সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
22-November,2022 - Tuesday ✍️ By- অমিত কুমার দে 518

রকি আইল্যান্ডে মূর্তি নদীর সঙ্গে

রকি আইল্যান্ডে মূর্তি নদীর সঙ্গে
অমিত কুমার দে
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^

নদী টানে! ডুয়ার্সের পাগলি নদীরা। ক’দিন ধরেই নদী বড্ড টানছিল! প্রাক-বর্ষার অঝোর বরিষণে ডুয়ার্সের পাহাড়ি অনেক নদীই এবার তীব্র স্রোতবতী। তাদের কন্ঠস্বর রীতিমতো পালটে গেছে! সেই কলস্বর খুব কাছে বসে শুনবার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছিল কটা দিন ধরে।
 
এক উইক এন্ডে আর পারা গেল না। চার চাকা স্টার্ট দিয়েই ফেললাম। ঝালং-এ জলঢাকার পাড়ের দুটি হোম-স্টে-মালিক জানালেন “We are all full!” তাই খুনিয়া মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক না নিয়ে সোজা চালসা। উঠে পড়লাম মেটেলির রাস্তায়। এক অদ্ভুত মোহময় পথ। যতবার আসি পুরনো হয় না। কিলকট, ইন্ডং, আইভিল … যেমন নাম, তেমনি রূপসিনী তারা। বৃষ্টি গায়ে পড়লে তো কথাই নেই! প্রতিটি চা-বাগান একেকটা অসামান্য ক্যানভাস। কত সবুজের রকমারি শেডে কী নিখুঁত ল্যান্ডস্কেপ!

মেটেলি বাগান সামসিং বাগান চিরে গাড়ি চলছে। আলতো স্পিকারে জয়তী চক্রবর্তী। দিগন্তে ভেজা পাহাড়। মেঘ মেঘ ইশারায় মন উড়ু-উড়ু!

কদিন আগেই অল্প সময়ের জন্য পাহাড়ে গাড়ি চালানোর তালিম নিতে রকি আইল্যান্ড গিয়েছিলাম। এক বন্ধুর সঙ্গে। তখনি নদীর ঠিক ওপরে দুটো হোম-স্টে দেখে এসেছিলাম।  কঠিন রাস্তায় চালাতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল এক আনাড়ি চালকের। এবার বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চলছি। যদিও মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিতে কিছু কিছু জায়গায় খুব ভেঙেছে। সামসিং বাজার থেকে তিন কিলোমিটারের মতো যেতেই শুনতে পেলাম বর্ষাপাগল নদীর জোর কন্ঠস্বর! ওই তো রকি আইল্যান্ডের মূর্তি  নদীর লোহার সেতু! 

‘ত্রিবেনী’তে উঠলাম। নদীর একদম লাগোয়া দুটি ছোট্ট মিষ্টি কটেজ। আগে দেখে গিয়েছিলাম। ফাঁকা পেয়ে খুব আনন্দ হল। ঘরে ব্যাগপত্তর ঢোকাতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। তুমুল বরিষণ। পাহাড় ঢেকে গেল মেঘ কুয়াশার বাড়াবাড়িতে। এমনটাই তো চাইছিলাম। ভরা শ্রাবণের সরোদ বাজছে পাহাড়ি গ্রাম জুড়ে। আহা বর্ষা!

বাইরে বেরিয়ে এলাম। কতদিন পর এমন ছাঁটে ভিজলাম। যেন গ্রামের বালক ফিরে পেল তার হারানো ছেলেবেলা। বৃষ্টির পর বিকেলে চারজনে হাঁটতে বের হলাম। একটা বড় কাঁকড়া রাস্তা পার হচ্ছে। ছুঁতে গেলেই আক্রমণাত্মক রূপ! 

বৃষ্টি দেখে রাতে খিচুড়ি আর ডিমের কারির অর্ডার হয়েছিল। কিন্তু রকি আইল্যান্ডকে আপাদমস্তক  স্নান করিয়ে দিয়ে আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেল। মন আরো ভালো হয়ে গেল। দুদিন বাদেই গুরুপূর্ণিমা। তীব্র বর্ষণের পর পাহাড়ি জ্যোৎস্নাও মিলবে। 

হলও তাই। বৃষ্টির সময় থেকেই নদী আরো মাতাল হয়ে উঠেছিল। তার গলার স্বর আরো তীব্রতর হয়েছে। নিচে সেই উদ্দামতা, আর আকাশে শান্ত চাঁদ। অদ্ভুত এক রাত এলো রকি আইল্যান্ডে। 
নবনীতা স্বগতোক্তির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন – “অবাক লাগে, কে এত গুছিয়ে সব কিছু কত যত্নে সাজান!” পপি নিজের মনে বললেন – “তখনই ‘তাঁর’ কথা মনে পড়ে! সবার চেয়ে বড় শিল্পী যিনি!” নিতাই হার আর আমি রাত্রির রকি আইল্যান্ডে হাঁটতে বেরোলাম। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দেখি – চাঁদ ভাসছে মূর্তি নদীর জলে! ‘মূর্তি মুক্তি ব্রিজ’ তৈরি হয়েছিল ২০০৩, উদ্বোধন করেছিলেন দার্জিলিং গোর্খা অটোনমাস হিল কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান হাংবু সুব্বা। দেখে ভালো লাগল কালিম্পঙেরই এক কন্সট্রাকশন কোম্পানি এই বিখ্যাত সেতুটি তৈরি করেছিল। 

সারারাত জাগা, আধোজাগা আর ঘুমের ভেতর শুধু নদী বয়ে চলল!

ভোরে উঠে বের হলাম রকি আইল্যান্ডের ইতিহাস জানতে। প্রিয়াঙ্কা হোম-স্টে-র রেস্তোরাঁয় চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথা বলবার মানুষ খুঁজছিলাম।
মিলেও গেল। হোম-স্টেটির মালিক প্রবীণ ধ্রুব ছেত্রী কাটোয়াল জানালেন, সামসিং গ্রাম পঞ্চায়েত ও জলঢাকা থানার এক্তিয়ারে রকি আইল্যান্ড। জেলা কালিম্পং (আগে ছিল দার্জিলিং জেলার অধীন)। খুব বেশি পরিবার এখানে বাস করে না। কিন্তু ধারেকাছেই ছড়ানো ছেটানো কিছু কিছু বসতি রয়েছে, যেমন – আপার ও লোয়ার ভালুখোপ বস্তি, তিনকাটারি বস্তি, ফারি বস্তি...। মানুষেরা বড় এলাচ, আদা, ভুট্টা, মাড়োয়া চাষ করে, ঝাড়ুর গাছ আবাদ করে। অনেকে অন্য রাজ্যে কাজে চলে গেছে। কখনো কখনো আসে। 
ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা স্কুলের পোশাক পরে পথ হাঁটছে। স্কুল কত দূরে – জানতে চাইলে ধ্রুববাবু বললেন – “আমাদের ছেলেমেয়েদের অনেক হাঁটতে হয়। সাত আট কিলোমিটার হেঁটে ওরা রোজ স্কুলে যায়। আর কলেজে যেতে হলে সেই মালবাজার!” 

এখানের মানুষের মধ্যে কোনো হিংসে নেই। ধ্রুব কী সহজে বললেন – “রকি আইল্যান্ডের অতীত জানতে চাইছেন? চলে যান গঙ্গাপ্রসাদ রাই-এর হোম স্টে কাম বাসায়। ওটাই এখানকার প্রথম হোম স্টে।” তিনিই এগিয়ে দিলেন ‘রকি আইল্যান্ড হোম স্টে-র দোরগোড়া অবধি!

বাইরে থেকে বোঝা যায় না, ভেতরে ঢুকতেই মুগ্ধতা ছেয়ে গেল। কী মিষ্টি কটেজগুলো! গঙ্গাবাবুকে প্রায় ঘুম থেকে টেনে তুললাম। উদ্দেশ্য জেনে বললেন – “একটু ওয়েট করুন। আমি আমার স্ত্রীকে ডেকে আনি। উনি সব ভালো করে বলতে পারবেন।”

একটু বাদেই এলেন ইন্দু রাই। হোম স্টে-র মালকিন। সামসিং-এর রেঞ্জার ছিলেন বাদল দেবনাথ। তিনিই নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বন্ধু শিলিগুড়ির সুখেন বিশ্বাসকে।  সুখেনবাবুর তখন ঘোরার নেশা, নতুন নতুন জায়গা explore করার নেশা। নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্লোরার ক্লাবের হয়ে নানান জায়গায় ক্যাম্প করে বেড়ান। নিজে হাতে টেন্ট বানান। সেই টেন্ট বনদপ্তরও তাঁর কাছ থেকে নেয়। বাদলবাবুই তাঁকে এই পাহাড়ি গ্রামে নিয়ে আসেন। তখন এই এলাকার নাম তলোঘুমটি গাঁও।  পাকা রাস্তা তৈরি হয়নি। গঙ্গাপ্রসাদ বিদ্যুৎ দপ্তরে চাকরি করেন, বাইরে পোস্টিং। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিটায় টুকটাক আবাদ হত। সুখেনবাবু এখানে পর্যটকদের জন্য তাঁবু টাঙানোর (টেন্ট) প্রস্তাব দেন। সেটা ১৯৯৮ সাল। নিজে থেকে নদী থেকে পাথর তুলে সাজাতে লাগলেন। এত বড় বড় পাহাড়ি পাথর দেখে তিনিই জায়গাটির নাম দেন ‘রকি আইল্যান্ড’। সেই শুরু এখানের পর্যটন। প্রথমে সুখেনবাবুর আরো দুই বন্ধু (শেখর পাল ও দেবাশিস রায়) তাঁর সঙ্গে পার্টনারশিপে ছিলেন। ১৯৯৮-এ এই আয়োজনের নাম হল ‘রকি আইল্যান্ড টেন্ট রিসর্ট’। তখন পর্যটক প্রতি  গঙ্গাপ্রসাদ পেতেন পঁচিশ টাকা। কিছুদিন পর দুই বন্ধু সরে যাওয়ায় গঙ্গাপ্রসাদের সঙ্গে হোম স্টে চালাতে থাকেন সুখেন। নাম হয় ‘রকি আইল্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প’।  করোনাকালীন সময়ে ২০২১-এ তিনি তাঁর স্বত্ত্ব তুলে নেন। গঙ্গাপ্রসাদের সহধর্মিনী ইন্দু এবার দক্ষ হাতে সামলাতে থাকেন হোম স্টেটি। 

শিল্পীর ছাপ সর্বত্র। কত গাছপালা। “এই দেখুন রুদ্রাক্ষ গাছ, আর ওই আম গাছটি আমার শ্বশুরমশায়ের বাবা দক্ষিণেশ্বর থেকে এনে লাগিয়েছিলেন!” ইন্দু স্বপ্নে দেখেছিলেন নদীর একটা পাথর দেবমূর্তি নিয়ে মূর্তির বুকে রয়েছে। এবং স্বপ্নের মতোই তিন লেয়ারের একটা মিনারেল রক খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। রুদ্রাক্ষ গাছটির নিচে সেই পাথরটিকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। সেই পাথরের নামকরণ হয়েছে ‘গনেশজী’, তাঁর পুজো হয় এখানে। এও যেন প্রকৃতিপুজো। 

ইন্দুর গোয়ালে গরুরা জাবর কাটছে। পুকুরে মাছের সাঁতার। তিনি আমাদের দেখাতে নিয়ে গেলেন কমলালেবুর বাগান। ছোট ছোট ফল সদ্য এসেছে। বেশ কটা পথ নেমে গেছে স্রোতস্বিনী মূর্তির বুকের দিকে। বিশাল বিশাল পাথরে অবসর কাটানোর একান্ত আয়োজন। সব কিছুই প্রাকৃতিক। 

“শুরুতে গাড়ি রাস্তাই ছিল না। সামসিং বাজার থেকে পর্যটকরা ট্রেকিং করে আসতেন। এখন তো ভিড় লেগেই আছে।”- ইন্দু হাসতে হাসতে বললেন। এই বয়সেও হাসিটি বড্ড মিষ্টি। কী ভালো গুছিয়ে বাংলা বলেন! তাঁর সরস্বতী মন্দির দেখিয়ে বললেন – “নিজে লেখাপড়া শিখতে পারিনি। বাবা মূর্খ ছিলেন। মেয়েরা পড়ুক – এটা কখনোই চাননি। আমি কিন্তু শুক্লা পঞ্চমীতে বিদ্যার দেবীর পুজো করি অনেক বড় করে। বাঙালিদের কাছে শিখে নিয়েছি খিচুড়ি আর লাবড়া রাঁধা। আশেপাশের প্রতিটি পাহাড়ি গ্রামের মানুষ ভিড় করে আসেন। আমি নিজে হাতে খিচুড়ি লাবড়া রেঁধে খাওয়াই!” 

বললাম – নভেম্বর/ডিসেম্বরে আসব কিন্তু। গাছ থেকে হলুদ হলুদ কমলা পেড়ে খাব!

ইন্দু বললেন – আপনার জন্য দুয়ার খোলা রইল!  

ইন্দু রাই-এর কাছ থেকে মুঠোফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে সুখেনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জানালেন, প্রকৃতি তাঁকে চিরদিন গভীরভাবে টেনেছে। এক্সপেডিশনের নেশাতেই খোঁজ পেয়েছিলেন এখানকার। এক বিদেশীর গাইড হয়ে এসে জায়গাটির টানে আটকে পড়েন। তখনই যোগাযোগ হয় রেঞ্জার বাদলবাবুর সঙ্গে। সেই বিদেশী প্রকৃতিপ্রেমিকের পরামর্শে নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্ককে রক্ষা করার একটা তাগিদ ভেতরে কাজ করে। পাহাড়ি গ্রামে টেন্ট পেতে পর্যটনের আলো ছড়ানোর পাশাপাশি পাহাড়ি বনাঞ্চলে বাস করা মানুষদের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল। সুখেনবাবু বললেন, “আমার বানানো টেন্টেই এই এলাকার পর্যটনের সূচনা।” আবার এই মানুষটিই নিজের গড়া হোমস্টে-র যাবতীয় অধিকার ছেড়ে দেন নির্দ্বিধায়, ২০২১ সালে। এখন মানুষটি বেদান্তচর্চায় ডুবে থাকেন, স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দের বেদান্ত আলোচনায় মগ্ন থাকেন, আর অনেকগুলো পথকুকুর একটি কাক ও আরো অবলা প্রাণীদের সেবায় আনন্দে দিন কাটান। জিজ্ঞেস করলাম – রকি আইল্যান্ডে যেতে ইচ্ছে করে না? সন্ন্যাসীর মতো বললেন – "পিছুটান রাখিনি। গেলে আবার যদি জড়িয়ে পড়ি!" 

সুখেনবাবু একটা জনপদকে পর্যটন মানচিত্রে তুলে এনে নিজে সব মালিকানা পিছুটান তুলে নিলেন, কিন্তু আসবার সময়েও আমার এক পাহাড় পিছুটান রয়েই গেল যে! 

--------------------------------------------------------------------

রকি আইল্যান্ড হোমস্টে - ৮৬৭০০০৬৬৩২
ত্রিবেনী হোম-স্টে - ৮৯১৮২৭৪৩৪৬ 
সুস্মিতা হোম স্টে – ৮০১৬৪০২৭১৮

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri