মায়াপথে মীড়-১/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়/১
সৌগত ভট্টাচার্য
ফুরররর... ফুরররর...
হুইসেলের আওয়াজ পেলেই মাথা না উঠিয়ে আমরা এ ওর দিকে তাকাতাম। যাক… মিনিট দশেকের রেস্ট।
অমিয় স্যারের ব্যাচে পড়ছি ঠিক সন্ধ্যা ছয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে যখন বাড়ির ভেতরে থেকে যখন হুইসেল বেজে উঠত, প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম না ঠিক কী হচ্ছে। ভাবতাম খেলাচ্ছলে কেউ বাজাচ্ছে হয়ত। একদিন কী করে যেন জানতে পারলাম, ঠিক একই সময় হুইসেল বাজলেই স্যার ব্যাচ ছেড়ে বাড়ির ভেতর চলে যান টিফিন করার জন্য। ফিরে আসতেন ঘড়ি ধরে দশ মিনিট পর। এসেই বলতেন, "হ্যাঁ যেটা বলছিলাম...."
স্যারের বাড়ির বাইরের ঘরে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা চৌকি পাতা ছিল, তার সামনে এল শেপ করে রাখা দুইটা হাই বেঞ্চ, দুইটা লো বেঞ্চ। আমরা লো বেঞ্চে বসতাম। চৌকির ওপর কিছু বই খাতাপত্র থাকত। স্যার চৌকির উপর বসে পড়াচ্ছেন, মাথার ওপরে টিনের চাল গরম হয়ে উঠছে, স্যার আমাদের সায়েন্স গ্রুপের তিনটি সাব্জেক্ট পড়াচ্ছেন । স্যারের বাঁ পাশে একটা বড় নীল প্ল্যাস্টিকের কন্টেনারটা রাখা থাকত, আজও চোখে ভাসে। অঙ্ক শেষ করে স্যারের সামনে খাতাটা এগিয়ে দিলে, খাতা দেখে কন্টেনার থেকে রাবার স্ট্যাম্প বের করতেন। উল্টো করে রাবার স্ট্যাম্পটা দেখে নিয়ে অঙ্ক বা বিজ্ঞান খাতায় সিল দিতেন। সাদা খাতায় বেগুনি সিল পড়ত। সেই সিল ছিল কখনো শুধুই তারিখ, অর্থাৎ খাতা দেখা হল। আবার কখনো একই সিলে “খুব ভালো/ ভালো/মোটামুটি” ছাপ; আবার কখনো 'বাড়ির কাজ'; নিজের সইয়ের একটা সিল ছিল স্যারের, আরেকটাতে লেখা 'অভিভাবকের স্বাক্ষর'! কত রকম যে সিল ছিল! কিশোর বয়সে সাদা খাতায় বেগুনি সেই সিল ছাপ্পড়কে মহাগুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলেই বোধ করতাম। বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই সব সিল-ছাপড় লাগানো খাতাগুলো হারিয়ে গেল, কিন্তু সেই সব দিনের স্মৃতি হারালো না।
ভালোরা তো চিরকালই ভালো। কিন্তু আমাদের মতো গড়পড়তা ছাত্ররা যারা — বসন্ত যাদের জীবনে শুধু পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েদের দেখলে মন কেমন নিয়ে আসে না, অঙ্ক ভরা টেস্ট পেপার নিয়ে আসে! ফিজিক্সের মনে না থাকা সংজ্ঞা আর জোর করে মুখস্ত করা কেমিস্ট্রির অবোধ্য ফর্মুলার নিয়ে আসে! যারা স্কুলে কখনও হাত তুলে পড়া বলার দলে থাকে না; অথচ ফেলও করে না শুধু মনে মনে স্বপ্ন দেখে মাধ্যমিকের অঙ্ক বিজ্ঞান বইগুলোকে তিস্তার জলে ভাসিয়ে দেবার, এ লেখা তাদের জন্য।
যাইহোক, এক চান্সে সায়েন্স গ্রুপে মাধ্যমিক পাশ করতে হবে!
অঙ্ক বা ভৌতবিজ্ঞানকে যতটা না ভয় পেতে শিখেছিলাম ভালোবাসতে তো শিখিনি।
ফর্সা মাঝারি হাইটের হাসিহাসি মুখের আপনি মানুষটি আমাদের মতো গড়পড়তা ছাত্র যারা মাধ্যমিকের পর বিজ্ঞান বইকে বিদায় দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম তাদেরও বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। যাঁরা টেস্ট পেপারের যে কোনো পৃষ্ঠা খুলে চোখের নিমেষে অঙ্ক করতে পারতাম না তাঁদের অঙ্ককে ভয় না পেয়ে বন্ধু ভাবতে শিখিয়েছিলেন। তিনি অঙ্ক করতে দিয়েছেন, আমরা অনেক দূরে বসে অঙ্ক কষতে কষতে শুধু উচ্চারণ করেছি, "স্যার..." অমিয়বাবু ওই প্রান্ত থেকে আক্ষরিক অর্থে চোখ বন্ধ করে স্মিত মুখে উত্তর দিয়েছেন, "তিন নম্বর স্টেপে তুই গুণের বদলে যোগ করেছিস, ওটা ঠিক করে দে, অঙ্ক মিলে যাবে..." আমার খাতা না দেখেই কি ভাবে বুঝলেন! সবার ক্ষেত্রেই একই ভাবে ভুল অংশটুকু কী ভাবে বলেছেন! ম্যাজিক! আজ নিজে শিক্ষক হয়ে বুঝি ছাত্রদের সঙ্গে কতটা মনের যোগ থাকলে, কতটা অভিজ্ঞতা থাকলে, কতটা নিবিড় সম্পর্ক থাকলে, সবচেয়ে বড় কথা একজন ছাত্রের কতখানি মন পড়তে পারলে, খাতা না দেখে ছাত্রের সামান্য সূক্ষ্ম ভুল পদক্ষেপও চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়!
আমাদের কাছে অমিয়বাবু ছিলেন সাক্ষাৎ ড্রইং টিচার । আরশোলার হৃদপিণ্ড বা রেচনতন্ত্রর নিরস আঁকাগুলোকে মাত্র কয়েকটা বিন্দু আর সহজ রেখা দিয়ে শিখিয়েছিলেন। আঁকা শেষ হলে নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারতাম না যে, এমন নিখুঁত আঁকা আমিই এঁকেছি ! আমরা কেউ পরবর্তীতে পেইন্টার আর্টিস্ট কিচ্ছু হইনি কিন্তু বিজ্ঞান পরীক্ষায় আঁকার জন্য বরাদ্দ নম্বরের সবটাই পেয়েছিলাম স্যারের জন্য।
ক্লাস টেন। ত্রিকোণমিতি পুরো মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, কিছুই বুঝি না, বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। ভালো ছাত্ররা সবাই তখন টেস্ট পেপার থেকে আর অন্য বইপত্র থেকে কী সব এক্সট্রা-টেক্সট্রা ফটাফট করে ফেলছে। কিশোর মনের হীনম্মন্যতা স্যার কী করে যেন টের পেতেন! সহজে মনে রাখার কত ছাড়া যে বলতেন! সেই ছড়াগুলো যত্ন করে রাখলে নিঃসন্দেহে আজ কয়েক ফর্মার ছড়ার বই হয়ে যেত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কিন্তু ওই যে বললাম, সায়েন্স পড়ব না (বলা ভালো পড়তে পারব না) জন্যই সেই ছড়াগুলোকেও মনে রাখা বা সংগ্রহে রাখাকেও পাপ বলে মনে করেছিলাম আমরা। এখন বুঝি, একজন শিক্ষকের বিষয়ের প্রতি কতটা দখল আর ভালোবাসা থাকলে এ ভাবে পড়ানো যায়। আমার মত কত শত ছাত্রের আজন্ম ভয় দূর করে অঙ্ক আর বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। ছেলে ভোলানো ছড়া দিয়েও যে শুধু বিজ্ঞান পড়ানো যায় এমন না, সেই বিষয়কে ভালোবাসতে শেখানো যায়, তলানিতে পড়ে থাকা আত্মবিশ্বাস ফেরানো যায়, স্যারকে না দেখলে এ জীবনে জানা হত না।
বহু দশক পর এখন বুঝি, একটা গোটা প্রজন্মের কত কত ছাত্র আজও কৈশোরের অঙ্ক ভীতি বয়ে বেড়াচ্ছে…মধ্য বয়সে এসেও মাঝেমাঝে অঙ্ক পরীক্ষার দুঃস্বপ্নে আজও ঘুম ভেঙে যায়।
শুধুমাত্র অমিয়বাবুর মতো একজন শিক্ষকের অভাবে।
মাঝে কয়েক যুগ কেটে গেছে। সেই সময় শাশুড়িকে নিয়ে মাঝেমাঝেই ডাইলেসিসি সেন্টারে পৌঁছাতে বা আনতে যাই। সেখানে হঠাৎ একদিন স্যারের সাথে দেখা। সেই অমলিন হাসি ঠোঁটের কোণে লেগে আছে। স্যারের কিডনির সমস্যা, ডাইলেসিস নির্ভর জীবন স্যারের। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই স্যারের সঙ্গে কথা হত ওই সেন্টারে। শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কথাবার্তা হত। স্যারের মতো এত অন্তর থেকে ভদ্র বিনয়ী মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। চার ঘণ্টা ডাইলেসিস নেওয়ার পর কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে ধকল সামলে বিশ্রাম নিয়ে তারপর রোগীরা বাড়ি ফেরেন। সেই সেন্টারে চেয়ারের সংখ্যায় পর্যাপ্ত ছিল না। স্যারকে দূর থেকে দেখতাম, ডাইলেসিস নিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছেন, চোখ মুখ ক্লান্ত, ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলছে। সেই সময় কোনো মহিলা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যদি ডাইলেসিস রুমে ঢুকতেন, স্যার নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন তাকে বসতে দেওয়ার জন্য, এই সৌজন্য এই ভদ্রতা বড় গভীরের।
অমিয়বাবু অখ্যাত এক সরকার পোষিত স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। স্যারের ক্লাস ছিল যেন ম্যাজিশিয়ানের শো। আমরা ছিলাম দর্শক। আমরা অনেকেই পরবর্তী জীবনে বিজ্ঞান নিয়ে পড়িনি। কিন্তু আপনার বোঝানো প্রতিটি বিষয় চেষ্টা করলে আজও বলতে পারি, নিজের সন্তানকে শেখাই। ইদানীং “আদর্শ শিক্ষক” জাতীয় শব্দ যখন শুনি, তখন অমিয়বাবুর কথা খুব মনে হয়। সমাজ প্রবর্তিত “আদর্শ শিক্ষক” বলতে যে মূর্তি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, স্যার মোটেও সেরকম ছিলেন না। তিনি মাস পয়লা টিউশন ব্যাচের টাকা নিতেন, জীবনে একটাও নীতি বাক্য বলেছেন বলে আমার মনে পড়েনা, উনি কখনও জীবনে কী করা উচিত বা উচিত না, ইত্যাদি নিয়ে কখনও একটি শব্দও বলেননি। শুধু "আপনি আচরি ধর্ম" এই নীতি বাক্যের প্রথম লাইনটিই আজীবন অনুশীলন করেছেন। আসলে অঙ্ক আর বিজ্ঞানকে ভালোবাসার ছলে তিনি আস্ত জীবনটাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন!
সারাদিন ছাত্র পড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার পর স্যার একটা মাদুর নিয়ে বাড়ির পাশের বিরাট সবুজ মাঠে চলে যেতেন। চিত হয়ে শুয়ে গ্রীষ্মের রাতের নির্মেঘ আকাশের দিকে, তারার দিকে তাকিয়ে থাকতেন… তাকিয়েই থাকতেন…
এমনই কোনো সন্ধ্যায় সেই হুইসেলটা হয়ত আবার বেজে উঠেছিল। আমরা, স্যারের ছাত্ররা কেউ শুনতে পাইনি। শুধু স্যার শুনেছিলেন। সেটা হাফ টাইমের টিফিন-বিরতি হুইসেল ছিল না, সেটা ছিল খেলা শেষের ফাইনাল হুইসেল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴