[প্রাককথাঃ
বাগানিয়া জার্নাল-এর প্রথম ভাগ আমার টাইমলাইনে বেরিয়েছিল। অমিত চেয়েছিলেন
সেটা ‘সহজ উঠোন’-এ বার হোক। নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় ভাগ তাই
এখানেই ধারাবাহিক হিসেবে বার হবে।
নীচের লিঙ্ক ক্লিক করলে প্রথম ভাগের সব কটা পর্বের (মোট সাতাশ পর্ব) লিঙ্ক পাওয়া যাবেঃ
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বোধিধর্ম ধ্যানে বসেছেন। চোখ খোলা রেখে ধ্যান। সে ধ্যান কবে শেষ হবে কেউ জানে না।
কিন্তু ধ্যান করতে করতে কখন যে তার চোখের পাতাদুটো বন্ধ হয়ে গ্যাছে –তিনি নিজেই টের পেলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন নিজের অজান্তেই ...
ঘুম
ভেঙে উঠে নিজের ওপরে ভীষণ রাগ হল হল তাঁর। যাতে আর কখনও চোখের পাতা বুঁজে
যেতে না পারে সেই রাগে পাতা দুটো কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন দূরে......
কী আশ্চর্য!!! যেখানে পড়ল তারা সেখানে ছড়িয়ে দিল শিকড়। গজিয়ে উঠল দুটো গাছ। সে গাছের পাতা জলে সিদ্ধ করে খেলে আর ঘুম আসে না...
এভাবেই প্রথম জন্মাল আমাদের চির পরিচিত চা গাছ – ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস (Camellia sinensis)।
##
এটা
একটা চিনা উপকথা। এর নানা ভার্সান আছে। বোধিধর্মের জায়গায় কেউ কেউ তাকে
বলেন খোদ বুদ্ধদেবই। তবে মূল গল্পটা একইরকম। এর পরের গল্প ২৭৩৭ খৃষ্ট পূর্ব
নাগাদ চিন সম্রাট শেন নং (Shen Nong)-কে নিয়ে।
সম্রাট
গিয়েছেন শিকারে। তাঁবু খাটিয়ে জঙ্গলেই বাস কয়েকদিনের। সেখানে হল
সর্দি-জ্বর। বৈদ্যর কথামতো দুবেলা ফোটানো গরম জল খাওয়া। একদিন রাতে ভৃত্যরা
যখন সম্রাটের জন্য একটা গাছের নীচে জল ফোটাচ্ছে তখন সেই গাছের দুটো পাতা
উড়ে এসে পড়ে জলে। সিদ্ধ হয়ে যায়। জলের রঙ হয়ে পড়ে কিছুটা বাদামী-লাল। তাড়া
থাকায় ভৃত্যরা সেই জলই খেতে দেয় সম্রাটকে। সম্রাট না জেনে সেই জল খেয়ে
দেখেন অনেকটাই চনমনে হয়ে গেল শরীর।কয়েকদিনের ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল
একেবারেই। খোঁজ নিয়ে জানলেন গাছটার কথা। শুরু হল উত্তেজক পানীয়
(stimulating drink/beverage) হিসেবে চা খাবার প্রচলন।
##
চা
বললে চিনের কথা প্রথমেই উঠবে। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা
নিশ্চিত হয়েছেন যে চিনের ইউনান, সিচুয়ান এবং বার্মার উত্তরাংশই চায়ের আদি
জন্মস্থান।ওষধি হিসেবে চা খাবার প্রচলন শুরু হয়েছিল চিনের ইউনান প্রদেশে
শাং রাজবংশের আমলে (১৫০০-১০৪৬ খৃঃপূঃ)।
##
আদিতে
চিনদেশ থেকে চা বাইরে এসেছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাত ধরে -প্রথমে জাপানে ও
পরে অন্যান্য জায়গায়।আধুনিক কালে সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়েছে ডাচ ও পর্তুগীজ
বণিকরা।
চা-কে মান্দারিন ভাষায় বলে ‘চা’ (Chá) এবং মিন চাইনীজ ভাষায় বলে টা বা টে (Ta/T′e)।
পন্ডিতেরা
বলেন ১৫৫০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ পর্তুগিজদের হাত ধরে সিল্করুট হয়ে স্থলপথ
বাণিজ্যে চা যেখানে যেখানে গিয়েছে সেখানে তাকে মান্দারিন ‘চা (Cha)’ বা
চা-য়ের কোন রকমফের (derivatives) নামেই ডাকা হয়, যেমন - চায় (Chay),
চায়ে(Chaye), চাই(Chai)।
আর
ডাচদের হাত ধরে জলপথে চা যেখানে যেখানে গিয়েছে সেখানে মিন চাইনিজ টা বা টে
(Ta/T′e)-র রকমফের নামে ডাকা হয়, যেমন Thee (Dutch),Tea (English,
Hungerian, Basque),Tee (German, Africans,Finnish, West
Frisian,Estonian), Teo (Esparato),Tae(Irish), Tsai (Greek) ইত্যাদি। এক
কথায় বলা হয় ‘Tea by Sea-Cha by Land’. (ছবি -১)
##
পৃথিবী
জোড়া চা-বাণিজ্য একচেটিয়া ভাবে (monopoly) ছিল চিনাদের হাতে।চা-এর জন্য
সবাইকেই তাই চিনাদের ওপরেই নির্ভর করতে হত আর চিনারাও তা শক্ত হাতে
নিয়ন্ত্রণ করত। বানিয়া ইংরেজদের তা সহ্য হবে কেন।তাতে ভাগ বসাবার জন্য তারা
উঠে পড়ে লাগল। চা গাছ তৈরি করতে হলে চায়ের বীজ লাগে। চিনারা দেয় না। ফলে
ইংরাজরা তা চুরি করে (smuggle) এনে লাগাতে শুরু করল ভারতবর্ষের বিভিন্ন
জায়গায়- কলকাতার বোটানিকাল গার্ডেনে (১৭৮০ খৃষ্টাব্দ), কুমায়ুনে । সে
প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। দু-একটা গাছ যা-ও জন্মাল – টিঁকলো না শেষ পর্যন্ত।
১৮২৩
খৃষ্টাব্দে আসামের মণিরাম দত্ত বরভান্ডারী বরুয়া, যিনি মণিরাম দেওয়ান
নামেই পরিচিত, রবার্ট ব্রুস নামের এক স্কটিশ ভদ্রলোককে(যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া
কম্পানীর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রাক্তন মেজর) একটা খবর দিলেন।তখনকার
আসাম-এখনকার অরুনাচল প্রদেশের বুড়ি ডিহিং নদীর ধারের সিংফো নামে এক জনজাতির
বাস। তারা দীর্ঘদিন থেকেই ‘ফালাপ’ (Phalap/Falap) বলে একরকম পানীয় খায় যা
খেতে চায়ের মতই।
সিংফোরা জঙ্গল থেকে ফালাপের কচি পাতা
সংগ্রহ করে, একটুখানি ভেজে, রোদে শুকিয়ে নেয়, তিনরাত ধরে তাকে শিশির
খাওয়ায়, তারপর বাঁশের খোলের মধ্যে ঠেসে ঠেসে ঢুকিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে ঝুলিয়ে
রাখে যতক্ষণ না তাতে এক বিশেষ ধরনের সুবাস(Flavour) তৈরি হয়।।যখন প্রয়োজন
হয়- দা দিয়ে তার থেকে একটু কেটে নিয়ে গরম জলে ফুটিয়ে খায়।
ব্রুস
তার ভাই চার্লস আলেকজান্ডার ব্রুসকেও এ কথা জানান। এবং সিংফো প্রধান বিসা
গাম (Bisa Gam)-এর কাছ গিয়ে নিজে চোখে ফালাপ দেখেন, পান করেন।
রবার্ট
ব্রুস ফালাপকে ‘চা’ বলে চিনতে পারেন এবং বিসা গামের কাছ থেকে ফালাপ-এর
কিছু নমুনা নিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন পরীক্ষার জন্য। সে পরীক্ষার ফলাফল আসার
আগেই ১৮২৪ সালে রবার্ট মারা যান। ১৮৩৪ সালে তার ভাই আলেকজন্ডার ব্রুস আবার
তা সংগ্রহ করে কলকাতার বোটানিকাল গার্ডেনে পাঠান। এবার তাকে নির্ভুল ভাবে
চিনা চা-য়েরই (ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস) এক দেশী রকমফের (Camellia sinensis
var Assamica)হিসেবে সরকারি ভাবে মেনে নেওয়া হয়।
সিংফোদের ‘ফালাপ’ নিয়েও একটা গল্প আছে।
অনেক
দিন আগে দুই সিংফো ভাই শিকার করতে ঢুকে পড়েছিল গভীর জঙ্গলে। অনেকদিন ধরে
জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেও শিকার করার মত কোন জন্তুজানোয়ার পেল না। এদিকে সঙ্গের
জল, খাবার সব শেষ। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ভাইদের আর হাঁটার শক্তিও
নেই।তারা ঠিক করল রাতটা একটা গাছের নীচে কাটিয়ে পরদিন ঘরের পথ ধরবে।সেই মত
একটা ছোট গাছের নীচে রাত কাটাতে বসল। কিন্তু ক্ষিদের কামড় এমনই যে, আর
থাকতে না পেরে, তারা ওই গাছেরই পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে খেয়ে নিল।
কিছুক্ষণ
পরেই তারা আশ্চর্য হয়ে দেখল যে তাদের আর ক্ষিদে, পিপাসা পাচ্ছে না। শরীরও
অনেক চনমনে হয়ে পড়েছে। এক ভাই তাই অন্যজনকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল – ফা লাপ?
‘ফা’ মানে ‘কী’ আর ‘লাপ’ মানে ‘পাতা’ – এটা কী পাতা?
তারা তখন সেই গাছের বীজ পেড়ে বাড়িতে এনে পুঁতে দিল।গজিয়ে উঠল ফালাপ গাছ।
কিছুদিনের
মধ্যেই সিংফোরা সেই গাছের পাতার গুণ ও মূল্য বুঝতে পারল এবং হাতে কলমে
নানা পারমুটেশান-কম্বিনেশানের ভিতর দিয়ে আজকের ‘ফালাপ’ তৈরির পদ্ধতিতে এসে
পৌঁছল।
ছবিঃ
এক।। Geo-Linguistic spread of Tea । সৌজন্যঃ
reddit.comদুই।। ফালাপ-এর বিভিন্ন ছবি। সৌজন্যঃ বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে নেওয়া