নির্দিষ্ট হলেও বাইরের গন্ডির পরিধি সীমানাহীন।ওর পালিয়ে যাবার কোন ঠিকানা নাই। ওর একমাত্র মুখ লুকানোর জায়গা হলো মায়ের বুক। ওর খুব মন খারাপ করলে মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদে।
মা ওর চুলে আঙুল দিয়ে বিলুনী কাটতে কাটতে জিজ্ঞাসা করে - ময়ূখ তোর কী কষ্ট? ময়ূখ কিছু বলতে পারে না। শুধু ডুকরে ডুকরে কাঁদে।
ময়ূখের মা কিছু বুঝতে পারে না; ময়ূখের মনে কষ্ট কেন। ময়ূখকে আদর করতে করতে বলেন - তোর কি হয়েছে ময়ূখ। তোর তো কোন কিছুর অভাব নেই। তাও কেন কাঁদছিস। সবাই তোকে কত ভালোবাসে বল। তোর কি কিছু চাইতে হয়। আমরা তোর মনের কথা বুঝতে পেরে তোর কোন কিছু চাওয়ার আগেই সব জিনিস তোকে দিয়ে দিই; যাতে তোর কষ্ট না হয়। তাও তুই পাগলের মত করিস কেন বাবা। তোকে আমরা সবাই কত যত্ন করি সবাই চোখে চোখে রাখি । তোর তো ঘরে বা স্কুলে কোন ভয় নাই। তাও কেন ওরকম কাঁদছিস। তোকে কেউ কি কিছু বলেছে।
ময়ূখদের ৩০০০ স্কয়ার ফুট ফ্ল্যাটে ও তার চার পাশের পরিসরে কোন কিছুর অভাব নেই। ঘরে সব দামি আসবাবপত্র বড় ভালো রঙিন টেলিভিশন, ভিডিও গেম, মোবাইল ফোন, দামি সাউন্ড সিস্টেম, অসংখ্য বাংলা ইংরেজি গল্পের বই যার মধ্যে অনেকগুলো এখন নতুন, পর্যাপ্ত এসি, দামি দেশ বিদেশের খাবার সব আছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। ঘরের বাইরে রয়েছে খেলার মাঠ, সুইমিংপুল, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি সব। তবুও ময়ূখের মন বসে না ওদের ঘরে এবং ঘরের বাইরে চারদিকের পরিসরে। ঘরের বাইরে খেলার মাঠ আছে কিন্তু ওখানে ওদের বয়সী কেউ খেলে না কারণ মায়েরা খেলতে দেয় না, যদি আঘাত লাগে; সুইমিংপুল আছে কিন্তু কেউ সাঁতার কাটে না, যদি ঠান্ডা লাগে। ময়ূখের নিজেকে পুতুল মনে হয়। নিজের ইচ্ছায় কিছুই সে করতে পারেনা। ওর ঘরের পাশের সব ছেলে মেয়েদেরও পুতুল মনে হয়। ময়ূখের মনে হয় ওর জীবনটা একটা মন-রেল। শুরু ও শেষ স্টেশনের মধ্যে যাওয়া আসা করে। মাঝে যাত্রীদের মতো কত ভাবনা চিন্তা ওঠানামা করে, ময়ূখ তা কিছুই ধরে রাখতে পারে না। ময়ূখের মনে হয় ও একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে ছুটে চলেছে। সুড়ঙ্গের এক প্রান্তে ওর ঘর অন্য প্রান্তে স্কুল। এই পাতাল জীবন ওর আর ভালো লাগেনা। ময়ূখ ওর কষ্ট কাউকে বোঝাতে পারে না। তাই মাকে ধরে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে ময়ূখের জিদ চাপে। আজ মাকে কষ্টের কথা বলবে। ময়ূখ মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মা জিজ্ঞাসা করলেন - কী রে কিছু বলবি। ময়ূখ সাহস করে বলল - মা আমার আর এই ঘর আর স্কুল করতে ভালো লাগছে না। সেই কবে থেকে পেন্ডুলামের মতো এদিক ওদিক করে যাচ্ছি, চল না কোথাও বাইরে ঘুরতে যাই।
ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে ময়ূখের মায়ের মাথা ঘুরে গেল। বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল - কী করে যাবি। তোর সেমিস্টার আছে, টিউশন আছে, তবলার ক্লাস আছে। যাবো বললেই কী যাওয়া যায়। তোমার পড়াশুনা শেষ হোক তারপর আমরা সবাই ঘুরতে যাব। ঘরে তো অনেক ভালো ভালো ভিডিও গেম আছে, টেলিভিশনে নানা চ্যানেল আছে তা দেখে মনটা রিফ্রেশ করে নাও। একটু পরে কিন্তু তবলার মাষ্টারমশাই আসবেন। ময়ূখের কিছু ভালো লাগে না। ডিজিটাল পশু পাখি গাছ যতই আলোক উজ্জ্বল হোক না কেন ময়ূখের চাই না। ওর আসল চাই, আসল। ও চায় গাছকে ছুঁয়ে দেখতে, গাছের পাতা ছুঁতে, পাখির ডাক শুনতে। ওদের ঘর থেকে যে কিছুই দেখা যায় না। একটা কাকও না। স্কুলে যাবার সময় স্কুলবাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এনিয়ে বন্ধুরা যে ওকে খেপায়, সেটা ও বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলে না। ময়ূখের বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। জানলা দিয়ে দেখে নীল আকাশ, সবুজ গাছ উড়ন্ত পাখি। মাঝে মধ্যে যখন বড় বড় ঘর বাড়ি আসে ও তখন চোখ বন্ধ করে থাকে। ভাবতে থাকে এক সবুজ পৃথিবী। ওর খুব ইচ্ছা পাখি কী করে উড়তে শুরু করে সেটা দেখতে। ও ভাবে হয়তো এরোপ্লেনের মতো। ও জানে না। খুব জানতে ইচ্ছা করে। বনে যেতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু কেউ ওর মনের কথা বুঝতে পারে না। মনের মধ্যে যেন একটা ফণিমনসার গাছ জন্মেছে। এদিকে ওদিকে নড়লেই খোঁচা লাগে। ব্যথা পায়। বই নিয়ে পড়তে বসলে পড়তে পারে না। অক্ষরগুলো যেন পিঁপড়ের মতো হাঁটতে থাকে। তবলার তাল কেটে যায়। আজকে তো তবলা ফাটিয়ে ফেলল। তবলাটা ফেটে যাবার পর ময়ূখের যেন একটু স্বস্তি হলো। মনের অনেকটা চাপ কমল। কিন্তু ময়ূখের বাবা মায়ের চাপ বাড়ল। তবলার মাষ্টারমশাই ময়ূখের মা'কে ডেকে নালিশ করে বললেন - ময়ূখকে যেন ডাক্তার দেখানো হয়। ময়ূখের মনের স্বাস্থ্য ভালো নয়। ময়ূখের মা ময়ূখকে এসে জড়িয়ে ধরে। ময়ূখ মায়ের বুকে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে। ময়ূখের বাবা রাগে গজগজ করতে করতে বলল - বদমাশ ছেলে কোথাকার। পড়াশোনার কোন কথা নেই, শুধু বাইরে যাওয়ার বায়না। এই করোনা কালে সব উদ্ভট দাবি। ময়ূখের কি হল সে জানে না; সে যা কোন দিন করেনি তাই করে বসল। মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে লাল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল - করোনা তো হয়েছে ছয় মাস। আমাকে তোমরা গত দুই বছর কোথায় নিয়ে গ্যাছ ?
ময়ূখের এই যুবোচিত ব্যবহার অপূর্বকে স্তম্ভিত করে দেয়। বলে – মাধুরী, তবলার মাষ্টারমশাই ঠিক কথা বলেছেন। আমাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। মাধুরী অপূর্বকে থামতে বলে ময়ূখকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ময়ূখ মায়ের বুকে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে বলে – মা, আমার কিছু হয়নি, আমি পাগল না। আমাকে আবার শালসিঁড়ির কাছে নিয়ে চল। আমি অনেক দিন পর আবার শালসিঁড়ি চড়ে আকাশে উঠবো। পাখির মতো উড়ব। চল মা শালসিঁড়ির কাছে যাই। মাধুরী ময়ূখকে জোরে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে - আচ্ছা বাবা দেখছি, তুমি শান্ত হও। মাধুরীর চোখের জল লাল হয়ে যাওয়া ফর্সা গালের গা বয়ে চিবুকের নীচে হীরার মতো দুলছে। অপূর্ব চায়না এই হীরা মাটিতে পড়ুক।